১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শেখ মুজিব। পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন বাঙালিদের মুক্তির মহানায়ক ও জাতির পিতা। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট জাতির পিতার প্রাণ কেড়ে নিলে পরদিন পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার পাশে সমাহিত করা হয় জাতির পিতাকে। বঙ্গবন্ধুর শেষ সময়ের সাক্ষীদের সেই কথা যেন হৃদয়ে গাঁথা। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আজও তাঁদের চোখ পানিতে ভিজে যায়।
বঙ্গবন্ধুর দাফনকারী টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে শুনেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। সেদিন টুঙ্গিপাড়া শোকে নিস্তব্ধ ও থমথমে অবস্থা বিরাজমান ছিল। দুপুরের দিকে টুঙ্গিপাড়া থানাসংলগ্ন হেলিপ্যাডে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তার আগে সেনাসদস্যরা হেলিকপ্টার থেকে নিচে নেমে অবস্থান করে। পরে বঙ্গবন্ধুর কফিন বহন করার জন্য আমিসহ অন্যদের ডাকা হয়। তখন আমরা হেলিকপ্টারের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর কফিন বের করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা সেনাসদস্যরা কফিনসহ দ্রুত কবর দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম লাশ না দেখে দাফন করতে আপত্তি জানান। এ নিয়ে মৌলভী ও সেনাসদস্যদের কিছুক্ষণ কথা-কাটাকাটি হয়। পরে মৌলভী সাহেব একজন মুসলমানকে ইসলামি বিধিবিধান মেনে দাফনের দাবি জানান। তখন সেনা কর্মকর্তারা ১৫ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের নির্দেশ দেন।
যখন বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলা হয়, তখন তাঁর বুকে চব্বিশটি গুলির চিহ্ন ছিল। গুলিগুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। ডান হাতের তালুতে একটি গুলি, পায়ের গোড়ার পাশে একটি ও দুই রানের মাঝখানে দুটি গুলি ছিল। তখনো তাঁর শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিল সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবি। পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির এক পকেটে ছিল চশমা ও প্রিয় পাইপ।
পরে আইয়ুব মিস্ত্রিকে দিয়ে কফিন খুলে লাশ বের করে আনা হয়। আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে একটি ৫৭০ সাবান কিনে মান্নান শেখ, সোনামিয়া, ইমাম উদ্দিন গাজী বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশের ডোবা থেকে বালতি ভরে ভরে পানি এনে গোসল করান। এরপর শেখ সায়েরা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে রিলিফের মাল শাড়ি আনা হয়। শাড়ির লাল ও কালো পার ছিঁড়ে ফেলে কাফনের কাপড় বানানো হয়। এই কাপড় পরিয়ে (বর্তমান বঙ্গবন্ধুর বেদির সামনে) জানাজা করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে বাবা ও মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুর পর যে রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, সেটা বঙ্গবন্ধু পাননি।
পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট দুপুরে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ এসে পৌঁছায়। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামিয়ে টুঙ্গিপাড়া সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কাশেম, আব্দুল হাই মেম্বর, আকবর কাজী, ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সী, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টারসহ অন্যরা তাঁর পৈতৃক বাড়িতে লাশ বহন করে আনেন। কফিন খুলে লাশ বের করে ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়। রেড ক্রিসেন্টের রিলিফের কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হয়। জানাজা শেষে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা শেখ সায়েরা খাতুনের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। জানাজা ও দাফন শেষে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম। সেনা ও পুলিশ হেফাজতে তড়িঘড়ি করে দাফন সম্পন্ন করা হয়। জানাজায় গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতে চাইলেও দেওয়া হয়নি।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবুল বশার খায়ের বলেন, বঙ্গবন্ধুকে দাফনের জন্য আগে থেকেই টুঙ্গিপাড়ায় কবর খুঁড়ে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে দাফনে গ্রামের মানুষ অংশ নিতে এগিয়ে আসেন, কিন্তু পথেই পুলিশ ও সেনাসদস্যরা তাদের বাধা দিয়ে আটকে দেন। কবর দেওয়ার পর সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
তিনি আরও জানান, ওই দিন বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ নিতে টুঙ্গিপাড়া আসতে গেলে পথেই আমাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আটকে দেয়। দাফনের পর বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত ও শ্রদ্ধা নিবেদন নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনে গিয়ে অনেকেই পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছেন। তারপরও পুলিশের বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর অনুরাগীরা কবরে এসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে লাশ টুঙ্গিপাড়া গ্রামে দাফন করে ওরা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। টুঙ্গিপাড়া বাঙালি জাতির তীর্থ স্থানে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির চেতনায় চির অম্লান হয়ে রয়েছেন। আজ লাখ লাখ মুজিব সেনা ও মুজিবপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।