১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হলো। নানা কারণে উর্দুভাষী ও তথাকথিত ইসলামপন্থীদের দ্বারা রাজনীতি ও সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়া শুরু হলো। রাজনীতি, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে করাত চালাল পাকিস্তানিরা। রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করে দেওয়া হলো। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ১৯৬১ সালে আন্দোলনও হয়েছে। এই সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটালেন চিত্রপরিচালক সালাউদ্দিন।
তখন যাত্রায় ‘রূপবান’-এর জয়জয়কার চলছে। দল বেঁধে ‘রূপবান’ দেখত মানুষ। এই গল্প সিনেমার পর্দায় আনলেন সালাউদ্দিন। ছবিটি সুপারডুপার হিট হলো। এই অবস্থায় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হলো। এখানে ভারতীয় ছবি আসা বন্ধ হয়ে গেল।
১৯৬৫ সালে একদিকে ভারতীয় ছবি আমদানি বন্ধ হয়ে গেল, অন্যদিকে বাঙালি গ্রহণ করল ‘রূপবান’কে। গ্রামবাংলায় ব্যাপকভাবে হিট হলো এই ছবি। ছবিটি একদমই নন-সিনেমাটিক। এখানে চলচ্চিত্রের কোনো ভাষা নেই। যাত্রাপালার মতোই একটা ছবি ‘রূপবান’। এবার লোককথাভিত্তিক চলচ্চিত্রের হিড়িক উঠল। ‘আবার বনবাসে রূপবান’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’—এমন অনেক ছবি তৈরি হলো।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করলেন, ব্যাপক অর্থে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো। বাঙালির মধ্যে একটা নবচেতনার সৃষ্টি হয়। এই অঞ্চলের নির্মাতারাও সেই চেতনায় ছবি নির্মাণ শুরু করলেন। খান আতাউর রহমান বানালেন ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’। এটা একটা নাটক; চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভাষাই এ ছবিতে নেই। ওই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অবরুদ্ধ পরিবেশে মানুষের ঐতিহাসিক চেতনার কারণে ছবিটি হিট হলো। লোকজন আনোয়ার হোসেনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেল। তার ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা’ সংলাপ মনে গেঁথে গেল। সোহরাব রুস্তম, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, ঈশা খাঁ নিয়ে ছবি তৈরি হলো। ঐতিহাসিক সংগ্রামী চরিত্রগুলো নিয়ে ছবি নির্মাণের একটা জোয়ার তৈরির চেষ্টা চলল।
সামাজিক ছবিগুলোতেও এ ধরনের কাহিনি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলল। ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে যখন তুমুল আন্দোলন চলছে, ছাত্র ও গণ-আন্দোলনের পটভূমিকায় জহির রায়হান আরেকটা মহৎ ও বিপ্লবী ছবি বানালেন—‘জীবন থেকে নেয়া’।
এই ছবির মাধ্যমে জহির রায়হান একটা নতুন ভাষা তৈরি করলেন। এই ছবির যে সাউন্ড, সংলাপ, মিউজিক—ওই সময়ের জন্য তা খুবই উঁচু মানের ছিল। বিশেষ করে সেট। প্রতিটি বিষয় ছিল রূপক। ব্যাপক অর্থে সময়টা তিনি তুলে ধরেছেন। বাঙালি কিন্তু ঠিকই বুঝেছে—জহির রায়হান কী বলেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় মানুষের সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই জহির রায়হানের নেতৃত্বে আলমগীর কবির, বাবুল চৌধুরীরা নির্মাণ করলেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের চারটি অনবদ্য দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, ‘স্টেট ইজ বর্ন’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’। এগুলোকে বলা হলো জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। নির্মাণে এগুলো যে কত উঁচুমানের ছিল, আজকের দিনে দেখলে শুধু বিস্ময়ই জাগে। শুধু প্রামাণ্যচিত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত গণহত্যার একটি অসামান্য দলিলও বটে। এই গণহত্যাকেই সেলুলয়েডের ফিতায় আবদ্ধ করে বিশ্ববাসীকে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন এই নির্মাতা।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের যে একটা গতি ছিল, সেটা থেমে গেল। পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের যে এলিমেন্টগুলো ছিল, পর্দা থেকে একে একে তা উপড়ে দেওয়া হলো। আমাদের চলচ্চিত্রের যে একটা ভাষা, নতুন নায়ক-নায়িকা, পরিচালক আত্মপ্রকাশ করছিলেন—সব যেন থমকে গেল। তবে এই সময়ে ‘মেঘের অনেক রং’ নামে মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি মুক্তি পেয়েছে। যদিও ছবিটি নির্মাণ হয়েছিল পঁচাত্তরের আগেই।
অনুপম হায়াৎ: চলচ্চিত্র গবেষক ও বিশ্লেষক। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাবেক সদস্য।
(অনুলিখন: মীর রাকিব হাসান)