‘মন বলে চল ফিরে আবার, স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।’ জনপ্রিয় গান থেকে মোবাইল অপারেটরের জিঙ্গেল। প্রিয়জনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ঈদে বাড়ি ফেরার উচ্ছ্বাস প্রকাশের সমার্থক হয়ে উঠেছে এই গান। তাই বলে সবার স্বপ্ন কি বাড়ি ফেরে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঘরের কোণে মুখ গুঁজে গোটা উৎসব পার করে—এমন মানুষ তো থাকেন এই রাজধানীতে! এই গল্পটা এমন কারও।
সকাল ১০ টা। কল্যাণপুরে ব্যাগ, লাগেজসহ এক দম্পতি তাঁদের ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠছে। চোখেমুখে ঘরে ফেরার আনন্দ ঠিকরে পড়ছে। খানিকটা দূরে এগোতে দেখা গেল এক তরুণীকে, লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে। তীব্র গরমে কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। এই দাবদাহও বাড়ি ফেরার খুশিকে ম্লান করতে পারেনি। ঘেমে ঘেমে জবজবে, তবুও মুখে কোনো অস্বস্তির ছাপ নেই। তাঁদের স্বপ্নেরা আজ বাড়ি ফিরছে।
কিন্তু অধরার গল্পে কোনো স্বপ্ন নেই, আনন্দ নেই। এক যুগ পেরিয়ে গেল, ঈদে তাঁর বাড়ি যাওয়া হয় না। অবশ্য সে অর্থে তার তো বাড়িই নেই! এই ইট-পাথরের হৃদয়হীন নগরই তার ঠিকানা। এ শহর আঁকড়ে পড়ে আছেন তিনি। এ শহরের ধুলোবালি, কোলাহল, দূষণ সবই তাঁর আপন। এক সময় উৎসবে পার্বণে দল বেঁধে মানুষের বাড়ি ফেরা দেখলে ডুকরে কেঁদে উঠতেন। এখন সয়ে গেছে। অজান্তে বুকের কোথাও মোচড় দিয়ে উঠলে, চোখের কোণ জল ঝলমল করলে সংবিৎ ফিরে পেতেই ফিক করে হেঁসে ওঠেন। জীবনে আর বৈচিত্র্য নেই, দৈনন্দিন জীবন তাঁর কাছে নিছক ‘অভ্যাস’!
অধরার বয়স এখন ২৬। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে বছর তিনেক হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে কর্মরত। পেশার সুবাদে তাঁর সঙ্গে সখ্য। আড্ডার ছলে জানা হয় তাঁর ছন্নছাড়া জীবনে গল্প।
সালটা ২০১৪। ১৮ ছুঁই ছুঁই অধরা রাজধানীতে এসেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাবে ভর্তি হন। এ সময়ই মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দুজন মানুষের ভালোবাসার ফসল এবার একা হয়ে পড়েন। ভর করে অনিশ্চয়তা। শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই।
এতটা সময় জীবনটা একাই টেনে নিয়ে এসেছেন অধরা। এখন অবশ্য দিব্যি ভালো আছেন। কিন্তু পিছুটানও যে কখনো কখনো মধুর হয়ে ওঠে, সেটি টের পান রাজধানীতে যখন উৎসবের আমেজ শুরু হয়। কয়েকটা দিন মুখটা ম্লান হয়ে থাকে। বিশেষ করে ঈদ যত ঘনিয়ে আসে নিজেকে তত একা, অসহায় বোধ করেন।
অধরা মোহাম্মদপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। ঈদের ছুটি কাটে চার দেয়ালের বদ্ধ কুঠুরিতে। উৎসবের আনন্দ ছুঁতে দেন না। প্রাণপণে বেঁধে রাখেন নিজেকে। তাই ঈদে নতুন জামা পরেন না। কোনো নামী রেস্টুরেন্টে বিশেষ খাবার কিংবা ঘোরাঘুরি তাঁকে টানে না। সবার জীবনে ঈদ থাকতে নেই, আনন্দ থাকে না—এই বলে নিজেকে প্রবোধ দেন তিনি। ঈদের ছুটি কাটে রান্না করে আর সিনেমা দেখে।
কতক্ষণ আর প্রবোধ দিয়ে নিজেকে সব ভুলে থাকতে বলা যায়! একাকিত্বের অবকাশে স্রোতের স্মৃতিরা এসে ভর করতে থাকে। শৈশবের ঈদ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাঁদের স্বপ্নের এক বাড়ি ছিল। চাঁদ মামাকে সালাম দেওয়া, ঈদের আগের রাতে দুহাত ভরে মেহেদির আলপনা আঁকা, ঈদের আগেই নতুন জামা বারবার পরে ভাঁজ নষ্ট করে ফেলা...। মায়ের মসলা বাটার আওয়াজ উৎসবের জানান দিত।
শৈশবের ঈদ, অধরার মস্তিষ্কে এক অনপনেয় স্মৃতি হয়ে আছে। কনকনে শীতেও সাতসকালে গোসল দিয়ে নতুন জামা পরা। মেকআপ বক্স নিয়ে সাজুগুজু করা। দু’হাতে পায়ে নেলপালিশ দিয়ে জড়োসরো হয়ে বসে থাকা। ঠোঁট রাঙিয়ে অনেক জোরাজুরিতেও কিছু মুখে না দেওয়া; যদি লিপস্টিক উঠে যায়!
সকালে একটা জামা পরা, আবার বিকেলে অন্য জামা পরে ঘুরতে যাওয়া। আর সন্ধ্যার পর টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা। টিভি চ্যানেলগুলোর একঘেয়ে অনুষ্ঠানও এদিন আর বিরক্তি ধরাতে পারত না। কত মজাই না হতো শৈশবের ঈদে!
কিন্তু এখন? ঈদ অধরা জন্য কোনো আনন্দ বয়ে আনে না। ঈদের আনন্দ উঠানে রং ছড়িয়ে যায়, তাঁর ঘরে উঁকি দেয় না!
অধরার স্বপ্নেরা যাবে কোথায়? তাঁর স্বপ্নেরা কি আদৌ বেঁচে আছে? ভাবতে বসলেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে স্বপ্নেরা উঁকি দেয়, আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এই উৎসবে আনন্দের ভাগ পেতে কার কাছে যাবে অধরা—মায়ের কাছে গেলে তো বাবাকে পাওয়া যাবে না, আবার বাবার কাছে তো মা নেই! এই গ্রীষ্মের দাবদাহ মাথায় করে অতটা পথ কেন তিনি বিষাদ কিনতে যাবেন?
এই শহরে এমন কত অধরার স্বপ্নেরা ঘরের কোণে মাথা ঠুকছে তার ইয়ত্তা নেই! হৃদয়হীন শহরে আপন খুঁজে ফেরে তারা। স্বপ্নেরা কখনো বাড়ি খুঁজে পায় না। অনেকে গল্পটা হয়তো শেষ হয় নচিকেতা চক্রবর্তীর সেই গানের মতো—
খোকন এখন হোস্টেলে থাকে, রঙিন পৃথিবী কালো
বাবা করেছেন বিয়ে আবার, মা করেছেন লিভ টুগেদার
খোকন ছাড়া মোটামুটি আর সবাই রয়েছে ভালো।
দু’টো পাড় যদি এক হতে না চায় সেতুর কী প্রয়োজন!