‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’

আশিকুর রিমেল, ঢাকা
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৪, ১৪: ১৭
আপডেট : ২৬ মে ২০২৪, ১৫: ২৯

রাতটা প্রায় নির্ঘুম কাটিয়েছেন রিকশাচালক আলমগীর হোসেন (৪২)। কয়েক বছর আগে বড় মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করতে রাত-দিন রিকশা চালিয়েছেন। তখন ঘুম আর জেগে থাকার ফারাক তেমন করেননি। কিন্তু গত রাতে তাঁর মনে মাতঙ্গী নেচেছে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ আতঙ্ক। কষ্টার্জিত অর্থে গড়া বাড়িটার থেকেও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় কাটছে তাঁর সময়। 

 সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আলমগীর। সাগরের পার্শ্ববর্তী এই গ্রামে সকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি কর্মকর্তা এসেছিলেন। দুপুরের মধ্যে সবাইকে স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য নির্দেশের সঙ্গে অনুরোধও করে গেছেন। রোববার সকাল থেকে পাঁচবার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করছেন। জেনেছেন, সকাল থেকেই আকাশে মুখ কালো করে আছে মেঘ। 

জীবিকার তাগিদে সাত বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান আলমগীর হোসেন। জানা গেল, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ ওই এলাকাসহ উপকূলে আঘাত, হেনেছিল তাঁর চোখের সামনেই। যে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, সেই মেয়ে তখন সংসারের সবচেয়ে ছোট সদস্য। টিনের ঘরের চাল উড়ে গিয়েছিল। ভয়ানক রাত কাটিয়েছেন সপরিবারে। সম্পদ নয়, জীবনটাই ছিল অনিশ্চয়তার মধ্যে। 

আলমগীর হোসেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বরে বললেন, ‘কথায় আছে না—‘‘ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’! আমার হইছে এই অবস্থা। বাড়িতে এখন বাড়িআলী, বয়স্ক বাপ-মা আর ছোট মেয়ে। সকাল থেকে চার-পাঁচবার কতা বলিচি। সংসার গোচাচ্ছে। আইজকা সন্ধ্যার দিকে ঝড় আসপি শুনতিছি। চিন্তায় রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি।’ 

রিকশার প্যাডেল মারতে মারতে জানালেন—এমন পরিস্থিতিতে ঘর-বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় মনে কষ্ট হয়। গবাদি পশু-পাখিগুলো নিরাপদ জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করা হয় প্রশাসন থেকেই। এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের প্রবল ঝড় থেকে। এখনো ভুলতে পারেননি সর্বশেষ ওই অঞ্চলে তাণ্ডব চালানো আইলার কথা। এই ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী জনজীবনকে। 

আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বাড়িতে ২টা গরু, ৬টা ভেড়া, ৩টা ছাগল আর কিছু হাঁস-মুরগি আছে। ওইগুলা আব্বা-মা দেখাশোনা করেন। বাড়িতে ঘর এখন আধপাকা, কিন্তু টিনের চাল। আব্বা-আম্মার বয়স হয়ে গেছে, ওদের নিয়েই বেশি চিন্তা হইচ্চে।’ 

জানালেন, গবাদিপশুর জন্য নিরাপদ স্থানের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। তাঁর রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার আগে তিনি সৃষ্টিকর্তার ওপর তাঁদের রক্ষার দায়িত্বভার দিয়ে বললেন, ‘কাল রাতে বাড়ি যাইতে চাইছিলাম। বউ নিষেধ কইরল। বইলল, অবস্থা খারাপ দেখলে আশ্রয়কেন্দ্রে চইলে যাবে।’ 

এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রিমাল রোববার আরও শক্তিশালী হয়ে আসছে খুলনা ও বরিশাল উপকূলের দিকে। এর ফলে মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহা বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। 

মোংলা বন্দরের জেটিসহ পশুর চ্যানেলে নোঙর করা বিদেশি ছয়টি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধসহ ওই সব জাহাজকে নিরাপদ নোঙরে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষের অপারেশনাল সব কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। 

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে কক্সবাজার অংশেও সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। রোববার সকাল থেকে সাগরে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট বেড়েছে। জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফের উপকূলীয় কয়েকটি এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সকাল থেকে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করা লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের সামনের অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং এসব জেলাসংলগ্ন দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত