গত বছর এই দিনেও আব্দুর রহিম ছিলেন সুস্থ–সবল এক দিনমজুর। রাস্তায় কিছু খেতে ইচ্ছে করলে যেন খেয়ে নেয়, সে জন্য স্কুলপড়ুয়া নাতনিটার হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন ৬০ টাকা। আর একটা বছর ঘুরে আজকের বিজয় দিবসে তিনি নিজেই হাত পাতছেন রাস্তায়–রাস্তায়।বাস্তবতার কশাঘাতে আজকে বিজয়ের দিনের অর্থ তাঁর কাছে—‘রাস্তায় আজ অনেক মানুষ, তাই ভিক্ষাও ভালো পাওয়া যাবে’। হয়েছেও তাই, ভিক্ষাবৃত্তিতে নামার দেড় মাসে আজকেই তিনি সবচেয়ে ভিক্ষা পেয়েছেন।
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিগড় থেকে আর্থসামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। এই লড়াইয়ে রয়েছে কৃষক-শ্রমিকসহ নানা পেশার লাখো মানুষের আত্মোৎসর্গ, ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মা-বোন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানসহ মৌলিক মানবাধিকার পূরণসহ সুষম আর্থিক বণ্টন ব্যবস্থাসহ একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন থেকে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল, আজ তার ৫১ বছর পূর্ণ হলো। সে জন্য গতকাল রাত থেকেই রাজধানীতে চলছে উৎসবের আমেজ, যা প্রতিবছরই হয়।
কিন্তু বিজয়ের লড়াইয়ের পেছনে যে স্বপ্ন অর্ধশতক পরেও তা কি পূরণ হয়েছে? বরগুনার পাথরঘাটার আব্দুর রহিম মিয়াদের বাস্তবতা অন্তত তার সাক্ষ্য দেয় না। ৭৩ বছর বয়সী এই নির্মাণশ্রমিক ঢাকায় কাজ করে দিনে যে মজুরি পেতেন তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলত তাঁর। কিন্তু তিন মাস আগে তলপেটের টিউমার অপসারণের জন্য সার্জারির পর থেকে তাঁর কাজ বন্ধ। এখন তাঁকে ভিক্ষা করতে হয়! রহিম মিয়াদের মতো অসহায় ও বৃদ্ধ নাগরিকদের জন্য বিজয়ের ৫১ বছরেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি এই রাষ্ট্র। কোনোরকমে ক্র্যাচে ভর করে হাত পেতে বেড়ান নগরীর রাস্তায় রাস্তায়।
রাজধানীর মালিবাগে থাকেন আব্দুর রহিম। ভোরের আলো ফুটতেই যখন নগরীর বিভিন্ন ছেলে–বুড়োরা রঙিন সাজে বেরিয়েছেন বিজয় আনন্দ উদ্যাপনের জন্য। ঠিক সে সময়ই বেরিয়েছেন তিনিও। ভাবনায় ‘যত জন তত হাত’। কেউ যে তাঁকে ফেরাচ্ছে না, তা নয়। তবে অন্য দিনের থেকে পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যাটা আজ বেশি। একে তো বিজয় দিবস, তাতে আবার শুক্রবার। তাই নিতান্তই প্রয়োজনে যারা বেরিয়েছেন, তারা ছাড়া প্রত্যেকেই বিজয় আনন্দ উদ্যাপনের উদ্দেশে।
ভারী শরীর নিয়ে কিছু দূর হাঁটেন তারপর আবার বসে পড়েন আব্দুর রহিম। বনশ্রী এলাকায় রাস্তার পাশে বসেছিলেন। হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিতেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ছলছল চোখে। কৌতূহলের জবাবে আব্দুর রহিম জানালেন তাঁর সার্জারির কথা। এখন ভারী কাজ করার শক্তি পান না, তাই দেড় মাস হলো ভিক্ষায় নেমেছেন। সকাল থেকে সারা দিন থেকে থেকে ঘুরেছেন রামপুরা, মোল্লাপাড়া, বনশ্রী এলাকায়। এখন যাবেন হাতিরঝিলের দিকে। সেখান থেকেই আবার বাড়ি ফিরবেন।
কথায়–কথায় জানা গেল তাঁর বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটায়। সার্জারির বিষয়ে জানতে চাইতেই নিজেই আগ বাড়িয়ে বললেন, তাঁর একমাত্র মেয়ে রোজির আকস্মিক মৃত্যুর কথা। তিনি যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখন পাথরঘাটা থেকে রোজি তাঁকে দেখতে ঢাকায় আসার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিলেন। মায়ের সঙ্গে এ নিয়ে সেদিন কথা–কাটাকাটিও হয়েছিল তাঁর।
সেদিন আর ঢাকায় আসেননি রোজি, কিন্তু চলে গেছেন একেবারেই না ফেরার দেশে। খুব সম্ভবত স্ট্রোক হয়েছিল রোজির। আব্দুর রহিম ছলছল চোখে বললেন, ‘মেয়েডা আমারে দেখতে আইতে চাইছেলে, মইররাই গেছে, দেহা হয় নাই।’
নাতি–নাতনি দুজন তার সেই মেয়েটির সন্তান। দুজনই লেখাপড়া করে। নাতি কলেজে, নাতনি এবার এসএসসি পাস করেছে। মেয়ে-জামাই যোগাযোগ রাখে না, তাই দুজনের দায়িত্ব আব্দুর রহিমের ওপরই।
বাড়িতে একখণ্ড জমি বন্ধক রেখে চিকিৎসার জন্য টাকা নিয়েছিলেন স্থানীয় এক কারবারির কাছ থেকে। এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ওই জমিটা মুক্ত করা, নাতি–নাতনিদের ভবিষ্যতের জন্য।
ঢাকায় এখন একাই থাকেন আব্দুর রহিম। চিকিৎসক জানিয়েছেন বিশ্রামে থাকলে আর নিয়মিত কিছু ওষুধ খেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ আর কোথায়! এভাবেই চলতে চলতে যেদিন সুস্থ হবেন, সেদিনের অপেক্ষায়!