বাশার মিয়া নিজের কপালকেই দুষছেন এখন। লালমনিরহাটে পরিবার–পরিজন রেখে এই খটমটো ঢাকা শহরের অলি–গলিতে রিকশার প্যাডেল দিতে দিতে মনে খেদও জমে ওঠে। কিন্তু এই তাবৎ খেদকে চাপা দিয়ে প্যাডেল চেপে যান তিনি। নিজের ও সন্তানদের স্বপ্ন তাঁকে থামতে মানা করে। সামনেই ঈদ।
রাজধানীর রামপুরা বনশ্রীতে হন্যে হয়ে ৫০০ টাকার ভাংতি খোঁজার সময় পরিচয় হলো বাশার মিয়ার সঙ্গে। হাতে যাত্রীর দেওয়া ৫০০ টাকার নোট। গা থেকে দরদর করে নামছে ঘাম। ৫০ টাকা ভাড়া নিতে গিয়ে যাত্রীর কাছ থেকে এই ৫০০ টাকার নোটটি পেয়েছেন। যাত্রীর কাছেও আর ছোট নোট নেই। আর বাশারের সারা দিনের কামাই এখনো এর ধারেকাছেও যায়নি। যাত্রীর দেওয়া ৫০০ টাকার খুচরা দিতে নিজের কাছে থাকা ৪০ টাকা দুবার গুনলেন। তারপর অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘মোর টে ভাংতি নাই।’ এর পর নিজেই নামলেন নোট ভাঙাতে। কয়েক দোকান ঘুরে সে নোট ভাঙিয়েও আনলেন। লেনদেন ফুরালো।
এই দেখতে দেখতেই কথা জুড়ে দিলাম বাশার মিয়ার সঙ্গে। গত সাত বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান লালমনিরহাটের বাশার মিয়া। আজ মঙ্গলবার যেমন রোজা রেখে আধবেলা ভাড়ায় রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন তিনি। বেলা ১২টার দিকে বের হয়েছেন। রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় বেলা ২টার দিকে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হলো, তখন তাঁর কাছে মোট ৯০ টাকা। বলছিলেন এই পেশা সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস, ধারণা। বললেন, ‘দেখেন ঘাম ঝরেয়া মানুষ হয়া মানুষ টানি। এর থাকি লজ্জার কাম আর নাই।’ কাজটা কেন লজ্জার, তা না বললেও বললেন নিজের মন্দ কপালের কথা—‘লেখাপড়া করি নাই তো, তার জন্যে মোর এমন কপাল।’
এ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের কপালের খোঁজ নেওয়ার সাধ্য কার–ইবা আছে! কিন্তু বাশার মিয়ার কণ্ঠের যে খেদ, তার তত্ত্বতালাশ খুব একটা সহজ নয়। তাই চুপ থাকটাই শ্রেয় মনে হলো।
লকডাউন চলছে সারা দেশে। কথায় কথায় জানা গেল, স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বাশার মিয়ার সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম বাশার ঈদে বাড়ি যেতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বাড়ির লোকেদের। নানা যুক্তি দেখিয়ে পরিবারের মানুষগুলোকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বললেন, ‘বড় বেটির বিয়ে দিছি, একখান নাতিও আছে। নাতি, জামাই, বউ, আর দুই বাচ্চার জন্যে কাপর–চোপর কেনার ট্যাকা পাঠাছি। এইটাই শান্তি! এলা খালি নিজে দিনেরটা দিনে কামাই। ঈদের পরে গাড়ি চালু হইলে, ভাড়া কমলে কয়দিন থাকি আসমো।’
পরিবারের মানুষগুলোর স্বপ্নের সীমানা বাশারের আয় দিয়ে নির্ধারিত হয়। তবুও তাঁর দুই ছেলেকে অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে পড়াশুনা করাচ্ছেন তিনি। তাঁর চাওয়া—ছেলে দুটি একদিন অনেক বড় চাকরি করবে। সেদিন আর রিকিশা চালাবেন না তিনি। শেষ জীবনে আরাম–আয়েশে জীবন কাটানোর স্বপ্ন তাঁর।