ঘটনার ঘনঘটা
রাজধানীর মগবাজারে নিজ বাসায় শিক্ষক দ্বারা প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হয়েছিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আসমা (ছদ্মনাম)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি অ্যাপ সম্পর্কে জানতে পেরে সে এবং তার বন্ধুরা অ্যাপটি ডাউনলোড করে। একদিন পড়াতে এসে সেই শিক্ষক আসমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে আসমা মোবাইলে অ্যাপটির ‘রেপ অ্যালার্ট’ অপশন ক্লিক করে। এতে কিছুক্ষণের মধ্যে তার বন্ধুরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আসমাকে উদ্ধার করে।
রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে অফিসফেরত সুমি কিংবা নারায়ণগঞ্জের শিল্পীও একই অ্যাপের মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত করতে পেরেছেন বিব্রতকর ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে। দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো সময় নারীরা এই অ্যাপের সুবিধা নিতে পারবেন।
সঙ্গী যখন অ্যাপ
কোনো নারী যদি বিপদের আশঙ্কা করেন, তিনি নিতে পারেন অ্যাপের সহায়তা। রক্ষা পেতে পারেন উত্ত্যক্তকরণসহ যেকোনো বিব্রতকর ও বিপজ্জনক অবস্থার হাত থেকে। এর জন্য স্মার্টফোনে ‘বাঁচাও’ নামের অ্যাপটি ইনস্টল করতে হবে। কেউ বিপদের আশঙ্কা করলে এই অ্যাপের নির্দিষ্ট বাটনে ক্লিক করলে সে বার্তা পৌঁছে যাবে আশপাশে থাকা সেই অ্যাপ ইনস্টল করা স্মার্টফোনে। বিপদের বার্তা পেয়ে কাছাকাছি থাকা স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে পারবেন।
‘বাঁচাও’ যেভাবে কাজ করবে
গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইনস্টল করতে হবে। এরপর জরুরি যোগাযোগের জন্য তিনজনের ফোন নম্বর নির্বাচন করতে হবে। এই অ্যাপ স্মার্টফোনে ইনস্টল করা নারী যদি কখনো বিপদের আশঙ্কা করেন, তাহলে অ্যাপের ‘রেপ অ্যালার্ট’ লেখা বাটনে ক্লিক করলে কাছাকাছি থাকা পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও স্বেচ্ছাসেবকেরা সেই বার্তা
পেয়ে যাবেন।
এতে তাঁরা সেই নারীকে দ্রুততম সময়ে সহযোগিতা করতে পারবেন। আবার সেই নারী যদি নিজেকে নিরাপদ মনে করেন, তবে অ্যাপের ‘সেইফ নাও’ লেখা সবুজ অপশনে ক্লিক করলে সংশ্লিষ্টরা সেটা জানতে পারবেন।
বাঁচাও নামের এ অ্যাপ তৈরির পেছনে রয়েছেন কম্পিউটার প্রকৌশলী জালাল মির্জা। ব্যক্তিগত জীবনের এক মর্মস্পর্শী ঘটনা তাঁকে এ অ্যাপ বানাতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর খুব কাছের একজন ধর্ষণের শিকার হন বেশ কিছুদিন আগে। সে ঘটনা এক দিনে থেমে যায়নি। সে নারীর স্বামী তাঁর বন্ধুদের দিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ চালিয়ে গিয়েছিলেন। সে ঘটনা জালাল মির্জার পরিবারকে রীতিমতো নাড়িয়ে দেয়।
২০১৮ সালে মৃত্যুর আগের রাতে জালাল মির্জার মা তাঁকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুমি বাবা এত বড় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, পারলে কিছু করো। পারলে একটা মেয়েকে বাঁচাও।’
মায়ের সেই কথা রাখার চেষ্টা করেছেন জালাল মির্জা। নিজের সেই আপনজনের মতো আর কেউ যেন ধর্ষণের শিকার না হয়, সে জন্য একটি অ্যাপ তৈরি করেন তিনি। নাম দেন ‘বাঁচাও’। গড়ে তোলেন বাঁচাও ডট লাইফ ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের মোটো হিসেবে ঠিক করেন ‘আর একটাও ধর্ষণ হতে দেব না’।
বাঁচাও ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জালাল মির্জা মনে করেন, এ দেশের মানুষের সচেতনতা আর সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব। অ্যাপ তৈরি করতে গিয়ে তিনি দেখেন, এ দেশের ৮০ শতাংশ নারী ধর্ষণের শিকার হন আশপাশের ও কাছের মানুষদের মাধ্যমে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তিনি এমন একটি অ্যাপ তৈরি করেন, যার মাধ্যমে একজন নারী বিপদের আশঙ্কা করলে সাহায্য চাইতে পারবেন।
আমাদের দেশে শহর ও গ্রাম- সব জায়গায় নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। গ্রামের নারীরা এই অ্যাপে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হবেন–এ বিষয়ে জালাল মির্জা বলেন, ‘যাঁদের স্মার্টফোন নেই, তাঁদের কথা চিন্তা করে আমরা বিটিআরসির কাছে বিকাশ ও নগদের মতো শর্টকোডের আবেদন করছি।’
অ্যাপটির যাত্রা শুরু হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে। বিভাগীয় শহরের মধ্যে ঢাকায় ডাউনলোডের সংখ্যা বেশি। ‘বাঁচাও অ্যাপ’-এর মাধ্যমে এ পর্যন্ত বিপদে পড়ে সহযোগিতা চেয়ে ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার ঘটনা রয়েছে ১৬৫টি।