যখনই কোনো দেশে, রাজ্যে বা ভূখণ্ডে তীব্র আন্দোলন হয়, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়—কর্তৃপক্ষ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমেই যে সহজ পন্থা বেছে নেয়—ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। কিন্তু সরকার বা কর্তৃপক্ষ কেন এটা করে থাকে?
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির উৎকর্ষে ইন্টারনেট এখন খুবই সহজলভ্য। ইন্টারনেট সবার মুঠোয়। আর এতে করে যেকোনো তথ্য দ্রুত ছড়ানো খুবই সহজ। আন্দোলন বেগবান হওয়া বা দাবানলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ইন্টারনেট অপরিহার্য। আর তাতেই বেকায়দায় পড়ে যান প্রশাসকেরা। আন্দোলন দমাতে সাধারণ মানুষকে তথ্যপ্রবাহ থেকে দূরে রাখতে তাই ইন্টারনেট শাটডাউনের মতো অগ্রহণযোগ্য পন্থা তারা বেছে নেয়। এর সবশেষ জ্বলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এই বছরের কোটা আন্দোলনের সময়ে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশব্যাপী সবচেয়ে বড় শাটডাউন। এবারেরটা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলেও বাংলাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউন নতুন কিছু নয়। ‘মাইন্ডফুল রাইটস’ নামক মানবাধিকার প্রকল্পের ব্যানারে ‘ইন্টারনেট শাটডাউনস ইন বাংলাদেশ’ নামক এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউন হয়েছে ১১ বার। শাটডাউনগুলো মূলত মোবাইল নেটওয়ার্কে হয়েছিল। এই সময়ে ইন্টারনেট থ্রটলিং করা হয়েছিল (ইন্টারনেটের গতি কমানো)। ১১টি শাটডাউনের মধ্যে ৮টি হয়েছিল বিএনপির সমাবেশের সময়। একটি হয়েছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরিদর্শনের প্রতিবাদের সময়। অন্য একটি ছিল হিন্দুবিদ্বেষী দাঙ্গার সময়ে। আরেকটি ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেটের দোকানদারদের মধ্যে সংঘাতের সময়। বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, সাধারণত সরকার বড় বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট শাটডাউন করে, যাতে বিক্ষোভ বড় আকার ধারণ করতে না পারে অথবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়।
মানুষের কর্মজীবন থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংকিংসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে শাটডাউনের ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বাভাবিক সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়।
বাকস্বাধীনতার অধিকার ক্ষুণ্ন হয় ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার লঙ্ঘন হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল রেজল্যুশন নম্বর ৪৪/১২-তে (জুলাই ২০২০) তথ্য বন্ধের জন্য ইচ্ছাকৃত ইন্টারনেট শাটডাউনের তীব্র নিন্দা জানায়। রেজল্যুশনে আরও বলা হয় যে ইন্টারনেট শাটডাউন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে, বিশেষ করে বাকস্বাধীনতার অধিকার ও তথ্য পাওয়ার অধিকার লঙ্ঘন। রেজল্যুশন অনুযায়ী ইন্টারনেট শাটডাউন কখনোই ন্যায়সংগত না, এমনকি জাতীয় সুরক্ষা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার কারণেও না।
ইন্টারনেট শাটডাউন প্রতিরোধে আলাদা সরকারি সংস্থা তৈরি করা দরকার, যা কিনা নির্বাচিত সরকার থেকে আলাদা থাকবে। নীতিমালা তৈরি করা উচিত—কখন ইন্টারনেট শাটডাউন করা যাবে আর কখন যাবে না। ফেসবুক ও অন্য যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারকে আলোচনায় বসতে হবে, যেন তারা ঘৃণা ও উসকানিমূলক পোস্ট ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী পোস্টগুলো তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলে।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী