তখনো অবিভক্ত ভারতবর্ষে ছবি ছাপা হতো কাঠের ওপর খোদাই করা ব্লক দিয়ে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী যখন তাঁর ‘ছেলেদের রামায়ণ’ বইটি বের করলেন, দেখা গেল কাঠের ব্লকে ছাপানোর কারণে ছবিগুলো সব বিকৃত হয়ে গেছে। অথচ কী চমৎকার ছিল ছবিগুলো!
কী করা যায়। এ থেকে তো বের হওয়া দরকার। মনে পড়ল, ছাত্রাবস্থায় জেনেছিলেন, তামা ও দস্তার পাতে খোদাই করে ছাপলে ছবি ভালো হয়। এ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ইউরোপেও তখন এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছিল। তখনো হাফটোন নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছিল না। অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্নভাবে তৈরি হচ্ছিল তা। উপেন্দ্রকিশোর গবেষণা করে হাফটোন ব্লক নির্মাণের একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের সন্ধান করছিলেন। এই পরিশ্রমী গবেষণা সফল হলো। প্রবন্ধগুলো ছাপা হলো ‘পেনরোজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল’ নামের পত্রিকায়। এই পত্রিকাকে বলা হয় মুদ্রণজগতের বাইবেল।
প্রচলিত হাতড়ে বেড়ানো পদ্ধতির অবসান ঘটল এ রকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কারের সুবাদে। ১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ‘পেনরোজ’ পত্রিকা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মোট ৯টি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। আর হাফটোন বিষয়ে উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রদীপ’ পত্রিকায়।
প্রবন্ধটি পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পড়ে তিনি দেখলেন, হাফটোন নিয়ে উপেন্দ্রকিশোরের যে কৃতিত্ব, তা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেই প্রবন্ধটি লিখেছেন লেখক উপেন্দ্রকিশোর। তখন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘অনেকেই হয়তো জানেন না হাফটোন লিপি সম্বন্ধে উপেন্দ্রবাবুর নিজের আবিষ্কৃত সংস্কৃত পদ্ধতি বিলাতের শিল্পীসমাজে খ্যাতি লাভ করিয়াছে; উপেন্দ্রবাবু স্বাভাবিক বিনয়বশত তাঁহার প্রবন্ধের কোথাও এ ঘটনার আভাসমাত্র দেন নাই।’
রবীন্দ্রনাথের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হলো ১৯০৫ সালে, তখন রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ রোধের জন্য যে বিশাল শোভাযাত্রা হয়েছিল, তাতে অংশ নিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর হাতে ছিল বেহালা। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির সঙ্গে খোল বাজিয়েছিলেন দীনু ঠাকুর আর বেহালা বাজিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর।
সূত্র: শুভাশিস চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ মে,২০১৯