কুমিল্লার দেবিদ্বারে গোমতী নদীতে পানি কমতে শুরু করায় দুই পাড়ের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। প্রতিবছর কোটি টাকার মাটি-বাণিজ্য করছে তারা। বিভিন্ন পক্ষকে ম্যানেজ করে এসব করা হচ্ছে বলে জানান গোমতী চরের কৃষকেরা। জমি রক্ষায় পাহারা দিচ্ছেন তাঁরা।
ইতিমধ্যে মাটিকাটায় জড়িতদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকদের অভিযোগ, জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের শিষন মিয়া, চান্দপুরের সফিকুল ইসলাম ও আবু হানিফ, জাফরগঞ্জ বাজারের সিরাজুল ইসলাম, রফিকুল ইসলামসহ ২০-২৫ জনের একাধিক চক্র বছরের পর বছর ধরে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার চান্দপুর ও কালিকাপুর এলাকায় গিয়ে সিন্ডিকেটের লোকজনকে মাটি কাটতে দেখা যায়। গত বৃহস্পতিবারও ওই সব এলাকায় একইভাবে মাটি কাটা হয়েছে।
ওই দিন সকালে চান্দপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চান্দপুর উচ্চবিদ্যালয় ও মাদ্রাসার পাশে গোমতী পাড়ের মাটি কেটে ট্রাক্টরে ভরছেন শিষন মিয়া ও সিরাজুল ইসলামের লোকজন। এ সময় ঘাটে সিরাজুলকে পাওয়া না গেলেও শিষন মিয়াকে পাওয়া যায়। পরে তিনি ট্রাক্টরসহ পালিয়ে যান।
এ ছাড়া কালিকাপুর ঘাটে সংবাদকর্মী যাওয়ার খবরে ৫-৬টি ট্রাক্টর ও শ্রমিকেরা পালিয়ে যান। এ সময় ঘাট এলাকায় থাকা ৭-৮ জন কৃষক এগিয়ে এসে জানান, তাঁরা কৃষিজমির মাটি পাহারা দিচ্ছেন। পাহারায় থাকা কৃষকেরা চান্দপুর গ্রামের বাসিন্দা বলে জানা যায়।
কৃষক বদিউল আলম, নজরুল ইসলাম, মনোয়ারা বেগম বলেন, সিন্ডিকেটের লোকজন কৃষকের জমি, বিদ্যালয়ের মাটিসহ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। কালিকাপুরের শিষন মিয়া ও সিরাজুল জোর করে মাটি কেটে ট্রাক্টরে ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। বাধা দিলে তাঁদের জমিগুলোও দিয়ে দিতে চাপ দেন। তাঁরা বলেন, ঘাটপাড় এলাকার জমি চাষ করে তাঁরা সংসার চালান, কিন্তু সিন্ডিকেটের অত্যাচারে তা-ও করতে পারছেন না। তাই সকাল থেকে ঘাটপাড়ে বসে জমির মাটি পাহারা দিচ্ছেন। সিন্ডিকেটের কাছে তাঁরা অসহায় ও জিম্মি হয়ে পড়েছেন বলে জানান।
কালিকাপুরের গোমতী পাড়ের মহরম আলী, রাসেল সরকারসহ একাধিক বাসিন্দা বলেন, বেড়িবাঁধের ওপরে যখন মাটিবোঝাই ট্রাক্টর চলাচল করে, তখন তাঁদের ঘরগুলোও থরথর কেঁপে ওঠে। ঘরের আসবাব, বিছানা, এমনকি খাবারেও বালু জমে।
বাসিন্দারা জানান, গোমতীতে পানি বেশি থাকা অবস্থায় কয়েক মাস মাটি কাটা বন্ধ ছিল। এখন পানি কমে যাওয়ায় আবার মাটি কাটা শুরু হয়েছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসন অভিযান চালালে মাটি কাটার শ্রমিকদের পাওয়া যায়, কিন্তু মূল সিন্ডিকেটকে ধরতে পারে না তারা।
যোগাযোগ করা হলে অভিযুক্ত শিষন মিয়া বলেন, ‘কালিকাপুর এলাকায় আমার থেকে আরও বড় বড় সিন্ডিকেট মাটি কাটছে, তাঁদের বন্ধ করুন আগে। আমি তো ছোটখাটো।’
ফতেহাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান মাসুদ বলেন, ‘কোনোভাবেই মাটি কাটার এই সিন্ডিকেটকে থামানো যাচ্ছে না। রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে শেষ, ১০ মিনিটের রাস্তা যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট লাগে। এদের কাছে পুরো এলাকার মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। মাটিবোঝাই ট্রাক্টর চলাচল করায় গোমতীর ওপর কয়েকটি সেতুও হুমকির মুখে পড়েছে। এসব বন্ধ করা জরুরি।’
২০-২৫ জনের একাধিক চক্র বছরের পর বছর ধরে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে।মাটি কাটায় জড়িতদের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে, আদালতে মামলা করবে প্রশাসন।
মাটি রক্ষায় কালিকাপুর ঘাটে জমি পাহারা দিচ্ছেন কৃষকেরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক উন নবী তালুকদার বলেন, ‘যাঁরা মাটি কাটছেন, অভিযানে গেলে তাঁদের পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় শ্রমিকদের। এসি ল্যান্ডের (ভূমি কর্মকর্তা) মাধ্যমে যারা মাটি কাটছে, তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হবে।’
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘নদীর যে অংশ থেকে মাটি কাটা হচ্ছে, সেটি মূলত ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। এ ব্যাপারে যদি টেকনিক্যাল সাপোর্ট লাগে, আমরা দেব। যারা মাটি কাটছে, তাদের আমরা মৌখিকভাবে বলতে পারি, কিন্তু এটি বন্ধ করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। আমাদের তো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই।’