সেদিন অফিসে যাওয়ার আগে ধানমন্ডির দিকে যাওয়া হয়েছিল একটা জরুরি কাজে। সেখান থেকে অটোরিকশায় (যেটাকে আমরা সাধারণত সিএনজি বলি) করে খানিকটা বেশি ভাড়া দিয়েই অফিসের উদ্দেশে রওনা হই। গন্তব্য বনশ্রী। জানা কথা, ফার্মগেটের ট্রাফিক জ্যামে পড়ব। পড়লামও। কিন্তু যেটা আশা করিনি সেটা হলো, জ্যামের মধ্যেই হুট করে একজন পুলিশ সদস্য আমার ভাড়া করা অটোরিকশায় চড়ে বসলেন!
বসেছিলেন চালকের পাশেই। তিনি ওঠার আগে চালক বারবার বলছিলেন, ‘স্যার, মহিলা প্যাসেঞ্জার আছে।’ কিন্তু তিনি শুনলেন না। শুধু নির্দেশ দিলেন সাত রাস্তার দিকে যেতে। তিনি সেখানে নামবেন। অটোরিকশায় ওঠার আগে অবশ্য তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন চালককে এই রাস্তা দিয়ে যাবেন কি না। চালক ‘হ্যাঁ’ বলাতেই তিনি চড়ে বসেছিলেন।
হাতিরঝিলে ঢোকার মুখে তিনি নেমে গিয়েছিলেন। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য যেকোনো বাহনে যেকোনো জায়গায় যেতেই পারেন। কিন্তু ভাড়া করা একটি বাহনে ওঠার আগে যাত্রীকে একবার অনুরোধ করবেন না—এ কেমন ভব্যতা?
তিনি নেমে যাওয়ার পর চালককে জিজ্ঞেস করলাম, প্রায়ই এমন হয় কি না। অর্থাৎ, যেকোনো পুলিশ সদস্য হুট করে কোনো যাত্রীবাহী অটোরিকশা থামিয়ে তাতে চড়ে বসেন কি না। চালক জানালেন, খুব একটা হয়নি তাঁর সঙ্গে, তবে এমন যে হয় না তা-ও নয়। এক সিগন্যাল থেকে আরেক সিগন্যালে যেতে হলে তাঁরা এমনটা করেন। ভাড়া দেন কি না, জানতে চাইলে চালক হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘এরা কি কোনো সময় দেয়? এরা তো খালি নেয়। অনেক সময় পুরা একটা ভাড়ার টাকাও রাইখ্যা দেয়।’
অটোচালক বলছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। আমি ভাবছি আর একটা বিষয়ে। যেহেতু একটি ব্যক্তিগত যান আমি ভাড়া করেছি, সেহেতু তিনি আমাকে অনুরোধ করতে পারতেন। নারী হোক, পুরুষ হোক, কেউ যদি কোনো বাহন ভাড়া করে থাকেন, তাহলে সেই বাহনে কর্তব্যকর্মে যেতে হলেও তো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে। অথবা স্বাভাবিক কথোপকথনের মাধ্যমেও তো তাঁর প্রয়োজনের বিষয়টি তিনি পরিষ্কার করতে পারেন।
পাঠক, আমার মতো আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তখন আপনারা কী করেছেন জানা নেই। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, আমি প্রতিবাদ করলে ওই পুলিশ সদস্য চাইলেই আমাকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে পারতেন। আবার চালক তাঁকে দরজা খুলে উঠতে না দিলে মামলা ঠুকে দিতে পারতেন।
ওই পুলিশ সদস্য নেমে যাওয়ার পর মনে হয়েছে, একবার তাঁকে স্বাভাবিক আচরণের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যেত। মানুষে মানুষে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে ভব্য আচরণের একটি অবদান আছে। সেটা যখন আচরণ থেকে হারিয়ে যায়, তখন বন্ধনটা হালকা হয়ে আসে। তখন ‘মানুষে-মানুষে’ সম্পর্ক না হয়ে পদ বা পেশার ভারে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। এখানেও তেমনটা ঘটেছে।
এই তো কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পুলিশ সদস্যদের স্মার্ট হতে হবে। নিশ্চয়ই তিনি ইতিবাচক অর্থেই ‘স্মার্ট’ বুঝিয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশ সদস্যের উপলব্ধি করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কথা। অন্যের সঙ্গে ভব্য ব্যবহারও স্মার্টনেসের সঙ্গে যুক্ত, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। ভব্য আচরণের বিপরীতে যে আচরণ, সেটা করে মাস্তানেরা। আমরা নিশ্চয়ই পুলিশ সদস্যদের সেই রূপে দেখতে চাই না।
গতকালও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণের সঙ্গে পুলিশের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যে কথা বোঝেন, সে কথা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কবে বুঝবেন?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠিত হয় জনগণের সেবা করার জন্য, জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এসব বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য এমন সব কাণ্ড করেন যে মনে হয় জনগণই তাঁদের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত! তাঁদের তো ভয় পাওয়ার কথা নয়, বন্ধু ভাবার কথা।
সব পুলিশ সদস্য নিশ্চয়ই এ রকম নন। সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এমন পুলিশ সদস্যদের নিয়ে তৈরি প্রতিবেদন দেখে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর কারও কারও ভব্যতার অভাব যে ভালো মনকে আবার খারাপ করে দেয়, তার দায় নেবে কে?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা