এক সময় গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ব্যাপক প্রচলন ছিল ঢেঁকির। নতুন প্রজন্মের কাছে এটি অপরিচিত মনে হলেও এক সময় ঢেঁকি ছাড়া একদিনও কল্পনা করতে পারত না গ্রামের মানুষ। ভোর হতেই ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত হতো গৃহস্থ বাড়ির আঙিনা। বাড়ির গৃহিণীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দিন-রাত চলতো ধান, চাল, গম, জব, মসলাসহ চিড়া তৈরির কাজ। তবে আধুনিক যন্ত্রের এই যুগে এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না ঢেঁকি। সেই ধুপধাপ শব্দও তেমন শোনা যায় না।
অবশ্য ঈশ্বরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং পৌর এলাকার কিছু বাড়িতে এখনো কদর রয়েছে ঢেঁকির। এখনো সেগুলোতে কালোজিরা ধান ও বিভিন্ন ধরনের মসলাসহ সকাল-সন্ধ্যা চালের গুঁড়া তৈরি করে মজাদার পিঠা, পুলি বানানো হয়।
সত্তরোর্ধ্ব জুবেদা বেগম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগের কথা। ঘরে একমুঠো চাল নেই। ছেলে-মেয়েরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। খেত থেকে আধপাকা ধান কেটে, মাড়াই করে, তা সিদ্ধ করে ঢেঁকিতে চাল তৈরি করে ভাত রান্না করেছি। ততক্ষণে ছেলে-মেয়েরা ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। তাদের ঘুম ভাঙিয়ে গরম ভাতে পানি ঢেলে পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে খেতে দিয়েছি। এখন মেয়েদের এসব বললে ভাববে, রূপকথার গল্প শোনাচ্ছি।’
উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে সরেজমিন দেখা যায়, এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি সযত্নে রেখেছেন তাঁরা। তবে কিছু কিছু ঢেঁকি দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। মেরামত করলে সেগুলো ফের ব্যবহার করা যাবে বলে জানান বাড়ির গৃহিণীরা।
৮০ বছর বয়সী হাছেনা বানু নামের এক বৃদ্ধা বলেন, ‘আমাদের সময়ে ঢেঁকি ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করা যেত না। সকাল-বিকেল ঢেঁকি থেকে ধান-চাল, গম, মসলা তৈরি ছিল নিত্যদিনের তালিকা। গৃহস্থ বাড়ির নারীরা সাত-আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়েও ঢেঁকি থেকে ধান-চাল, গম, মসলাসহ কষ্টসাধ্য চিড়াও তৈরি করত। তখনকার সময়ে অন্যতম অবলম্বন ছিল ঢেঁকি।’
নাজমা বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘আমাদের মা-চাচির মুখে শুনেছি, ঢেঁকি দিয়ে ধান-চাল তৈরি করা যে পরিমাণ কষ্টসাধ্য ছিল, আমাদের দ্বারা এগুলো সম্ভব না। এখন আধুনিক যুগে সবাই যন্ত্রনির্ভর। ঢেঁকির কথা কেউ চিন্তাও করে না। তবে হ্যাঁ ঢেঁকি ঘিরে বাঙালিদের যে ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’
মো. সাহেদ আলী নামে এক যুবক বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম শীতকাল আসতেই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নারীরা সারি সারি বসে ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করছে। পরে চালের গুঁড়া দিয়ে প্রতিটি ঘরে হরেক রকমের পিঠা-পুলি তৈরির ধুম পড়ে যেত। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।’