রাজনীতির আকাশের রং কি বদলাচ্ছে? কালো মেঘের আনাগোনা কি বাড়ছে? বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির মধ্যে একধরনের ঠান্ডা লড়াই অনেক দিন ধরেই চলছে। এখন কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এই ঠান্ডা লড়াই বুঝি গরম হাওয়ায় রূপ নিতে চলেছে। দুই দল বিভিন্ন ইস্যুতে বাহাস করছে। কেউ কাউকে সামান্য ছাড় দেওয়ার মনোভাব দেখাচ্ছে না। একে অপরের বিরুদ্ধে শব্দবোমা নিক্ষেপ করেই চলেছে। অবশ্য বিএনপির নিক্ষেপ করা শব্দবোমা আওয়ামী লীগ তেমন গায়ে মাখছে না। হয়তো এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ অথবা ভেজা, তাই বিস্ফোরণ ঘটছে না।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসের মধ্যে তারা এক দফা দাবি তথা সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। অক্টোবর মাস শুরু হয়েছে। সরকার পতনের মতো গণ-অভ্যুত্থান বা ওলট-পালট রাজনৈতিক হাওয়া বইতে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির হুংকার বা হুমকি-ধমকি সম্পর্কে এখন সাধারণ ধারণা এমন যে এই দলটির গর্জন আছে, বর্ষণ তেমন হয় না।
এই তো গত ২৪ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে ‘কেঁদেকেটে’ আবেগ ছড়িয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন আপনাদের কিছু করার থাকলে করেন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। অবিলম্বে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারলে বাঁচানো দুষ্কর হবে।
এ সময় সরকারকে আলটিমেটাম দিয়ে ফখরুল বলেন, ‘আমাদের নেত্রী জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, অন্যথায় এর সমস্ত দায়দায়িত্ব এই সরকারকেই নিতে হবে।’
৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হয়েছে, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নাকচ করে তাঁকে জেলে গিয়ে আবার আদালতে আবেদন করার কথা জানিয়েছে সরকার।
এ নিয়েও দুই দলের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। সরকারপক্ষ বলছে, আইন অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিএনপিকে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে যাওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। খালেদা জিয়া সেই শর্ত না মানায় তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিএনপিকে নির্বাচনে যাওয়ার শর্তের কথা নাকচ করেছে সরকার। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘বাজে কথা, ভুয়া কথা। এ ধরনের প্রস্তাবনা কেউ কাউকে দিয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। প্রধানমন্ত্রী আইনের বাইরে কোনো কথা বলেননি। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
লিভারের জটিলতা ছাড়াও ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ফুসফুস, কিডনি, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাঁকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালেই এখনো তিনি চিকিৎসাধীন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার বোনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আবেদন মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। রোববার খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নাকচ করে আইন মন্ত্রণালয় জানায়, বিদেশে যেতে হলে খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে আবার আদালতে আবেদন করতে হবে; কিন্তু বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের দাবি, সরকার চাইলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারে।
সরকার কেন এটা চাইবে, সে প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে আসছে। বিএনপি বা খালেদা জিয়ার সরকারের মিত্রপক্ষ নয়। তা ছাড়া দুটি দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে জেলে যাওয়ার পর থেকেই খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও চিকিৎসা নিয়ে বিএনপি কম রাজনীতি করেনি। একাধিক বার বলা হয়েছে যে খালেদা জিয়ার অবস্থা সংকটাপন্ন। বিদেশে না নিলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন না। বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় না নিলেও সরকারের নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে জেলের বাইরে, অর্থাৎ বাসায় থেকে চিকিৎসার সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়েছে। এটা সরকারের একধরনের উদারতা বৈকি!
এখন যদি খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে হয়, তাহলে সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা না করে কি সেটা সম্ভব? আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে অহিনকুল সম্পর্ক, তাতে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে মানবিকতা দেখাতে বললে নিজেদেরও তো কিছুটা মানবিকতা দেখানো উচিত নয় কি? সম্পর্ক বা সদ্ভাব বিষয়টি তো ওয়ান ওয়ে ট্রাফিকের মতো নয়। দুই পক্ষেরই নমনীয়তা থাকতে হয়, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হয়। বিএনপি সরকার বা আওয়ামী লীগের কাছে নমনীয়তা ও মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করে, কিন্তু নিজেরা থাকবে অনমনীয়।
বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধ বা দখলদার সরকার বলছে। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার নীতি নিয়েছে। সরকার পতনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। বলা হচ্ছে, অক্টোবর মাসের মধ্যেই নাকি সরকারের পতন ঘটবে। এমনও বলা হচ্ছে, সরকারদলীয় লোকদের দেশছাড়া করা হবে, তারা নাকি পালানোর পথও পাবে না।
সত্যি কি আওয়ামী লীগ সরকার একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন? এই সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই?
দেশের রাজনীতিতে এখন চলছে চরমভাবে নীতিহীনতার চর্চা। এ অবস্থায় ‘নীতিকথা’ বলে বা নীতিগত অবস্থানের দোহাই দিয়ে কোনো পক্ষই সুবিধা নিতে পারবে বলে মনে হয় না। বিএনপি যদি দলীয় নেত্রীকে সত্যি শ্রদ্ধা করে, তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে, তাহলে সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় না এসে উপায় কী? বিএনপির এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন যদি সরকারপক্ষ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি সম্পৃক্ত করতে চায়, তাহলে খুব দোষ দেওয়া যাবে কি?
এবার আসা যাক, বিএনপির গণ-অভ্যুত্থান বা সরকার পতনের আন্দোলন প্রসঙ্গে। এর আগে বহুবার বিএনপি দিন-তারিখ দিয়েছে কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এটা মনে রাখতে হবে, গণ-অভ্যুত্থান কখনো দিন-তারিখ দিয়ে হয় না। হয় না কোনো নেতা বা দলের ডাকেও। মানুষের ভেতরে তীব্র ঘৃণা, রাগ, অসন্তোষ, আক্রোশ জমা না হলে জীবনপণ করে কেন সরকারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে? আওয়ামী লীগ সরকার যতই অজনপ্রিয় হোক না কেন, মনে রাখতে হবে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই আওয়ামী লীগের সমর্থক আছে। যদি আওয়ামী লীগের সমর্থক না-ও থাকে, তাহলে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ভালোবাসার মানুষ। তা ছাড়া শাসক হিসেবে শেখ হাসিনার চেয়ে অন্য কোনো নেতাকে বোধ হয় দেশের মানুষ এখনো এগিয়ে রাখছে না।
এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়ে যাবে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়? দলীয় জাগরণ হতে পারে, সভা-সমাবেশ বড় হতে পারে, দলীয় কর্মীরা চাঙা হতে পারে এবং তা হয়তো হচ্ছেও। কিন্তু বিএনপি তো এটাকেও কাজে লাগাতে পারছে না। মানুষকে নির্বাচনমুখী না করে মারমুখী করে তোলা কোনো গণতান্ত্রিক দলের কাম্য হতে পারে না। এক দফা আদায় না করে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না, এটা তো পরাজয়ের দিকে টানবে। পরিণতিতে তৈরি হবে হতাশা।
গণ-অভ্যুত্থানের খোয়াব না দেখে নীরব ভোটবিপ্লবের কৌশলে যাওয়াই বোধ হয় ভালো পথ। কারণ ভোট ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার গণতান্ত্রিক কোনো উপায় নেই। আর শেষ বিচারে ভোট কিন্তু দেবে ব্যক্তি নিজে। তার চাওয়া, পাওয়া, আশা, ভয়, এত দিনের দুর্বিনীত আচরণ—সবকিছুই তার ছাপের মধ্যে পড়বে। বাইডেন বা হাস কিংবা মোদি বা মিলার এসে ভোট দিয়ে যাবেন না। নিজেকেই সেই কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে হবে।
কেউ কেউ মনে করছেন, দেশের রাজনীতির বড় দুই পক্ষের কেউই দেয়ালের লেখা পড়েন না। দীর্ঘদিন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদেরও আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। দেশ থেকে অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটপাটকারী ও সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম যারা বাড়ায়, তারাই যদি আবারও সামনে এসে দাঁড়ায়, নীরব ভোটবিপ্লব হয়ে যাবে। তাই গলা কাঁপানো জাঁদরেল নেতা বা হুংকার দেওয়া নিপীড়নকারী স্থানীয় নেতাদেরও কিছুটা দূরে সরিয়ে দিতে হবে। এটা করতে গেলেও হয়তো কিছু ষড়যন্ত্র হবে, বিদ্রোহ হবে। সেটাও মোকাবিলা করতে হবে। কারও জন্যই পথ খুব মসৃণ নয়।
খুব সতর্কভাবে না এগোলে কয়েক দশকের বিশাল সব অর্জন, সব সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যাবে।
শেষ আরেকটি কথা, রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে টিভি চলে, এসি চলে কিন্তু রিমোটে আন্দোলন বা নির্বাচন চলে না। এর সঙ্গে মানুষ যুক্ত, তার জীবন যুক্ত, তার মন-মানসিকতা যুক্ত। সেটা কি আর রিমোটে হয়?