অন্যের দোকান ভেঙে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নিজেই নালা ও ফুটপাতের ওপর দোকানপাট তুলেছে। এসব দোকানঘর নির্মাণে পরিবেশ আইন না মেনে কাটা হয়েছে অনেক বছরের পুরোনো অন্তত ২০টি গাছ। আরও অন্তত ১৫টি গাছ কাটা হতে পারে বলে জানা গেছে। ফুটপাতে রাখা হয়নি পথচারীদের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও। কোনো কোনো নালায় পানি যাওয়ার ন্যূনতম জায়গাও অবশিষ্ট রাখা হয়নি।
এদিকে দোকান বরাদ্দেও রয়েছে গরমিল। অভিযোগ উঠেছে, ভ্রাম্যমাণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হলেও বরাদ্দ পাচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাসহ প্রভাবশালীরা। এসব প্রভাবশালীদের একেকজনের নামেই বরাদ্দ হচ্ছে ৫-৬টি করে দোকান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, দোকানগুলো সাবেক প্রশাসকের আমলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কোথাও ফুটপাত কিংবা ভূসম্পত্তি তিনি বরাদ্দ দেননি।
তবে চট্টগ্রাম সিটির সাবেক প্রশাসক ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি প্রশাসক থাকাকালে ফুটপাতের ওপর দোকানপাট বসানোর জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। এসব যারা বলছেন, তাঁরা মিথ্যাচার করছেন। তিনি বলেন, ‘দোকানপাট নির্মাণ করে ফুটপাত তো রাস্তায় নিয়ে আসা হয়েছে। এটা নিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নালার ওপর নির্মিত দোকানপাটগুলো অপসারণের জন্য দোকান-মালিকদের আমি চিঠি দিয়ে বলে এসেছিলাম। এটা এখনো কেন সরানো হয়নি তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’ দোকান বরাদ্দের বিষয়ে তাঁর দাবি, ‘চট্টগ্রাম সিটির উচ্ছেদ অভিযানের সময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল, সেই তালিকা অনুযায়ী দোকানগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে গত রোববার চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদের টেক্সটাইল গেট, শেরশাহ কলোনি ও তারা গেট ঘুরে দেখা যায়, দোকানপাট নির্মাণের কাজ এখনো চলছে। টেক্সটাইল মোড়ে সড়কের পাশে নালা সংকুচিত করে ও ফুটপাতের পর্যাপ্ত জায়গা না রেখে সেখানে অন্তত ৬৬টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও আবার গাছের গা ঘেঁষেই দোকান তোলা হয়েছে। এর আগে দোকানের ভেতর গাছ রেখেই চারপাশে দেয়াল তোলা হয়। পরে গোপনে সেসব গাছ কেটে ফেলা হয়। এভাবে কাটা পড়েছে অন্তত ২০টি গাছ। স্থানীয়দের আশঙ্কা, যেসব গাছের গা ঘেঁষে দোকান তোলা হয়েছে, সেগুলোও কাটা পড়বে এক সময়। পাশের তারা গেটে রাস্তার দুই পাশে লাইন ধরে অন্তত ৯০টি পাকা দোকানঘর নির্মাণকাজ চলছে। এর এক পাশের লাইনে ফুটপাতের পুরোটিই দখল করে তাঁর ওপর দোকান নির্মাণ করা হয়েছে, দখল করা হয়েছে পাশ দিয়ে যাওয়া নালাও। সেখানকার একটি দোকানের মালিক মো. হারুন বলেছেন, ৭ অক্টোবর দোকানগুলো নির্মাণকাজ শুরু হয়। তিনি নিজেই একটি দোকান নির্মাণ করেছেন। কয়েক দিন আগে মেয়র দোকানগুলো পরিদর্শন করে গেছেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে মেয়রই দোকানগুলো উদ্বোধন করবেন।
দোকান বরাদ্দেও গরমিল
গত ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, টেক্সটাইল গেট, শেরশাহ ও তারা গেট ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এসব এলাকায় দোকানঘর নির্মিত হবে। ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রশাসকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখানে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে চিঠিতে জানানো হয়। এ সময় দোকান মালিকেরা তাঁদের নিজস্ব খরচে দোকান নির্মাণ করবেন। দোকানগুলো থেকে সিটি করপোরেশন ভাড়া আদায় করবে।
সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, টেক্সটাইল গেট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির ৬৬টি দোকান, তারাগেট ব্যবসায়ী সমিতির ৯০টি ও শেরশাহ রোড ব্যবসায়ী সমিতির নামে ১০০টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে এসব দোকানের সংখ্যা আরও বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এখানে দোকানপাট নির্মিত হলেও দোকানগুলো মালিক এখন প্রভাবশালীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, টেক্সটাইল গেটে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. নুরনবীর আগে একটি দোকান ছিল। এখন তাঁর নামে ছয়টি দোকান বরাদ্দ হয়েছে। একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল মাস্টারের নামে চারটি দোকান বরাদ্দ রয়েছে। শুক্কুর নামের এক ব্যক্তির নামে চারটি দোকান বরাদ্দ দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। যদিও আগে ওই এলাকায় তাঁর কোনো ব্যবসা ছিল না। এ ছাড়া স্থানীয় সি-ইউনিট আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিম উদ্দিনসহ যুবলীগের কয়েকজনের নামেও দোকান বরাদ্দ দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে আগে দোকান থাকলেও এখন বরাদ্দ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন।