রবীন্দ্রনাথ নৃত্য প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভার, আর তাকে চালন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবেগ; এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরমিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে, জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়ে; দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য।’
নৃত্যকলা বিষয়ে পড়ার যোগ্যতা
কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিট কর্তৃক প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষায় প্রদত্ত নম্বর/স্কোরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা আবেদন এবং ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে। ভর্তি পরীক্ষায় মেধাক্রম অনুযায়ী নৃত্যকলা বিভাগে ৫০ নম্বরের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত পরীক্ষার মেধাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা নৃত্যকলা বিভাগে ভর্তি হয়ে থাকে।
কোথায় পড়া যাবে
নৃত্যকলা বিভাগে দেশে তিনটি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে নৃত্যকলা বিভাগ চালু রয়েছে।
যেসব কোর্সে পড়ানো হয়
নৃত্যকলা একটি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন কোর্সে পড়ানো হয়। যেমন নৃত্যকলার ইতিহাস (তত্ত্বীয়), তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে যোগব্যায়াম, মণিপুরি, ভরতনাট্যম, কত্থক, তাল ও ছন্দ, নাট্যশাস্ত্র, লোকনৃত্য, রবীন্দ্রচর্চা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অঙ্গ রচনা ও রূপসজ্জা (ব্যবহারিক), ব্যালে নৃত্যের উদ্ভব ও বিকাশ (তত্ত্বীয়), ব্যালে নৃত্য (ব্যবহারিক), নন্দনতত্ত্ব, বিশ্বনৃত্য: (প্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য), আলোকসম্পাত (ব্যবহারিক), নৃত্য সৃজন (ব্যবহারিক), উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য: ওডিশি, মঞ্চ উপস্থাপনার পাণ্ডুলিপি, প্রস্তাবনা, মঞ্চ উপস্থাপনা। কোর্সগুলোর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নৃত্যকলাবিষয়ক তাত্ত্বিক জ্ঞান, ব্যাখ্যা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং ক্রমবিকাশ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করবে।
চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক, বিসিএসসহ দেশের সব সরকারি চাকরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগদান করা যাবে। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যান্ড কলেজে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক বিভিন্ন নৃত্যবিষয়ক পদসমূহে যোগদানের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়েও এখন নৃত্যবিষয়ক শিক্ষক নেওয়া হয়।
নৃত্যকে একটি ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ বলা হয়। এটি একটি গুরুমুখী বিদ্যা এবং একই সঙ্গে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যেমন নিজেকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তেমনি একজন নৃত্যবিষয়ক গবেষক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে মঞ্চ, টেলিভিশন এমনকি চলচ্চিত্রেও নৃত্যের উপস্থাপন পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষিত শিক্ষার্থীদের অনুপ্রবেশ এসব শাখাকে আরও সমৃদ্ধ করছে। সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠান নৃত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসছে। ফলে নৃত্যকলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পতাকাকে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে।
পড়ার খরচ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক/সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ অনেক কম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছরের স্নাতক কোর্সে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৫০ শতাংশ, মেয়ে ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জন্য ৩০ শতাংশ এবং ভালো ফল করলে ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ৪ বছরের স্নাতক কোর্সে প্রায় আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা
ইউরোপ, আমেরিকা, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নৃত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়। পাশাপাশি অন্যান্য দেশে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির সুযোগ রয়েছে। শুধু দেশে নয়, বাইরের দেশেও এর চাহিদা ব্যাপক। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, কত্থককেন্দ্র, দিল্লি; পাতিয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়, পাঞ্জাব; সায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসহ সারা বছরই এই বিষয়ে নানা বৃত্তি চালু রয়েছে।
অনুলিখন: আনিসুল ইসলাম নাঈম