বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকারখানা, আবাসনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং বেসরকারি খাতে এসব স্থাপনা নির্মাণের প্রভাব ফসলি জমির ওপরে পড়ছে। এতে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার কৃষিজমি পর্যায়ক্রমে কমছে।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত এক বছরে বিভাগে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে ফসলের আবাদ কমেছে। এর অন্যতম কারণ কৃষিজমিতে স্থাপনা নির্মাণ। এই অবস্থায় বরিশালে ফসলি জমি রক্ষা করে নগরায়ণ, শিল্পায়নের জন্য পরিকল্পিত নীতিমালা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী নাইমুর রহমান জানান, গত বছর রবি মৌসুমে বরিশাল বিভাগে ৭৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৪২ হেক্টর নিট আবাদি জমির মধ্যে ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৫৮ হেক্টর জমিতে ফসলের আবাদ হয়েছে। কিন্তু এ বছর রবি মৌসুমে বিভাগে ৭৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৪২ হেক্টর নিট আবাদি জমির মধ্যে ফসলের আবাদ হয়েছে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৯৫১ হেক্টর জমিতে। কৃষি অধিদপ্তর জানিয়েছে ফসলের এই আবাদ কমার অন্যতম কারণ ফসলি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ। সে অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে বরিশাল বিভাগে কৃষিজমি কমেছে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর। সূত্র জানায়, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে কৃষিজমিতে নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণের প্রবণতা বেড়েছে।
গত সপ্তাহে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন কর্নকাঠী গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ভোলা সড়কের দুই পাশে ধানিজমি ভরে প্লট তৈরি চলছে। শত শত একর জমিতে নানা ধরনের সাইনবোর্ড ঝুলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে খয়রাবাদ ব্রিজের দুই পাশেও এমন অনেক ফসলি জমি ভরাট করে তার প্লট করার উদ্যোগ নিয়েছেন মালিকেরা। ওই এলাকায় জমি বেচাকেনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল আমিন নামে এক ব্যক্তি জানান, ১০ বছর আগেও এখানকার জমির শতাংশ ছিল ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। এখন সেই জমির দাম ২-৩ লাখ টাকা। জমির মালিকেরা দেখেছেন, ধান চাষের চেয়ে বিক্রি করলে ১০ থেকে ২০ গুণ লাভ। একই অবস্থা নগরীর গড়িয়ারপাড় থেকে কাশিপুর পর্যন্ত। গড়িয়ারপাড়ের বাসিন্দা মনু ইসলাম জানান, তাঁদের এলাকায় প্রচুর ধান চাষ হতো। কিন্তু পদ্মা সেতু হওয়ার খবরে বিভিন্ন কোম্পানি জমি কিনে কারখানা করার উদ্যোগ নিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তওফিকুল আলম বলেন, ২ থেকে ৩ ফসিল কৃষিজমিতে শিল্প স্থাপনা না করার জন্য সরকারি বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু এখন এ অঞ্চলে যে যার মতো ঘরবাড়ি করছে। মহাসড়কের পাশে বিল্ডিং উঠেছে। সরকারিভাবে এ ক্ষেত্রে কার্যকর নীতিমালা নেই। এলোমেলোভাবে স্থাপনা করায় বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ফসলি জমি হুমকির মধ্যে পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হওয়ায় এখনই এ অঞ্চলে সুপরিকল্পিতভাবে জমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আক্তারুজ্জামান খান বলেন, এটা চিন্তার বিষয় যে এ অঞ্চলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন গড়ে উঠছে। কৃষিজমি রক্ষা করে উন্নয়ন এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু পদ্মা থেকে পায়রা পর্যন্ত ভবন, শিল্পকারখানা, হাউজিং হচ্ছে। কৃষিজমির এমন মারাত্মক ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে এখনই সরকারকে পরিকল্পনা ও ম্যাপিং করতে হবে। তিনি কৃষি ও পরিবেশ রক্ষা করে স্থাপনা করার ওপর তাগিদ দেন।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হারুন উর রশিদ বলেন, প্রতি বছর ১ ভাগ হারে কৃষিজমি কমছে। নিয়ম অনুযায়ী ফসলি জমিতে ইটের ভাটা, শিল্পকারখানা করা যাবে না। কিন্তু মানুষ প্রতিদিনই কৃষিজমি কমিয়ে ফেলছে। দেশের পলিসি মেকারদের এ অঞ্চলের কৃষি সেক্টর নিয়ে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশালের আঞ্চলিক কারিগরি অংশগ্রহণকারী নাহিদ বিন রফিক বলেন, পদ্মা সেতু হলে এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা, স্থাপনা বাড়বে। তবে কোন জমিতে কারখানা স্থাপনা করা যেতে পারে, সেটির নীতিমালা দরকার। সবচেয়ে কম ক্ষতি হোক, এমন ফসলি জমি ব্যবহার করার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন।