জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
বৈশাখের প্রথম দিনটি বাংলা নববর্ষ। আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় এদিন। বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব এটি। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকলে মিলিত হয় আলোকের এই ঝরনাধারায়। নববর্ষ তো ছিল ঋতুধর্মী উৎসব, কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভূস্বামী তথা জমিদার, তালুকদারদের খাজনা পরিশোধ করা হতো চৈত্র মাসের শেষ দিন। বৈশাখের প্রথম দিন নববর্ষে কৃষকদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। আয়োজিত হতো মেলা। ধীরে ধীরে উৎসবটি হয়ে উঠল পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাতে যুক্ত হলো নানা বৈচিত্র্যময় আয়োজন।
পুরোনো হিসাবের খাতার জায়গায় নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন গ্রাম-গঞ্জ-নগরের ব্যবসায়ীরা। নতুন-পুরোনো খদ্দেরদের তাঁরা জানাতেন নিমন্ত্রণ। এদিন একটু ভালো খাওয়াদাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হতো। নানা ধরনের পিঠা-পায়েসসহ লোকজ খাবারের আয়োজন হতো দৃশ্যমান। এখনো তা হয়। প্রিয়জনেরা উপহার পান, নববর্ষের শুভেচ্ছা হয় বিনিময়।
নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্পসহ কত কিছুই না রঙিন করে রাখে মেলা। আর লোকসংগীত? আর বাউলগান? আর মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালির সুর? পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গান? কত রকম মেলার যে দেখা মেলে নববর্ষের দিন, তা কি গুনে শেষ করা যাবে?
এখন ঐতিহ্যগতভাবেই সারা দেশ উন্মুখ হয়ে থাকে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের জন্য। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’—এই আগমনী গানের মাধ্যমে শুরু হয় এই উৎসব। বোমা মেরেও ষড়যন্ত্রকারীরা দমাতে পারেনি ঐতিহ্যবাহী আয়োজনকে। বরং এর পর থেকে আরও বেশি মানুষ শামিল হয়েছে তাতে। যাঁরা রমনা বটমূলে যেতে পারেন না, তাঁরা টেলিভিশনে অনুষ্ঠানটি দেখে মনের খিদে মিটিয়ে থাকেন।
পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে আবাহন করে উৎসব হয় পাহাড়ে—ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মনে রং লাগে এ সময়টিতে। বৈসাবীতে রঙিন হয়ে ওঠে পাহাড়।
বাংলা নববর্ষ পালন ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল পাকিস্তান আমলে। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে নববর্ষ ছড়িয়ে পড়েছিল জন থেকে জনে। সে সাংস্কৃতিক বোধই পরিচালিত করেছিল জাতিসত্তাকে। কিন্তু এখন কোনো কোনো মহল থেকে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সরাসরি বিরোধের মুখোমুখি করে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে। নববর্ষ এলেই উদ্ভট কিছু প্রশ্ন তোলে ফতোয়াবাজরা। একসময় ভুঁইফোড় একটি সংগঠন ফতোয়া দিয়েছিল যে বাংলা নববর্ষ অনৈসলামিক, এটা বন্ধ করতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিষয়ে এবার একজন উকিল নোটিশও দিয়েছেন। কে উৎসব পালন করবে, কে করবে না, সেটা তো ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এগুলো যে প্রকৃত অর্থে জাতিসত্তাকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল, সেটা বোঝা দরকার। আমাদের মনে পড়ে যাবে, একসময় শহীদ মিনারে আলপনা আঁকাকে, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণকেও অনৈসলামিক বলা হয়েছিল। ধোপে তা টেকেনি। নানাভাবে বাঙালি ও এই দেশে বসবাসকারী অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মানুষের ঐক্যে বিভাজন সৃষ্টির পাঁয়তারার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে ঋজু হয়ে। এবং তা করতে হবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বোধ থেকে, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা থেকে।
সর্বজনীন উৎসবগুলোই আমাদের শক্তি, বাংলাদেশের শক্তি, সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। বাংলা নতুন বছর রবীন্দ্রনাথের ভাষাকেই একটু পাল্টে নিয়ে জানিয়ে দিক—মুছে যাবে গ্লানি, ধুয়ে যাবে জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হবে ধরা।
শুভ নববর্ষ ১৪৩০, বাংলাদেশ।
বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা গ্রহণ করো পৃথিবী।