আজকের এই বক্তৃতা আসলে দীর্ঘ এক যাত্রা; যা সুদূর প্রদেশ এবং পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থিত বহু স্থান-কাল-পাত্রকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়েছে। ফলে পথ ক্রমেই চওড়া হয়েছে।
কিন্তু সে জন্য স্ক্যানডেনেভিয়ার নির্জন প্রকৃতি থেকে আমার রাস্তা কখনো আলাদা হয়ে যায়নি। আমরা, চিলির বাসিন্দারা, এতটাই গহনে বসবাস করি যে আমাদের সীমান্ত প্রায় ছুঁয়ে যায় দক্ষিণ মেরুকে। সুইডেনের অগ্রভাগ যেমন নাক গলিয়ে রেখেছে এই গ্রহের তুষারাবৃত উত্তর মেরুতে।
এই বিপুল বিস্তৃত স্বদেশের মাঝপথ দিয়ে চলার পথে আজ এমন বহু ঘটনা স্মরণে আসছে, যা এত দিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে ছিল।আর্জেন্টিনার কোলঘেঁষা আমাদের সীমান্তে পৌঁছাতে পেরোতে হয় আন্দিয়ান পর্বতমালা। যেখানকার গভীর অরণ্য রহস্যময় সব সুঁড়িপথের জন্ম দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের নিষিদ্ধ চলার পথ গোপন হয়েছে ক্রমেই।
যেখানে খুব পলকা কিছু চিহ্ন দেখে বুঝতে হয় এগোনোর পথ। স্পষ্ট কোনো পথনির্দেশিকা দেওয়া নেই। চারজন সঙ্গীকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে সেই কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি, পদে পদে পথরোধের আশঙ্কা নিয়ে হাজির হয়েছে পাহাড়শৃঙ্গ, গিরিখাত, সুবিশাল বৃক্ষ, স্রোতস্বিনী নদী, বরফের পুরু আস্তরণ।
পথে বারবার হোঁচট খেলেও নজর আমাদের সরেনি। কারণ, জানতাম এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ব্যক্তিগত মুক্তি, নিজের স্বাধীন যাপন।
সঙ্গীদের যদিও জানা ছিল এই দুর্গম অরণ্যানীর মধ্য দিয়ে কোন কায়দায় নিরাপদে পথ খুঁজে এগোতে হয়, তবু আত্মরক্ষার কথা খেয়াল রেখে তারা এগোনোর সময় গাছের ছালবাকলে ছুরির আঘাত করে এগোচ্ছিল, যাতে ফেরার সময় এক সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশিকা তৈরি হয়।আমাকে স্রেফ দৈবের হাতে ছেড়ে রেখে তারা সেই নিশানায় ভর করে যাতে ফিরে যেতে পারে একসময়।
সামনের পথ আচ্ছন্ন ছিল সবুজ এবং শ্বেত নির্জনতায়। যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত মাটির বিবিধ স্তরবিন্যাস বৃক্ষের ঋজুতা, আধভাঙা ডালপালার অবরোধ, অখণ্ড নির্জনতা—সব মিলিয়ে যতই এগোনো গেছে, ততই কঠিন হয়েছে চলা।
চিলির কবি পাবলো নেরুদা ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কার পান।