সাক্ষাৎকার

তিন অনিশ্চয়তা নিয়ে নতুন বছর শুরু হচ্ছে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি সার্ক পোভার্টি কমিশনের সদস্য এবং বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউএসএআইডি, জাইকাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পরামর্শক ছিলেন। সংস্কার কমিশন, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জন-আকাঙ্ক্ষার মূল্যায়ন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

প্রশ্ন: ২০২৪ সালের মধ্য সময়ে দেশে একটা বড় গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেল। এর পর থেকে বছরের শেষ পর্যায় ধরে ২০২৪ সালকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

হোসেন জিল্লুর: ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে স্বৈরশাসনের কাঠামোর ধারাবাহিকতা ছিল। তারপর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ফলে অভ্যুত্থানের পরে বিশাল পরিবর্তন এল।

এরপর অনেক নতুন আকাঙ্ক্ষা জন্মাল। নতুন করে বাংলাদেশকে একটা সুষ্ঠু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ধারায় ফিরিয়ে আনা এবং এসবকে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করানো—এগুলোই চ্যালেঞ্জ হিসেবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এল।

তবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই, ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বিশাল পটপরিবর্তন হয়েছে। এটাই হলো ২০২৪ সালের বড় পরিবর্তনের দিক। সেই পরিবর্তনের আবহের মধ্যেই আমরা আছি। কিন্তু যেহেতু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে, আর যেসব আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হয়েছে, সেই পথে আমরা কত দূর এগোতে পারলাম, এটাই হলো দ্বিতীয়ার্ধের মূল্যায়ন।

তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার, ২০২৩ সালেও কিন্তু একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার আবহ তৈরি হয়েছিল। সেটা ছিল প্রতিযোগিতাহীন যে নির্বাচন এবং মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের যে অধিকার নির্বাসনে গিয়েছিল, সেটাই ফিরিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষা ছিল মানুষের মধ্যে। ২০২৪ সালে সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আরও যুক্ত হলো বাংলাদেশের রাজনীতির সার্বিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।

২০২৪ সালে আকাঙ্ক্ষার মাত্রাটা বেড়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি। এর বাইরেও আকাঙ্ক্ষা নির্মিত হয়েছে। আমরা সার্বিকভাবে আমাদের ইতিহাসকে যেভাবে বুঝেছি, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক, সেখানে নাগরিকের সম্মান বা মর্যাদার জায়গা ছিল না। নেতা এবং রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা সাধারণ জনগণকে একটা অপমানের বাস্তবতার মধ্যে বেঁধে রেখেছিলেন। এগুলোর পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা কিন্তু তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন: এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?

হোসেন জিল্লুর: আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে, ছাত্ররা ক্রিয়াশীল আছে। তারা নানাভাবে তাদের বক্তব্য দিচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু সব পদক্ষেপ ও উদ্যোগের শেষে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, সেটা ২০২৫ সালের প্রথমে দাঁড়িয়ে খোঁজা দরকার।

পটপরিবর্তন হয়েছে, সেটাই বিরাট অর্জন। সেই অর্জনের পথে এগোবার পথে তিনটি অনিশ্চয়তা দেখছি, যেটা নিয়ে আমরা ২০২৫ সালে প্রবেশ করছি। এক. অর্থনৈতিক স্বস্তিটা এখনো আসেনি। কারণ, সাধারণ মানুষের জীবনে তো অর্থনৈতিক স্বস্তি দরকার। মূল্যস্ফীতি শুধু একটা দিক। দ্বিতীয় হলো, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। মানুষের পকেটে টাকা থাকতে হবে এবং নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হবে।

এসব ক্ষেত্রে বড় একটা ঘাটতি আছে। তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সূচকগুলোকে সন্তোষজনক জায়গায় আনা সম্ভব হলেও সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অর্থনৈতিক অস্বস্তিতা বড় একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। সেই অনিশ্চয়তা নিয়েই আমরা ২০২৫ সালে প্রবেশ করছি।

দুই. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি, সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটাধিকার প্রয়োগ যেন বাধাহীন হয় এবং পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় টাকার খেলা ও পেশিশক্তির দাপট যেন অনুপস্থিত থাকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কিছুটা অনিশ্চয়তা সেখানে আছে। অনিশ্চয়তা থাকাটা একটা বাস্তবতা। রাজনৈতিক রোডম্যাপ এবং রাজনীতির অপসংস্কৃতি অবসানের নিশ্চয়তাগুলো নিয়ে নতুন বছরে প্রবেশ করছি।

তিন. অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়েও কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে; বিশেষ করে অর্থনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা কিছুটা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাদের যেমন কিছু রুটিন কাজ থাকে, তেমনি সার্বিকভাবে জনগণের মধ্যে ঐক্যের জায়গা আছে; সেগুলোকে সংহত করা খুব জরুরি। আবার প্রশাসনিক জগতে কিছু বিশৃঙ্খলার আলামত দেখছি, যা তৈরি হয়েছে জনপ্রশাসনের সংস্কারসংক্রান্ত কিছু প্রস্তাব ঘিরে।

প্রশ্ন: দেশে ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। শুধু সংস্কারের প্রস্তাব পেশ হলেই কি ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জঞ্জাল পরিষ্কার করা সম্ভব হবে, নাকি প্রতিটি দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি?

হোসেন জিল্লুর: রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের উদ্যোগগুলো বিভিন্ন মহল থেকে আসতে হবে। আমার পর্যবেক্ষণ হলো, সংস্কার কমিশনগুলো কেতাবিভাবে হয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা খুব জরুরি ছিল। আমলাতান্ত্রিকভাবে নয়, খোলামেলাভাবে হলে ভালো হতো। কারণ, বিশ্বাসযোগ্যভাবে ঐকমত্য তৈরি করা দরকার।

কিছু কিছু জায়গায়; যেমন স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানিসহ নানা সেক্টর পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি কেন হয়? কারণ, বাইরের অযৌক্তিক চাপ আসে। চাপগুলো কোথা থেকে আসে? সেই চাপের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা দরকার এবং সেগুলোর সমাধানের পথ বের করা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দায়িত্ব হচ্ছে, তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জায়গাগুলো তারা ফ্যাসিলিটেট করবে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা যখন আমরা বলি, তখন সেটা তিনভাবে চিন্তা করতে হবে। এক. মানসিকতার পরিবর্তন; তা এক দিনে হয় না। কিন্তু সেটার জন্য একটা বড় ধরনের ধাক্কা দরকার। দুই. কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। শেখ হাসিনা সরকার যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করেছে, এটাতে সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে। এই পরিবর্তন তো কালকেই হতে পারে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এটার মাধ্যমে শুরু হতে পারে। তাহলে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রগুলো ভিন্নভাবে সাজানো যেতে পারে। আমরা যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা বলি, এটার দায় পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর, এরপর দায় হলো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এই যে আকাঙ্ক্ষা জনমনে সৃষ্টি হয়েছে, তারা তার প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল? তাদের মধ্যে যে দখলবাজি, মামলাবাজির যে প্রবণতা আছে মানুষকে হয়রানি করার জন্য—এসব নিয়ে তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে তারা কতটুকু নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে পারছে। তারপর নাগরিক সমাজের একধরনের বড় দায়িত্ব আছে। কারণ, জবাবদিহির জায়গাগুলো শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হবে না। একটা সজাগ, সক্রিয় নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর আরও শক্তিশালী করা দরকার।

প্রশ্ন: বিগত সরকারের দুর্নীতি, লুটপাটের কারণে বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা। এখনো অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলমান। শুধু বিদেশি ঋণ নিয়ে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে?

হোসেন জিল্লুর: উচ্চ মূল্যস্ফীতিটা শুধু বিগত সরকারের দুর্নীতির কারণে হয়নি। এটা অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং একধরনের অলিগার্কদেরকে পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণের সুবিধা করে দেওয়ার কারণে হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু ব্যাপার আছে। কেন এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা চলছে?

উচ্চ মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা সমাধানের জন্য বর্তমান সরকারও শুধু কিছু অর্থনীতির সামষ্টিক সূচককে কীভাবে ঠিক করা যায়, সেগুলো নিয়ে ভাবছে। মূল্যস্ফীতির দুটি দিক আছে—এক. মূল্যস্ফীতিটা কমানো; দুই. মানুষের আয়ের ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে অর্থনীতির চাকাটাও ঘোরাতে হবে।

এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের দুর্বলতা হলো, এদের ব্যবসায়ী শ্রেণির সঙ্গে যুক্ততার ব্যাপারটা কম। অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত বলা যায়। এটা হলো এই সরকারের বড় দুর্বলতা। সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা বেগবান করতে হবে; তবে দুটিই সমান্তরালভাবে। দ্বিতীয়টিতে কোনো ধরনের নজর নেই। আর সক্ষমতারও ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি।

প্রশ্ন: শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে একটা সাধারণ ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল। অভ্যুত্থানের পর সেখানে বিভেদ দেখা যাচ্ছে। মৌলিক বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্য কি আদৌ আশা করা যায়?

হোসেন জিল্লুর: বিগত সরকারের আমলে স্বৈরশাসনের সঙ্গে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল; সার্বিকভাবে মানুষকে নিয়ে একটা অপমানের অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল; ন্যায়বিচার, দক্ষতা, মেধা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। এরপর সেই শাসনব্যবস্থা যে বিতাড়িত হলো এবং সেটা যেন আবার ফিরে না আসে, সেই ঐকমত্য এখনো অব্যাহত আছে। মানে কী আর হওয়া উচিত নয়, সেই ঐকমত্য আছে।

আপনি যে ঐকমত্যকে বিভেদ বলছেন, আমি সেটাকে বলতে চাই ভিন্ন ভিন্ন মত। আমি বলতে চাই, কী হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া দরকার। এ বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আসছে। সেগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু একধরনের ভিন্নমত থাকলেও আলোচনার মধ্যে সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব—এই মতের আবহটা দুর্বল হয়ে গেছে। যেকোনো সমাজে ভিন্নমত থাকতে পারে; কিন্তু ভিন্নমতগুলোকে কীভাবে ম্যানেজ করা হচ্ছে, শোনা হচ্ছে, কীভাবে আস্থা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, আবার সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে—এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

২০২৫ সালের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, কোন পথে এগোতে হবে? কীভাবে অগ্রসর হব? এখন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলো ভিন্নমতকে একটা ঐক্যের সুরে নিয়ে আসা। একই সঙ্গে আস্থার জায়গাগুলো আরও জোরালো করা যে আমরা এটা করতে চাই। এসব জায়গায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

আর এখন এখানে তিনটি বলয়; যেমন অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক মহল এবং নাগরিক সমাজকে ক্রিয়াশীল হতে হবে। ঐকমত্যের জায়গায় কীভাবে অগ্রসর হতে হবে এবং সঠিকভাবে অগ্রসর হবে কি না, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তিন বলয়ের ওপর পড়ে।

প্রশ্ন: যাঁরা আন্দোলন করেছেন এবং যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাঁদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তাঁরা একাত্তরের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। আরও অভিযোগ হচ্ছে, তাঁরা প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে অবজ্ঞা করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে। এসব কিসের আলামত?

হোসেন জিল্লুর: আপনি কিছু ধারণার কথা বললেন। আমি এগুলোকে ফ্যাক্টস হিসেবে গ্রহণ করছি না। তাঁরা এক পক্ষকে পক্ষপাত দেখাচ্ছেন, সেটা তো দেখার বিষয়। সে জন্য তাঁদের বক্তব্যগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা দরকার, তাঁরা কী বলছেন? আর প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক শব্দগুলোই তো বিতর্কিত হয়ে গেছে। সেক্যুলার, প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা—এগুলোকে কি আমরা চূড়ান্তভাবে বিতর্কিত করিনি? বিগত স্বৈরশাসনের আমলের এই শব্দগুলোই এখন চরম বিতর্কিত হয়ে আছে। সুতরাং এই শব্দগুলো নিয়ে আলোচনার সময় অবশ্যই কী কারণে ও কীভাবে বিতর্কিত হয়ে গেছে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে সজাগ থাকা দরকার।

এই আন্দোলনে ছাত্রদের যে শক্তি বিরাট ভূমিকা পালন করেছে, তারা কোনো সাংগঠনিক শক্তি হিসেবে কাজ করেনি। এখানে স্মরণ রাখা দরকার, সার্বিকভাবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সবচেয়ে বড় একটা দিক ছিল এটার স্বতঃস্ফূর্ততা। নানা মহলের নানা মানুষের শুধু একটি জায়গায় ঐক্যের মিল ঘটেছিল, ওই অপমানকর স্বৈরশাসন আমরা আর চাই না। সেই জায়গায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক জায়গায় মিলিত হয়েছিল। আর সেখানে অকুতোভয় ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন।

কিন্তু এখন অগ্রসর হওয়ার পথে তাঁরা রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে চান। এসব তাঁরা অবশ্যই চাইতে পারেন এবং করতে পারেন। কিন্তু শেষবিচারে যে কেউ যেকোনো জায়গা থেকে আসুন না কেন, তাঁদেরকে জবাবদিহি করতে হবে সমাজের কাছে। মানে তাঁরা যা-ই বলুন এবং যে প্রস্তাব করুন, সেটার যদি সমাজের মধ্যে প্রতিধ্বনি ওঠে, ‘এটা ভালো এবং এরা ঠিক বলছে’; তাহলে সেটা জনগণের কাছে গৃহীত হবে। কারণ, সমাজের মানুষ তো সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসন সরিয়ে দিয়েছে। চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুই এখন আর চাপিয়ে দেওয়ার বাস্তবতায় নেই। শেখ হাসিনার পতন ও চলে যাওয়া থেকে যদি একটা শিক্ষা হয়, যেকোনো কিছু চাপিয়ে দিতে হলে কম বা বেশি সময়ের মধ্যে জনগণ সেটা গ্রহণ করবে না।

প্রশ্ন: দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা সিন্ডিকেটের দাপটের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রের চেয়ে কি সিন্ডিকেট বড়? সিন্ডিকেট মোকাবিলার পথ কী?

হোসেন জিল্লুর: অবশ্যই এখানে একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সিন্ডিকেট বা অলিগার্ক—যাদের কথাই বলি না কেন, তাদের প্রভাব বেশ জোরালোভাবে এখনো বাজারের মধ্যে চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের দাম কীভাবে বাড়ানো হলো, সেটা আমরা দেখেছি। সেখান থেকে উদাহরণ টেনে বলা যায়, সিন্ডিকেট বা অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দুর্বলতা হলো, তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এনগেজ হতে পারছে না। কারণ, এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ বা বাণিজ্য উপদেষ্টারা শুধু সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করলে হবে না; সিন্ডিকেট বা অলিগার্ক তো অল্পসংখ্যক। এ ছাড়া আরও অনেক গোষ্ঠী তো আছে। সাড়ে ১৫ বছর ধরে তারা অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়েছে। আমরা একবাক্যে পুরো ব্যক্তি খাতকে একটা কাঠগড়ায় দাঁড় করাব—এটা তো একটা বোকামির কাজ হবে।

অবশ্যই অলিগার্কদের অযৌক্তিক প্রভাব থেকে আলাদা করতে হবে। অর্থনীতির চাকা যাঁরা ঘোরাবেন, তাঁদের সঙ্গে তো আলোচনায় বসতে হবে। আমাদের কাছে বড় উদাহরণ হতে পারে শ্রীলঙ্কা। তারা আমাদের মতো অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা মূল্যস্ফীতিকে জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এটা এমন নয় যে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব।

এখানে ব্যক্তি খাতের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পথগুলো দুর্বল। সেটা তো একটা দৃশ্যমান ব্যর্থতা এই সরকারের। সরকারের আরও বেশি প্রোঅ্যাকটিভ হওয়ার বিষয় আছে। খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে অলিগার্কদের একটা প্রভাব আছে। এখন তাদেরকে বাদ দিয়ে অন্য ছোটদের এখানে যুক্ত করা যায়। তাদের কীভাবে মাঠে জোরালোভাবে জায়গা করে দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে কাজ করা দরকার। সমাধান পেতে হলে ওই খাতের লোকদের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই। শেষবিচারে মানুষ সমাধানটাই চায়।

আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

হোসেন জিল্লুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা factcheck@ajkerpatrika.com

রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি নেই: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

সহনীয় শুল্কহারে জ্বালানি খাতে ‘লাভজনক’ আঞ্চলিক বাণিজ্যের পথ দেখালেন জ্বালানি উপদেষ্টা

অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়া খুব কঠিন