সংস্কারের জন্য অনেকগুলো কমিশন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশনের কাজ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা
প্রশ্ন: কমিশনের কাজ নিয়ে কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কী পেয়েছেন?
আলী রীয়াজ: আমরা রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত পেয়েছি। অনেকে আমাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে সংগঠন হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে, ব্যক্তিগতভাবেই অনেকে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন।
এগুলোর মধ্যে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, যেগুলো আমরা বিবেচনা করব। আমরা এ মুহূর্তে আমাদের যেগুলো সুপারিশ, সেগুলো লিখছি। ফলে সবকিছু এখনো চূড়ান্ত নয়। আমি যেটা বলতে পারি, বেশ কিছু বিষয় অধিকাংশ অংশীজনের কাছ থেকে শুনতে পেয়েছি। আমাদের বিবেচনায় থাকবে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ যেন না ঘটে। গত ১৬ বছর যেটা দেখতে পেয়েছি, সেটা হচ্ছে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আসছে, তা হলো জবাবদিহির জায়গা তৈরি করা, যাতে করে প্রধানমন্ত্রী বলুন বা অন্য যেকোনো ব্যক্তি বলুন, যেন এমন ক্ষমতার অধিকারী না হন, তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্ন এসেছে, যেটা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ভারসাম্য করা। আমরা দেখেছি, আমাদের বিবেচনার মধ্যে আছে যে এই ভারসাম্য শুধু রাষ্ট্রপতির সঙ্গে না করে সংসদের মধ্যেও তৈরি করতে হবে। এটা একটা অগ্রাধিকারের বিষয়।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, নাগরিকের অধিকারগুলো সুনিশ্চিত করা। যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে নাগরিকের অধিকার লুণ্ঠিত না হয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হলে নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। তার পটভূমিকায় যেটা এসেছে, তা হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। আমরা সুস্পষ্টভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কিছু সুপারিশ তাদের দেব, যাতে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। যার মধ্যে অনেকে বলেছেন, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। আমরা সেটাও বিবেচনা করছি। ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারে আমরা অনেকের কাছ থেকে শুনেছি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ তৈরি করা। নাগরিকেরা চান এমন একটা গণতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে নাগরিকের অধিকার আছে, জবাবদিহি আছে এবং ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ নেই। এই জায়গাগুলো যেন নিশ্চিত করা হয়, সেটা আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি।
প্রশ্ন: অন্য দেশে দু-তিনটি মডেল থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোন সংসদ বিবেচনা করছেন?
আলী রীয়াজ: তিনটি মডেলের বাইরে গিয়েও বিবেচনা করা যায়। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু হয়, তাহলে রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিফলন ঘটাবে। যাতে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটার প্রতিফলন হয়। বিবেচনা করা দরকার, আমাদের বাস্তবতায় কি আমরা করতে পারব, যেটা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে। আমরা এটাও বিবেচনা করছি, এ ধরনের প্রস্তাব এসেছে যে উচ্চ কক্ষের ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তৈরি করা যায় কি না। এগুলো কিন্তু তিনটি মডেলের মধ্যে নেই। আমাদের কাছে চারটি মডেল আছে। আমরা সবগুলো বিবেচনা করে দেখছি। তার কিছু ইতিবাচক দিক আছে, কিছু নেতিবাচক দিক আছে। সর্বোপরি বাংলাদেশে আসলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট কখনোই চেষ্টা করা হয়নি। প্রস্তাব করেছেন কেউ কেউ, আগে কিন্তু সিরিয়াসলি নেওয়া হয়নি। এখন আমরা বিবেচনা করছি।
প্রশ্ন: একই ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, সেটা নিয়ে কী ভাবছেন?
আলী রীয়াজ: এটা আসলে সবার কাছ থেকে শুনতে পেয়েছি। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে, একাদিক্রমে নাকি যেকোনো সময়ে তিনি মাত্র দুবার হতে পারবেন। আমাদের যে গবেষকেরা আছেন, তাঁরা দেখছেন। আমরা নিজেরাও দেখছি, আসলে কোনটা আমাদের জন্য যথাযথ হবে। তবে এই যে দুই মেয়াদের বেশি না রাখা, সেটা সম্পর্কে একটা ঐকমত্য দেখতে পেয়েছি।
প্রশ্ন: সংবিধান পুনর্লিখন না সংস্কার?
আলী রীয়াজ: আমি যখন আগস্ট মাসের শেষে সংবিধান পুর্নলিখনের কথা বলি, সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার ও বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও সংগ্রামের পাঠ থেকে আমার ব্যক্তিগত মতামত। আপনি যদি আজকেও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করেন, আমি একই উত্তর দেব। কিন্তু একটা দায়িত্ব, আমি একা এই কাজে যুক্ত নই, ৯ ব্যক্তি আছেন। আরও বড় ব্যাপার হচ্ছে, স্টেকহোল্ডার আছেন। আমার একার মতের বিষয় না। ফলে আমাদের সবকিছু বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। কমিশন সবকিছু বিবেচনা করছে।
পুনর্লিখনের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। পুনর্লিখন শব্দকে বোঝার ক্ষেত্রে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধান দু-দুবার পুনর্লিখনের ইতিহাস তৈরি হয়েছে। পুনর্লিখন মানে হচ্ছে, আপনি যে মর্মবস্তু লিখতে যেয়ে পরিবর্তন করবেন, এটা ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে পুনর্লিখিত হয়েছে এবং পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়েও হয়েছে। পুনর্লিখনের ঘটনা অতীতে হয়েছে, কিন্তু যেটা হয়েছে নাগরিক অধিকার নিয়ে নেওয়ার জন্য।
আমি যেটা বলছি, এখন যে কাঠামো এবং ১৯৭২ সাল থেকে যে সংবিধান জারি আছে, সেই সংবিধান আসলে নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত করে। আমি এটা ১৯৮৩ সালে বলেছি, ১৯৯৩ সালে বলেছি। লিখিতভাবে বলেছি যে বাংলাদেশে সাংবিধানিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথ আছে।
আমরা সবকিছু বিবেচনা করছি। আমরা সুপারিশ করব। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে তারা আসলে কী পদ্ধতিতে যেতে চায়। আমাদের কাজ হচ্ছে কী বদলাতে হবে, সেটা বলা ও সুপারিশ করা। কী প্রক্রিয়া হবে, এটা রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবে।
প্রশ্ন: ১৯৭২-এর সংবিধান নিয়ে অনেক ধরনের সমালোচনা আছে। আপনারা কোন ধারাকে সমস্যা মনে করছেন আর সেটাকে কীভাবে সমাধান করবেন?
আলী রীয়াজ: দেখেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে, যেভাবে সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল, তার প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন আছে। সেটা ১৯৭২ সাল থেকে এখনো জারি আছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের যেসব পথ-পদ্ধতি করা হয়েছে, সেগুলো আপনি যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন, এর অনেক জায়গায় একটা বড় রকমের ব্যত্যয় রয়েছে। নাগরিকদের যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে, এগুলো এত শর্তসাপেক্ষ বা ব্যক্তির সমাবেশের স্বাধীনতা, সেগুলো আসলে কোনো রকম স্বাধীনতাই রাখেনি।
এটা ১৯৭২ সাল থেকেই আছে। পরবর্তী সময়েও এটা টিকে আছে। এগুলো পরিবর্তনের জায়গা আছে। আমি অনুচ্ছেদ ধরে বলছি না—এই এই কারণে শুধু অনুচ্ছেদ ধরে বিবেচনা করার চেয়ে গুরুত্ব হচ্ছে, স্পিরিটের দিক দিয়ে সংবিধানের অবস্থানটা কোথায়। সেই জায়গায় আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ১৯৭২-এর সংবিধানের বিভিন্ন অংশ একটি আরেকটির সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত হয়েছে, যেমন ধরুন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, এমনভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আমরা দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্যে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর অভাবনীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর একাধারে একাধিক পদ ধারণ করার—তিনি দলের প্রধান, তিনি সংসদের প্রধান। এগুলো ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ। ১৯৭২-এর সংবিধান পথ খুলে দিয়েছে। সে জন্য আমরা বলছি, ১৯৭২-এর সংবিধান বিবেচনা করার চেয়ে আমরা আগে সব প্রক্রিয়া দেখি এখনকার বিদ্যমান সংবিধানসহ। আমরা পর্যালোচনা করেছি। আমাদের যে প্রতিবেদন, তার একটা অংশ পর্যালোচনা থাকবে।
প্রশ্ন: সংস্কার হওয়ার পরেও কি একক ব্যক্তির ক্ষমতা ধরে রাখার পথ থাকবে?
আলী রীয়াজ: যদি আমরা যথাযথভাবে সংবিধান সংস্কার করতে পারি, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে সংবিধানের যেসব পথ ব্যক্তিতান্ত্রিক বা একনায়কের পথ যদি রুদ্ধ করতে পারেন, তাহলে আরেকজন শেখ হাসিনা তৈরি হওয়ার, আরেকজন স্বৈরশাসক তৈরি হওয়ার পথ বন্ধ করতে পারেন। এটাও আপনাকে মনে রাখতে হবে, শুধু সংবিধানে লিখে আপনি স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধ করতে পারবেন না। এটা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার সুবাদে বলি, স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধ করতে হলে দুটি দিক দেখতে হবে। একটা হলো, প্রাতিষ্ঠানিক দিক, ক্ষমতায় যত ভারসাম্য থাকে, জবাবদিহি থাকে। আরেকটা জায়গা হচ্ছে, আদর্শিক জায়গা। ওটা রাজনৈতিক লড়াই। সেটাও থাকতে হবে।
প্রশ্ন: সংস্কার প্রস্তাব কোনভাবে বাস্তবায়িত হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ঐকমত্য না থাকে সে ক্ষেত্রে গণভোট হয়, তাহলে চ্যালেঞ্জগুলো কী ও সমাধান কী?
আলী রীয়াজ: আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সুপারিশ করা। আপনি যদি দুই ভাগে ভাগ করেন, এই সংস্কারের একটা হচ্ছে ‘কী’ আরেকটা হচ্ছে ‘কীভাবে’। আসলে কী সংস্কার করতে চান আর কীভাবে সংস্কার করতে চান। কীভাবে সংস্কার হবে, সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এই অর্থে, এটা অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে। সেই বিবেচনায় এটা কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা বলব না। এটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে। সেটার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে।
প্রশ্ন: অধ্যাদেশ আকারে সংস্কার করা হবে কি না?
আলী রীয়াজ: আরেকটা বিষয় হচ্ছে অধ্যাদেশের। অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন জিনিস করা যায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি-আপনি-আমরা সবাই যে পরিস্থিতিতে বিবেচনা করছি, এর আগে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে, যেটা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সেটা হচ্ছে, একটা বিশাল অভ্যুত্থান ঘটেছে এই দেশে। সরকারের বৈধতা, যেমন এই সরকারের বড় বৈধতা হচ্ছে নৈতিক। আর সেটা যুক্ত আছে অভ্যুত্থানের সঙ্গে। গণ-অভ্যুত্থান নতুন ডায়নামিকস তৈরি করেছি আর সেই ডায়নামিকসের মধ্যে নতুন অনেক কিছু করা সম্ভব। আমাদের সব সময় যে প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চিন্তা করতে হবে, আমি তা মনে করছি না। তার অর্থ এই নয় যে অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংস্কার করার কথা বলছি। আমি বলছি যে অতীতে যেমন হয়েছে, তেমনই হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
আপনি একটা নতুন বাস্তবতার মধ্যে আছেন। সংস্কারের যেকোনো বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বাংলাদেশের গভর্ন্যান্সের প্রশ্নে, শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে শুধু নয়, সুস্পষ্ট প্রস্তাবের দিক থেকেও আসলে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে অনেক বেশি ঐকমত্য আছে। আমরা মতপার্থক্যগুলোকে বেশ গুরুত্ব দিই, ঐকমত্যের জায়গাগুলোতে আমরা গুরুত্ব দিই না।
এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সুশীল সমাজ বলুন, ব্যক্তি বলুন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলুন, তরুণ নেতৃত্ব বলুন আর রাজনৈতিক দল বলুন; আমি কিন্তু অনেক বিষয়ে ঐকমত্য দেখতে পাই। তাদের প্রস্তাব শুনেছি, কথা বলেছি, আমাদের ওয়েবসাইটে যেসব মন্তব্য এসেছে, সেগুলোর বড় অংশ দেখেছি, জরিপের ফলাফল এসেছে। ফলে ঐকমত্যের জায়গা আছে। এ প্রক্রিয়ার হতাশার দিক না দেখে আসুন আমরা আশাবাদী হই। আশাবাদী হই এ কারণে যে বাংলাদেশের মানুষ পেরেছে। ১৫ বছরের চেপে বসা স্বৈরতন্ত্রকে মোকাবিলা করেছে, প্রাণ দিয়েছে, তারা অর্জন করেছে। অতীতেও বাংলাদেশের মানুষ করেছে। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের কথা খেয়াল করুন, মুক্তিযুদ্ধের কথা খেয়াল করুন, বাংলাদেশের মানুষ পারে।
প্রশ্ন: গণভোটের বিষয়ে কী হবে?
আলী রীয়াজ: এ প্রক্রিয়া আসলে ওই আলোচনায় সিদ্ধান্ত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হবে কীভাবে। কীভাবে হবে, এটা ওনারা বের করুক। কী করতে হবে, এটা আমরা করতে চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কী করতে হবে। সবগুলো সংস্কার কমিশন তা-ই করবে।
প্রশ্ন: কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে?
আলী রীয়াজ: ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেকোনো সময় চ্যালেঞ্জ থাকবে। একটা গণতান্ত্রিক পথে ভিন্নমত থাকার কথা। আমরা তো উত্তর কোরিয়াতে বাস করি না। ফলে আমাদের ওই জায়গাটা দেখতে হবে। বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ থাকবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জিনিস তাই না? এখানে নিশ্চিত কিছু না। দেশ চালাবেন রাজনীতিবিদেরা, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে। তাঁরা কখনো কখনো নির্বাচনের জন্য ম্যান্ডেট পান। এটাই রাজনীতি। তাই তাঁরা সবাই মিলে একমত হতে পারলে অসম্ভব কী?
প্রশ্ন: ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ এই টার্ম সংবিধানে নেই। তাহলে এটা কী নামে আসবে?
আলী রীয়াজ: এখানে কোনো কনফ্লিক্টের কারণ নেই। এক হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার একটা কারণ আছে। এটা সংবিধানে ফিরে আসবে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এই সরকারের ভিত্তিটা কোথায়? সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট রেফারেন্স নেওয়া হয়েছে। তাই এর কোনো আইনি-সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এটার নৈতিক বৈধতা। সেটা হচ্ছে, একটা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। ফলে এটা একটা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আপনাকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। আমরা সেভাবেই বিবেচনা করব। এটার বৈধতার জায়গাটা সেভাবে। সংবিধানের শুধু পঞ্চদশ সংশোধনী ঘটেনি, আমাদের যখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তখন বলা হয়েছে, পর্যালোচনা করা। ৫২ বছর ধরে এই সংবিধানের বিভিন্ন ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষ করা গেছে। শুধু পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করলে সংশোধন হবে না।
প্রশ্ন: ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কী করবেন?
আলী রীয়াজ: ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে একটা আলোচনা আছে। এটা আসলে সংসদ সদস্যদের পায়ে বেড়ি লাগিয়ে দেয়। তাঁরা দল ও ব্যক্তির অনুগত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে বের করার বিষয়ে কোনো রকম দ্বিধা আমি রাজনৈতিক সংগঠনের কাছ থেকে দেখতে পাইনি। কোনো সুশীল সমাজ থেকেও দেখতে পাইনি, সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও পাইনি। তাহলে এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা পরিবর্তনের সুপারিশ করব। যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমাদের বিবেচনায় আছে।
প্রশ্ন: নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা থাকবে কি না?
আলী রীয়াজ: নির্বাচনকালে একটি নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে সবাই একমত। তিনটি কথিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষ তো দেখেছে। এগুলো নির্বাচন হয়নি; বরং আগের নির্বাচন ভালো হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়। ফলে নির্বাচনকালে নির্দলীয় একটা সরকার প্রতিষ্ঠায় কোনো ভিন্নমত নেই।
প্রশ্ন: কমিশনের কাজ নিয়ে কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কী পেয়েছেন?
আলী রীয়াজ: আমরা রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত পেয়েছি। অনেকে আমাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে সংগঠন হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে, ব্যক্তিগতভাবেই অনেকে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন।
এগুলোর মধ্যে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, যেগুলো আমরা বিবেচনা করব। আমরা এ মুহূর্তে আমাদের যেগুলো সুপারিশ, সেগুলো লিখছি। ফলে সবকিছু এখনো চূড়ান্ত নয়। আমি যেটা বলতে পারি, বেশ কিছু বিষয় অধিকাংশ অংশীজনের কাছ থেকে শুনতে পেয়েছি। আমাদের বিবেচনায় থাকবে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ যেন না ঘটে। গত ১৬ বছর যেটা দেখতে পেয়েছি, সেটা হচ্ছে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আসছে, তা হলো জবাবদিহির জায়গা তৈরি করা, যাতে করে প্রধানমন্ত্রী বলুন বা অন্য যেকোনো ব্যক্তি বলুন, যেন এমন ক্ষমতার অধিকারী না হন, তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্ন এসেছে, যেটা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ভারসাম্য করা। আমরা দেখেছি, আমাদের বিবেচনার মধ্যে আছে যে এই ভারসাম্য শুধু রাষ্ট্রপতির সঙ্গে না করে সংসদের মধ্যেও তৈরি করতে হবে। এটা একটা অগ্রাধিকারের বিষয়।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, নাগরিকের অধিকারগুলো সুনিশ্চিত করা। যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে নাগরিকের অধিকার লুণ্ঠিত না হয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হলে নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। তার পটভূমিকায় যেটা এসেছে, তা হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। আমরা সুস্পষ্টভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কিছু সুপারিশ তাদের দেব, যাতে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। যার মধ্যে অনেকে বলেছেন, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। আমরা সেটাও বিবেচনা করছি। ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারে আমরা অনেকের কাছ থেকে শুনেছি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ তৈরি করা। নাগরিকেরা চান এমন একটা গণতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে নাগরিকের অধিকার আছে, জবাবদিহি আছে এবং ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ নেই। এই জায়গাগুলো যেন নিশ্চিত করা হয়, সেটা আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি।
প্রশ্ন: অন্য দেশে দু-তিনটি মডেল থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোন সংসদ বিবেচনা করছেন?
আলী রীয়াজ: তিনটি মডেলের বাইরে গিয়েও বিবেচনা করা যায়। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু হয়, তাহলে রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিফলন ঘটাবে। যাতে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটার প্রতিফলন হয়। বিবেচনা করা দরকার, আমাদের বাস্তবতায় কি আমরা করতে পারব, যেটা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে। আমরা এটাও বিবেচনা করছি, এ ধরনের প্রস্তাব এসেছে যে উচ্চ কক্ষের ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তৈরি করা যায় কি না। এগুলো কিন্তু তিনটি মডেলের মধ্যে নেই। আমাদের কাছে চারটি মডেল আছে। আমরা সবগুলো বিবেচনা করে দেখছি। তার কিছু ইতিবাচক দিক আছে, কিছু নেতিবাচক দিক আছে। সর্বোপরি বাংলাদেশে আসলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট কখনোই চেষ্টা করা হয়নি। প্রস্তাব করেছেন কেউ কেউ, আগে কিন্তু সিরিয়াসলি নেওয়া হয়নি। এখন আমরা বিবেচনা করছি।
প্রশ্ন: একই ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, সেটা নিয়ে কী ভাবছেন?
আলী রীয়াজ: এটা আসলে সবার কাছ থেকে শুনতে পেয়েছি। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে, একাদিক্রমে নাকি যেকোনো সময়ে তিনি মাত্র দুবার হতে পারবেন। আমাদের যে গবেষকেরা আছেন, তাঁরা দেখছেন। আমরা নিজেরাও দেখছি, আসলে কোনটা আমাদের জন্য যথাযথ হবে। তবে এই যে দুই মেয়াদের বেশি না রাখা, সেটা সম্পর্কে একটা ঐকমত্য দেখতে পেয়েছি।
প্রশ্ন: সংবিধান পুনর্লিখন না সংস্কার?
আলী রীয়াজ: আমি যখন আগস্ট মাসের শেষে সংবিধান পুর্নলিখনের কথা বলি, সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার ও বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও সংগ্রামের পাঠ থেকে আমার ব্যক্তিগত মতামত। আপনি যদি আজকেও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করেন, আমি একই উত্তর দেব। কিন্তু একটা দায়িত্ব, আমি একা এই কাজে যুক্ত নই, ৯ ব্যক্তি আছেন। আরও বড় ব্যাপার হচ্ছে, স্টেকহোল্ডার আছেন। আমার একার মতের বিষয় না। ফলে আমাদের সবকিছু বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। কমিশন সবকিছু বিবেচনা করছে।
পুনর্লিখনের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। পুনর্লিখন শব্দকে বোঝার ক্ষেত্রে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধান দু-দুবার পুনর্লিখনের ইতিহাস তৈরি হয়েছে। পুনর্লিখন মানে হচ্ছে, আপনি যে মর্মবস্তু লিখতে যেয়ে পরিবর্তন করবেন, এটা ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে পুনর্লিখিত হয়েছে এবং পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়েও হয়েছে। পুনর্লিখনের ঘটনা অতীতে হয়েছে, কিন্তু যেটা হয়েছে নাগরিক অধিকার নিয়ে নেওয়ার জন্য।
আমি যেটা বলছি, এখন যে কাঠামো এবং ১৯৭২ সাল থেকে যে সংবিধান জারি আছে, সেই সংবিধান আসলে নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত করে। আমি এটা ১৯৮৩ সালে বলেছি, ১৯৯৩ সালে বলেছি। লিখিতভাবে বলেছি যে বাংলাদেশে সাংবিধানিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথ আছে।
আমরা সবকিছু বিবেচনা করছি। আমরা সুপারিশ করব। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে তারা আসলে কী পদ্ধতিতে যেতে চায়। আমাদের কাজ হচ্ছে কী বদলাতে হবে, সেটা বলা ও সুপারিশ করা। কী প্রক্রিয়া হবে, এটা রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবে।
প্রশ্ন: ১৯৭২-এর সংবিধান নিয়ে অনেক ধরনের সমালোচনা আছে। আপনারা কোন ধারাকে সমস্যা মনে করছেন আর সেটাকে কীভাবে সমাধান করবেন?
আলী রীয়াজ: দেখেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে, যেভাবে সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল, তার প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন আছে। সেটা ১৯৭২ সাল থেকে এখনো জারি আছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের যেসব পথ-পদ্ধতি করা হয়েছে, সেগুলো আপনি যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন, এর অনেক জায়গায় একটা বড় রকমের ব্যত্যয় রয়েছে। নাগরিকদের যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে, এগুলো এত শর্তসাপেক্ষ বা ব্যক্তির সমাবেশের স্বাধীনতা, সেগুলো আসলে কোনো রকম স্বাধীনতাই রাখেনি।
এটা ১৯৭২ সাল থেকেই আছে। পরবর্তী সময়েও এটা টিকে আছে। এগুলো পরিবর্তনের জায়গা আছে। আমি অনুচ্ছেদ ধরে বলছি না—এই এই কারণে শুধু অনুচ্ছেদ ধরে বিবেচনা করার চেয়ে গুরুত্ব হচ্ছে, স্পিরিটের দিক দিয়ে সংবিধানের অবস্থানটা কোথায়। সেই জায়গায় আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ১৯৭২-এর সংবিধানের বিভিন্ন অংশ একটি আরেকটির সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত হয়েছে, যেমন ধরুন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, এমনভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আমরা দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্যে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর অভাবনীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর একাধারে একাধিক পদ ধারণ করার—তিনি দলের প্রধান, তিনি সংসদের প্রধান। এগুলো ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ। ১৯৭২-এর সংবিধান পথ খুলে দিয়েছে। সে জন্য আমরা বলছি, ১৯৭২-এর সংবিধান বিবেচনা করার চেয়ে আমরা আগে সব প্রক্রিয়া দেখি এখনকার বিদ্যমান সংবিধানসহ। আমরা পর্যালোচনা করেছি। আমাদের যে প্রতিবেদন, তার একটা অংশ পর্যালোচনা থাকবে।
প্রশ্ন: সংস্কার হওয়ার পরেও কি একক ব্যক্তির ক্ষমতা ধরে রাখার পথ থাকবে?
আলী রীয়াজ: যদি আমরা যথাযথভাবে সংবিধান সংস্কার করতে পারি, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে সংবিধানের যেসব পথ ব্যক্তিতান্ত্রিক বা একনায়কের পথ যদি রুদ্ধ করতে পারেন, তাহলে আরেকজন শেখ হাসিনা তৈরি হওয়ার, আরেকজন স্বৈরশাসক তৈরি হওয়ার পথ বন্ধ করতে পারেন। এটাও আপনাকে মনে রাখতে হবে, শুধু সংবিধানে লিখে আপনি স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধ করতে পারবেন না। এটা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার সুবাদে বলি, স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধ করতে হলে দুটি দিক দেখতে হবে। একটা হলো, প্রাতিষ্ঠানিক দিক, ক্ষমতায় যত ভারসাম্য থাকে, জবাবদিহি থাকে। আরেকটা জায়গা হচ্ছে, আদর্শিক জায়গা। ওটা রাজনৈতিক লড়াই। সেটাও থাকতে হবে।
প্রশ্ন: সংস্কার প্রস্তাব কোনভাবে বাস্তবায়িত হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ঐকমত্য না থাকে সে ক্ষেত্রে গণভোট হয়, তাহলে চ্যালেঞ্জগুলো কী ও সমাধান কী?
আলী রীয়াজ: আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সুপারিশ করা। আপনি যদি দুই ভাগে ভাগ করেন, এই সংস্কারের একটা হচ্ছে ‘কী’ আরেকটা হচ্ছে ‘কীভাবে’। আসলে কী সংস্কার করতে চান আর কীভাবে সংস্কার করতে চান। কীভাবে সংস্কার হবে, সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এই অর্থে, এটা অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে। সেই বিবেচনায় এটা কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা বলব না। এটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে। সেটার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে।
প্রশ্ন: অধ্যাদেশ আকারে সংস্কার করা হবে কি না?
আলী রীয়াজ: আরেকটা বিষয় হচ্ছে অধ্যাদেশের। অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন জিনিস করা যায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি-আপনি-আমরা সবাই যে পরিস্থিতিতে বিবেচনা করছি, এর আগে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে, যেটা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সেটা হচ্ছে, একটা বিশাল অভ্যুত্থান ঘটেছে এই দেশে। সরকারের বৈধতা, যেমন এই সরকারের বড় বৈধতা হচ্ছে নৈতিক। আর সেটা যুক্ত আছে অভ্যুত্থানের সঙ্গে। গণ-অভ্যুত্থান নতুন ডায়নামিকস তৈরি করেছি আর সেই ডায়নামিকসের মধ্যে নতুন অনেক কিছু করা সম্ভব। আমাদের সব সময় যে প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চিন্তা করতে হবে, আমি তা মনে করছি না। তার অর্থ এই নয় যে অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংস্কার করার কথা বলছি। আমি বলছি যে অতীতে যেমন হয়েছে, তেমনই হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
আপনি একটা নতুন বাস্তবতার মধ্যে আছেন। সংস্কারের যেকোনো বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বাংলাদেশের গভর্ন্যান্সের প্রশ্নে, শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে শুধু নয়, সুস্পষ্ট প্রস্তাবের দিক থেকেও আসলে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে অনেক বেশি ঐকমত্য আছে। আমরা মতপার্থক্যগুলোকে বেশ গুরুত্ব দিই, ঐকমত্যের জায়গাগুলোতে আমরা গুরুত্ব দিই না।
এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সুশীল সমাজ বলুন, ব্যক্তি বলুন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলুন, তরুণ নেতৃত্ব বলুন আর রাজনৈতিক দল বলুন; আমি কিন্তু অনেক বিষয়ে ঐকমত্য দেখতে পাই। তাদের প্রস্তাব শুনেছি, কথা বলেছি, আমাদের ওয়েবসাইটে যেসব মন্তব্য এসেছে, সেগুলোর বড় অংশ দেখেছি, জরিপের ফলাফল এসেছে। ফলে ঐকমত্যের জায়গা আছে। এ প্রক্রিয়ার হতাশার দিক না দেখে আসুন আমরা আশাবাদী হই। আশাবাদী হই এ কারণে যে বাংলাদেশের মানুষ পেরেছে। ১৫ বছরের চেপে বসা স্বৈরতন্ত্রকে মোকাবিলা করেছে, প্রাণ দিয়েছে, তারা অর্জন করেছে। অতীতেও বাংলাদেশের মানুষ করেছে। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের কথা খেয়াল করুন, মুক্তিযুদ্ধের কথা খেয়াল করুন, বাংলাদেশের মানুষ পারে।
প্রশ্ন: গণভোটের বিষয়ে কী হবে?
আলী রীয়াজ: এ প্রক্রিয়া আসলে ওই আলোচনায় সিদ্ধান্ত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হবে কীভাবে। কীভাবে হবে, এটা ওনারা বের করুক। কী করতে হবে, এটা আমরা করতে চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কী করতে হবে। সবগুলো সংস্কার কমিশন তা-ই করবে।
প্রশ্ন: কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে?
আলী রীয়াজ: ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেকোনো সময় চ্যালেঞ্জ থাকবে। একটা গণতান্ত্রিক পথে ভিন্নমত থাকার কথা। আমরা তো উত্তর কোরিয়াতে বাস করি না। ফলে আমাদের ওই জায়গাটা দেখতে হবে। বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ থাকবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জিনিস তাই না? এখানে নিশ্চিত কিছু না। দেশ চালাবেন রাজনীতিবিদেরা, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে। তাঁরা কখনো কখনো নির্বাচনের জন্য ম্যান্ডেট পান। এটাই রাজনীতি। তাই তাঁরা সবাই মিলে একমত হতে পারলে অসম্ভব কী?
প্রশ্ন: ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ এই টার্ম সংবিধানে নেই। তাহলে এটা কী নামে আসবে?
আলী রীয়াজ: এখানে কোনো কনফ্লিক্টের কারণ নেই। এক হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার একটা কারণ আছে। এটা সংবিধানে ফিরে আসবে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এই সরকারের ভিত্তিটা কোথায়? সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট রেফারেন্স নেওয়া হয়েছে। তাই এর কোনো আইনি-সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এটার নৈতিক বৈধতা। সেটা হচ্ছে, একটা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। ফলে এটা একটা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আপনাকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। আমরা সেভাবেই বিবেচনা করব। এটার বৈধতার জায়গাটা সেভাবে। সংবিধানের শুধু পঞ্চদশ সংশোধনী ঘটেনি, আমাদের যখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তখন বলা হয়েছে, পর্যালোচনা করা। ৫২ বছর ধরে এই সংবিধানের বিভিন্ন ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষ করা গেছে। শুধু পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করলে সংশোধন হবে না।
প্রশ্ন: ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কী করবেন?
আলী রীয়াজ: ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে একটা আলোচনা আছে। এটা আসলে সংসদ সদস্যদের পায়ে বেড়ি লাগিয়ে দেয়। তাঁরা দল ও ব্যক্তির অনুগত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে বের করার বিষয়ে কোনো রকম দ্বিধা আমি রাজনৈতিক সংগঠনের কাছ থেকে দেখতে পাইনি। কোনো সুশীল সমাজ থেকেও দেখতে পাইনি, সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও পাইনি। তাহলে এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা পরিবর্তনের সুপারিশ করব। যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমাদের বিবেচনায় আছে।
প্রশ্ন: নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা থাকবে কি না?
আলী রীয়াজ: নির্বাচনকালে একটি নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে সবাই একমত। তিনটি কথিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষ তো দেখেছে। এগুলো নির্বাচন হয়নি; বরং আগের নির্বাচন ভালো হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়। ফলে নির্বাচনকালে নির্দলীয় একটা সরকার প্রতিষ্ঠায় কোনো ভিন্নমত নেই।
দুই দশক আগে মঞ্চনাটক দিয়ে অভিনয় শুরু করেছিলেন সিকদার মুকিত। ২০১৪ সাল থেকে অভিনয় করছেন টিভি নাটকে। অভিনয়কে ভালোবেসে অন্য কোনো পেশায় জড়াননি। এখনো নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
১০ ঘণ্টা আগেএক দেশ থেকে অন্য দেশে লোক ফেরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি রয়েছে। এ চুক্তির আওতায় কাউকে ফেরত চাইতেই পারে। তবে চুক্তিতে কিছু শর্ত আছে। চুক্তির আওতায় কাউকে নিতে হলে শর্তগুলো মেনেই হতে হয়।
১ দিন আগেসাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পেতে বাংলাদেশের অনুরোধ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে ভারত। এখন তারা পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করবে। এই পর্যালোচনার দুটি দিক আছে।
১ দিন আগেইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪