দেশে সড়কপথে বেশি দুর্ঘটনা হয় বলে অনেকেই নিরাপদ ভ্রমণের জন্য রেলযাত্রা বেছে নেয়। তাদের কাছে ট্রেনের ‘ঝক ঝক ঝক’ হয়তো মধুরও লাগে। কিন্তু সেই যাত্রা হঠাৎ হঠাৎ হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। এমনই এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটেছে গত সোমবার বিকেলে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে।
শেষ খবর থেকে জানা যায়, সেই দুর্ঘটনায় ১৭ জন মারা গেছে। বহু লোক হতাহত হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
আমাদের দেশে আগেও ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগই ঘটেছে সিগন্যালজনিত ত্রুটির কারণে। যেমন হিলিতে ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে পার্বতীপুরগামী লোকাল ট্রেনের সঙ্গে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষে দুটি ট্রেনের অর্ধশতাধিক যাত্রী নিহত হয়। আহত হয় দুই শতাধিক।
২০১০ সালে চট্টগ্রামগামী মহানগর গোধূলি ও ঢাকাগামী মেইল ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালকসহ ১২ জন নিহত হয়। ২০১৯ সালের ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বরমচাল রেলক্রসিং ও সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে খালে ছিটকে পড়লে ছয়জন নিহত হয়। একই বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত হয়। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই ঘটেছে ট্রেনের বাড়ি অর্থাৎ স্টেশনে কিংবা এর কাছাকাছি।
ভৈরবের ট্রেন দুর্ঘটনাও শুধু দুর্ঘটনা নয়। ওই দিন যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিকেলের দিকে ভৈরব স্টেশন থেকে ছাড়ার পর তখনো পুরোপুরি স্টেশন এলাকা অতিক্রম করতে পারেনি। কয়েকটি বগি ক্রসিং পয়েন্ট অতিক্রম করা বাকি ছিল। এর মধ্যেই আরেক লাইনে বিপরীত দিক থেকে একটি কনটেইনার ট্রেন ভৈরব স্টেশনে প্রবেশ করছিল। এর আগেই ক্রসিং পয়েন্টে প্রবেশ করে কনটেইনার ট্রেনটি। এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের দিকে কনটেইনার ট্রেনটি ধাক্কা দেয়। এতে কেঁপে ওঠে পুরো ট্রেন। শেষের দুটি বগি ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উল্টে দুমড়েমুচড়ে যায়।
কনটেইনারবাহী ট্রেনটি যে লাইনে ঢুকছিল, একই সময়, একই লাইন থেকে যাত্রীবাহী ট্রেনটি বেরোচ্ছিল, এটা কীভাবে সম্ভব? বোঝাই যাচ্ছে, সিগন্যাল অমান্য করে কনটেইনার ট্রেনটি স্টেশনে প্রবেশ করায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা যে অযোগ্য লোকের গাফিলতির কারণে হয়েছে, তা স্পষ্ট। ট্রেনের বাড়ি স্টেশনে সেই ট্রেন আর নিরাপদ রইল না।
বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবহেলার কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে আগেও। যদি স্টেশনের সিগন্যাল দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যথাযথভাবে তাঁর কাজটি করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
সাম্প্রতিক এই দুর্ঘটনা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—দক্ষ ও যোগ্য লোকের কোনো বিকল্প নেই। রেল কর্তৃপক্ষ যদি যোগ্য ব্যক্তিদের এসব দায়িত্বে নিয়োগ দিত এবং তাঁদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে অনেক দুর্ঘটনা রোধ করা যেত। সেই সঙ্গে সিগন্যালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি তাঁর কাজ ঠিকভাবে করছেন কি না, সেসবও তো তদারক করা প্রয়োজন।
সবকিছু নিয়মমাফিক থাকলে বারবার এত তাজা প্রাণ ঝরে যেত না। ‘ঝক ঝক ঝক’ সব সময় মধুরই থাকত, আতঙ্কের ধ্বনি হতো না। স্টেশনও নিরাপদ থাকত।