চীনের গুইলিনে গেলে দেখা পাবেন আশ্চর্য সুন্দর এক গুহার। এর ভেতরের চুনাপাথরে তৈরি নানা কাঠামো দেখে রীতিমতো চমকে উঠবেন। এগুলোর কোনো কোনোটা পৌরাণিক প্রাণীর অবয়বের, কোনোটা হয়তো সবজির মতো, কোনোটি ঝাড়বাতি কিংবা মাছের আদলের, এমনকি স্ট্যাচু অব লিবার্টির সঙ্গে মিল আছে এমন চুনাপাথরও আছে। রিড ফ্লুট কেভ নামের এই গুহাকে আবার আলোকিত করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন বাতি দিয়ে। সবকিছু মিলিয়ে জায়গাটি হয়ে উঠেছে পর্যটকদের খুব প্রিয় এক ভ্রমণ গন্তব্যে।
মজার ঘটনা, ১৯৪০-এর দশকে নতুন করে আবিষ্কৃত হলে হাজার বছর আগেও এখানে মানুষের আনাগোনা ছিল। আর গুহাটি কবে সৃষ্টি হয়েছে, এটা শুনলে চমকে উঠবেন—আনুমানিক ১৮ কোটি বছর আগে। গুহাটির দৈর্ঘ্য ২৪০ মিটার বা ৭৮৭ ফুট।
এখন বরং এর নাম রিড ফ্লুট কেভ কেন হলো, তা জানার চেষ্টা করি। গুহা এলাকার প্রবেশপথের কাছে বিপুল হারে জন্মেছে নলখাগড়া। এসব নলখাগড়া অনেক সময়ই স্থানীয় বাসিন্দারা নিয়ে যান বাঁশি ও ছোটখাটো বাদ্যযন্ত্র বানাতে। বুঝতেই পারছেন, এর থেকেই গুহাটির নাম হয়ে গেছে রিড ফ্লুট কেভ, অর্থাৎ নলখাগড়ার বাঁশির গুহা।
তবে এই নলখাগড়ার সন্ধান করতে গিয়েই গুহাটির খোঁজ মিলেছে, তা কিন্তু নয়। এটা নতুনভাবে আবিষ্কার করেন একদল শরণার্থী, যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাদের থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিলেন গুহাটিতে। তবে তাঁদের এই গুহা নিয়ে গবেষণা বা ভেতরের অন্ধি-সন্ধিতে অনুসন্ধানের সুযোগ ছিল না। পরে যারা গুহাটিতে ঢোকেন, তাঁরা এখানকার পাথরের দেয়ালে হাজার বছর আগের কালির লেখা আবিষ্কার করেন। গবেষকেরা জানান, এগুলো ৭৯২ সালে তাং রাজবংশের সময়কার। ওই সময় গুহায় আসা কবি-সাহিত্যিকদের রচিত কবিতা ও ভ্রমণকাহিনি এগুলো।
লাখ লাখ বছর ধরে নরম চুনাপাথরের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহের কারণে নানা ধরনের কাঠামোর সৃষ্টি হয়েছে গুহারাজ্যে। এগুলোর মধ্যে হয়েছে স্ট্যালেকলাইট (গুহার ছাদ থেকে ঝুলন্ত চুনাপাথরের স্তম্ভ), স্ট্যালাগমাইট (গুহার তল থেকে ওঠে যাওয়া চুনাপাথরের স্তম্ভ) এবং মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিভিন্ন পাথুরে স্তম্ভ।
রীতিমতো অদ্ভুত ধরনের দুটি স্ট্যালাগমাইট আছে। একটি স্নোম্যান বা তুষার মানবের মতো। মনে হবে প্রচণ্ড শীতে সে দুই হাত পকেটে পুরে রেখেছে। আরেকটি আবার গোলাকার স্তম্ভ আকারের পাইনগাছের মতো। দেখে মনে হবে এর শাখাগুলো ঢেকে আছে তুষার আর বরফের পুরু স্তরে।
গুহার ভেতরে সবচেয়ে চওড়া জায়গা ক্রিস্টাল প্যালেস। বিশাল একটি হলঘরের মতো এটি। চারদিক থেকেই ঝুলছে স্ট্যালেকটাইট। দেখে মনে হতে পারে একের পর এক ঝাড়বাতি ঝুলছে। এদিকে আলোর কারসাজিতে কোনো কোনো স্ট্যালাগমাইটকে মনে হয় লাফিয়ে ওঠা মাছ। ক্রিস্টাল প্যালেস ছেড়ে যাওয়ার পর ছোট কিছু সরু গলির দেখা মেলে।
গুহার বিভিন্ন পাথরের ফাটলে ও ফাঁকে নানা ধরনের বর্ণিল বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এগুলো এমনভাবে লুকানো থাকে যে পর্যটকেরা সহজে এর উপস্থিতি টের পান না। তবে গুহাময় ছড়িয়ে পড়ে নিয়নের মিষ্টি একটা আলো। নানা ধরনের আশ্চর্য পাথুরে কাঠামো এতে আলোকিত হয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের জন্ম দেয়। আর এই সবকিছু মিলিয়ে গুহাটি পরিণত হয়েছে এই অঞ্চলের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রে।
গুইলিন শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে নলখাগড়ার বাঁশির গুহার দূরত্ব কেবল পাঁচ কিলোমিটার। কাজেই একবার শহরটিতে পৌঁছাতে পারলে আধা দিন হাতে রাখলেই আশ্চর্য এই গুহারাজ্য ঘুরে আসা সম্ভব।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, এটলাস অবসকিউরা, ট্রাভেল চায়না গাইড, নেটিভ প্ল্যানেট ডট কম