তুরস্কে এরদোয়ান যুগের অবসান ঘটতে পারে

মারুফ ইসলাম
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৩, ১২: ৪১
আপডেট : ১৪ মে ২০২৩, ১৩: ৪৯

চলতি বছরটি বিশ্বজুড়েই নির্বাচনী বছর। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ বছর। নতুন রাষ্ট্রনেতা বেছে নিতে আজ রোববার তুরস্ক ও থাইল্যান্ডের মানুষ ভোট দিচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি এবং বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্র বিবেচনায় তুরস্ক প্রভাবশালী দেশ। বিশ বছর ধরে দেশটিতে ক্ষমতায় রয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দুই যুগের শাসনে দমন-পীড়নের নানা অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। তাই এই নির্বাচন ঘিরে গভীর দৃষ্টি রয়েছে পর্যবেক্ষকসহ আন্তর্জাতিক মহলের।

২০০২ সালে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, তারপর ২০১৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এরদোয়ান। এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি যেন ‘এরদোয়ান যুগ’ সৃষ্টি করেছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন রূপ দিয়েছেন। বারবার পরিবর্তন করেছেন তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল। তুরস্ককে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছেন এক নতুন তুরস্ক হিসেবে। নিজের ক্ষমতাও বাড়িয়েছেন নানাভাবে। নিজেকে তৈরি করেছেন প্রায় ‘অবিকল্প’ নেতা হিসেবে। 

তবু আজকের নির্বাচন তাঁর জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সারবেঁধে দাঁড়িয়েছে বিরোধী নেতা কামাল কিলিকদারোগ্লুর পেছনে। রিপাবলিকান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান কিলিকদারোগ্লুর জনপ্রিয়তা এরদোয়ানের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। প্রথম রাউন্ডের ভোটে তাঁর জয়ী হওয়ার ‘সম্ভাবনা প্রবল’ বলে নির্বাচন-পূর্ব জরিপগুলোতে উঠে এসেছে। 

তবে এরদোয়ানের প্রভাব যে মোটেই হেলাফেলা করার নয়, তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা। ২০০২ সালের নির্বাচনে তাঁর দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) বিপুল ভোট পেয়েছিল। তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চরিত্র হারাবে বলে ভয় তখনই ছিল, যা বাস্তবে ঘটেছেও। এরদোয়ান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তুরস্কের রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের আধিপত্য প্রবল হয়েছে। কর্তৃত্ববাদ, ভিন্নমত দমন ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চর্চাও নির্মমভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

এরদোয়ানের একনায়কসুলভ আচরণের প্রভাব পড়েছে তুরস্কের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরেও। ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই এরদোয়ান তাঁর বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন। তখন তিনি ‘প্রতিবেশীদের সঙ্গে শূন্য সমস্যা’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এতে তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ছে। একই সঙ্গে তিনি ইউরোপের সঙ্গেও সম্পর্ক সুদৃঢ় করেছেন। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার ফলে তুরস্কের বাহুবল বেড়েছে। 

রিপাবলিকান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান কিলিকদারোগ্লুওই নীতির ফলে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তাঁর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। এসব কারণে ‘প্রতিবেশীদের সঙ্গে শূন্য সমস্যা’ নীতি থেকে বের হয়ে সম্প্রতি ‘সমঝোতামূলক’ নীতি নিয়েছেন এরদোয়ান। ফলে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তাঁর বরফশীতল সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হয়েছে; সিরিয়া ও লিবিয়ার সঙ্গেও উত্তেজনা কমেছে। অন্যদিকে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছেন এরদোয়ান। এর মধ্য দিয়ে তিনি চেষ্টা করছেন পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলানোর। 

এরদোয়ান সব সময়ই চেষ্টা করেছেন পশ্চিম, ইউরোপ ও ন্যাটোর দিকে হেলে থাকতে। তাঁর পররাষ্ট্রনীতিও তৈরি করেছেন সেভাবে। কিলিকদারোগ্লুর যদি প্রেসিডেন্ট হয়েই যান, তিনি কেমন হবেন তা নিয়েই চলছে জল্পনা। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, তিনি আরও সমঝোতামূলক নীতি অবলম্বন করবেন। এতে পশ্চিমাদের সঙ্গে তুরস্কের দ্বন্দ্ব কমার সুযোগ তৈরি হবে। 

এর চেয়েও যে বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা, সেটি হচ্ছে, কিলিকদারোগ্লু ক্ষমতায় এলে তুরস্কে গণতন্ত্র প্রাণ পাবে। কারণ এরদোয়ান যুগে সবচেয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় গিয়েছে গণতন্ত্র। 

বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটার তুরস্কের ক্ষমতার পরিবর্তন চাইছেনকোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, এরদোয়ান গণতন্ত্রের এতটাই বারোটা বাজিয়েছেন যে, তিনি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চাইবেন। এ জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রের সব শক্তি ব্যবহার করতে কোনো ধরনের কার্পণ্য করবেন না। তার পরও কোনো কারণে যদি নির্বাচনে তিনি হেরেই যান, সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চাইবেন না। তখন তুরস্কের অভ্যন্তরে কী শুরু হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। অবশ্যম্ভাবীভাবে সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে রাজপথে, তা অবশ্য হলফ করে বলাই যায়। 

প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের নির্বাচনে এরদোয়ানের পরাজয়ের সম্ভাবনা আছে কি? বিশ্লেষকেরা বলছেন, আছে। কারণ বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটার তুরস্কের ক্ষমতার পরিবর্তন চাইছেন। 

তরুণদের এমন মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার দরপতন ও জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়া। এ ছাড়া গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে আসা ভূমিকম্প। গত ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ভূমিকম্প তুরস্কে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। গৃহহীন করেছে লাখ লাখ মানুষকে। সে সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এরদোয়ান সরকারের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক এলাকায় ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ চাপা পড়ে থাকলেও সময়মতো পৌঁছায়নি এরদোয়ানের উদ্ধারকর্মীরা। সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। এ ছাড়া ভূমিকম্পের পর কিছু এলাকায় ভবন নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসায় এরদোয়ানের সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। 

এই সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ ও তরুণ প্রজন্মের মনে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সীমাহীন ক্ষোভ জন্মেছে। 

তুরস্কে মুদ্রার দরপতন হয়েছে ব্যাপকএরদোয়ানের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হচ্ছে, তিনি বিচার বিভাগ ও অর্থনীতিকে একেবারে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে গিয়েছেন। গত দুই বছরে তিনজন গভর্নরকে বরখাস্ত করেছেন। ২০১৬ সালে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টা হয়েছিল। এরপর তিনি শক্তিশালী জেনারেলদের কোণঠাসা করেছেন। সেনাবাহিনীকে অকার্যকর করে রেখেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে চলা সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় এনেছেন। 

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এর আগে তুরস্কের যত সরকারপতন হয়েছে, তার জন্য মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট ছিল একমাত্র কারণ। এখনো তুরস্কে অর্থনৈতিক সংকট চরম। মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া। এই দুয়ে মিলে আজই হয়তো অবসান ঘটতে পারে এরদোয়ান যুগের। 

সূত্র: ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স রিভিউ, রয়টার্স ও মিডল ইস্ট আই

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত