অদিতি ফাল্গুনী
নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়। সূত্রাপুর-২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় বস্তি এলাকায় হরিদাসীর নিজেরই একটি ছোট চায়ের দোকানের মতো আছে। দোকান চালানো ছাড়াও সাদা থান পরা হরিদাসী অবসর সময়ে মাঝে মাঝেই মাটির ছোট ছোট চাড়া আগুনে পুড়িয়ে টুকরো ইটের মতো বানিয়ে, একটু দূরের কয়েক ঘর চামার বসতি থেকে মোটা সুই এনে সদ্য আগুনে পোড়া সেই চাড়াগুলো মালার মতো গাঁথে। কখনো সেই মালায় সে আরও যুক্ত করত নারকেলের আইচার টুকরা বা খেজুরের কাঁটা। ‘এই মালা—বুঝলি ছেমড়ি—অপজিশন, মানে বিরোধী পক্ষের গলায় ছুড়লে অপজিশন ঠান্ডা!’
এভাবে হরিদাসীর কাছ থেকেই শিখা মার্গারেট কস্টা প্রথম গুলতির মালা বানাতে শেখে। সূত্রাপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বলতে গেলে শিখারা মাত্র কয়েক ঘর খ্রিষ্টান আছে। খ্রিষ্টানও হয়েছে মাত্র তারা এক-দুই পুরুষ। বাকিটা তারাই সংখ্যায় ভারী, যারা শিখাদের পূর্বপুরুষ ছিল। সূত্রাপুর ছাড়ালে অবশ্য আবার মুসলমান বসতি শুরু।
‘শিখা! ঘুম দিয়া ওঠ। আইজ ফ্যাক্টরিত যাবি না?’
শিখা হাই তুলে ওঠে। মা গ্লাসে চা আর টোস্ট এনেছে। শিখার বয়স প্রায় কুড়ি। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েটরে একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে সে। এক গার্মেন্টসে ছিল দুই বছর, তারপর ব্যাটারি তৈরির একটি কারখানায় আরও দেড় বছর, লজেন্সের একটি কারখানায় দুই বছর, আবার এখন এই বিস্কুট তৈরির কারখানায় প্রায় এক বছর হতে চলল। বাবা-মাকে সবাই যদিও বলে যে শিখার বিয়ের কত দূর, তবু শিখা একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে বলে বিয়ের চাপ পাড়ায় উঠে উঠেও ওঠে না। যদিও শিখার বয়সী অধিকাংশ মেয়েই এই সূত্রাপুর, শাঁখারীবাজার, নারিন্দা, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, ওয়ারীসহ এন্তার পুরান ঢাকায় বিয়ে করে কমসে কম এক-দুটো বাচ্চার মা, শিখা দিব্যি একের পর এক কারখানায় কাজ নেয়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, তখন দু-তিন মাস বিয়ের কথা ওঠে, তারপর আবার কাজ পেলে বিয়ের কথা থিতিয়ে যায়। আর এ ছাড়া সবাই জানে যে শিখা একটু ‘ছিটেল’। ‘ছিটেল’ কেমন? যে মেয়ের নিজেরই বিয়ে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই, তাকে আলাদাভাবে কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে-ফিরতে বা হুট করে কোনো বাজে অবস্থায় কোনো ছেলের সঙ্গেই কারোর চোখে তেমন পড়েছে বলে তল্লাটের কেউই কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু আবার শিখার কিছু বদনামও আছে। শিখাকে প্রায়ই দেখা যায় শুধু এই কয়েক ঘর খ্রিষ্টানপাড়ার খ্রিষ্টান ছেলেই না, শাঁখারীবাজারের ছেলে থেকে শুরু করে মুসলমান বসতি যেখানে শুরু হয়েছে—সব তল্লাটের ছেলেদের সঙ্গেই তাকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড়ের ভেতর হইচই করতে দেখা যায় এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই সমবয়সী ছেলেদের সাথে তাকে ঝগড়া করতে বা মারামারি কি হাতাহাতি করতেও দেখা যায়।
‘এই মেয়েটার মাথায় কি ছিট আছে? অর বয়সী মেয়েরা যখন লুকায়া একটা পোলার লগে সিনেমা দেখতে যায়, ও দেখি পোলাগো লগে রাস্তায় দাঁড়ায়া ঝগড়া করে, মাইরপিট করে। চেহারাও কিন্তু খারাপ না! অর মায়ে-বাপে কিছু দ্যাখে না?’
‘অর মায়েই লাই দেয়। কিছু বললে বলে, পোলাগো সাথে ঝগড়া বা মাইরপিট করলেও তার মাইয়ারে একলা কোনো পোলার লগে কেউ খারাপভাবে কখনো চলতে-ফিরতে দ্যাখছে? তয় তার মেয়ের বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আবার বুদ্ধি কম হইলেও চাকরি তো করতেছে একের পর এক। বুঝি না বাবা!’
‘অর মায়েরই দোষ। সারা জীবন মাইয়া তো চাকরি করবে না। অনেক পোলার সাথে আড্ডা বা ঝগড়াঝাটি করার চাইতে একটা ছেলে ধইরা কয়েক দিন মিলামিশা কইরা বিয়া করলেও তো হয়। আইজকাল তো এইভাবেও কত বিয়া হইতেছে। অর মায়ে মেয়েরে কোথায় বুঝাইবে তা না।’
‘দ্যাখো, হয়তো মেয়ের ইনকাম খায়।’
২. ‘মই মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া!’
ওয়ার্ড কমিশনার পদে শিখাদের পাড়ায় শুক্রবারের মিছিলে সবার আগে আছে শিখা। ওমা! পাশের গলি থেকে আর একটি মিছিল আসছে দেখি।
‘আনারস মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া।’
শিখার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ‘মই’ মার্কায় দাঁড়ানো প্রার্থী গত বছর এলাকায় কিছু কাজ করেছে। তার পাল্টা এই ‘আনারস’ মার্কার প্রার্থী আবার কে? একটা এসপার-ওসপার তো করা লাগে দেখি!
৩. জোড়পুল পদ্মনিধি লেনের জুতার ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় শিখার মুখোমুখি হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় পিটার। রাগ হয় তার। প্রায় পাঁচ বছর আগে কী মনে করে শিখা নিজে থেকে একবার এসে খানিকক্ষণ তার সাথে কথা বলল। ওমা! তারপর পিটার যতবার কথা বলতে যায়, শিখা সরে যায়। কিন্তু শিখার যে কারো সাথে প্রেম আছে, সেটাও পিটার অনেক খুঁজে বার করতে পারছে না। শিখা ওই রকমই ফ্যাক্টরিতে যায়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, আবার কাজে ঢোকে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনের বিকালে কখনো বান্ধবীদের সাথে আবার কখনো মহল্লার ছেলেদের সাথেও কথা বলতে দেখা যায়। কখনো কখনো ছেলেদের সাথে ঝগড়া বা মারপিটও চলে। কিন্তু কারো সাথে একা রিকশায় বা সিনেমা হলে কি খাবারের দোকানে—কোথাও কি দেখেছে? না, তাহলে শিখা কেন পিটারের সাথে এক দিনই কথা বলে আশা জাগিয়ে আবার এমন হয়ে গেল? পিটার অপেক্ষা করে আছে তো করেই আছে।
হারামজাদি শিখা...। নাকি শাঁখারীবাজারের সোলেমান যে ওর পিছু কিছুদিন ঘুরছিল—না, সোলেমানের সাথেও আলাদাভাবে ওকে দেখা যায়নি। ইদানীং শুনছে হাসি-খুশি সোলেমান না, গম্ভীর মুখের সুলতানকে নাকি শিখা একটু পছন্দ করত। কিন্তু সুলতানের সাথেও তো শিখাকে দেখা যায়নি কোথাও। মেয়েরা একটু ঘুরলে-ফিরলে কি দেখা যায় না? তাহলে এই পিশাচি কেন পিটারের কাছে আসে না? পিটার আর কত দিন একা থাকবে?
৪. এক শুক্রবার গিয়ে আরেক শুক্রবার ছুটির দিন। বিকাল বেলা মহল্লার গলিতে ডালপুরি কিনতে গিয়ে শিখার চোখ ছানাবড়া। গলির দেয়ালে এই নতুন ছেলেটা কে পোস্টার মারছে? তা-ও আবার ‘আনারস’ মার্কার পোস্টার! বারে বাহ্, পোস্টার মারছে তো মারছেই। তা-ও কিনা শিখাদের পাড়ায়? দু-এক মিনিট চুপ থেকে অসহ্য লাগে শিখার।
‘এই যে, আপনি আনারস মার্কার পোস্টার দিতেছেন ক্যান?’
অবাক হয়ে আনারসের চিকা মারা ছেলেটা তার দিকে তাকায়।
‘আনারস মার্কার পোস্টার মারছি আমার ইচ্ছা!’
‘না, আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টারই থাকবে।’
ছেলেটা অবাক হয়ে শিখার দিকে তাকিয়ে আবার আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটতে থাকে। ভালো তো?
‘কথা শুনছেন? আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টার ছাড়া কিছু চলবে না।’
‘তুমি কে?’
ছেলেটা খুবই বিরক্ত হয়ে শিখার দিকে তাকায়, ‘আমি আনারস মার্কার পোস্টারই সাঁটব।’
‘আমি কে মানে? আমি এই পাড়ারই মেয়ে, তুমি কে?’
‘আমি আনারস মার্কার প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের সূত্রাপুর থানার সম্পাদক।’
‘হুমম-সম্পাদক। ভাগো তো!’
‘তোমার কথায় ভাগব নাকি?’
আজব ছেলে তো! তাদের পাড়ায় কেন আনারস মার্কার পোস্টার চলবে? শিখা থাকতে এমন হতেই পারে না। তাদের পাড়ায় চলবে মই মার্কার পোস্টার। কাজেই শিখা তর্ক চালাতে থাকে। আর নতুন ছেলেটাও মুখে মুখে জবাব দিতে থাকে। হুট করে কী যেন হয় শিখার। পাগলি হরিদাসীর দিকে ফিরে বলে, ‘মাসি, তোমার দোকানে ওই ইটের টুকরা আর নারকেলের আইচার যে মালা রাখো, একটা দাও তো!’
‘কী করবি?’
‘অপজিশনরে দেব।’
‘পাঁচ টাকা লাগবে।
‘নেও।’
পাঁচ টাকায় একটা গুলতির মালা নিয়ে এসে শিখা হনহন করে নতুন ছেলেটা যেখানে নিজেই একটি মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বৈদ্যুতিক তারের নিচে দেয়ালে আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটছে, সেদিকে এসে হুট করে ছেলেটার দিকে গুলতির মালা ছুড়ে মারল। পরবি তো পর গুলতির মালা, ছেলেটার গলায় ঢুকে গেল। ছেলেটি এক ঝলক বোকা বনে গিয়ে সে-ও হুড়মুড় করে মই থেকে নেমে—ওমা! সে-ও হরিদাসীর দোকানের দিকে ছুটছে। এক লহমায় তার হাতেও একটি গুলতির মালা এবং সেও গুলতির মালা শিখার দিকে ছুড়ল।
‘ঠাকুর, এই মেয়ে কী বেহায়া! একটা অচেনা ছেলের গলায় মালা দিয়া বসল!’
শিখা হুট করে একটি তির্যক মন্তব্যে পেছন ফিরে দেখে একদল নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে এবং প্রথম মন্তব্যের পরেই আর একটি মন্তব্য ছিটকে এল—‘ভরত হারামজাদাও দেখি পাল্টা এই মেয়ের গলায় মালা দিল। আরে ভরত হারামজাদার বিয়া ঠিক, তবু...’
অবাক শিখা পাল্টা প্রতিবাদ করে যেই না বলতে গেল, ‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা কি কোনো ফুলের মালা? এইটা তো গুলতির মালা, অপজিশনরে দ্যায়!’
পুরো বাক্য শেষ করার আগেই শিখা দ্যাখে তার মা ছুটে আসছে এবং শিখার ভয়ানক শান্ত, নরম মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিখার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দুই গালে চড় কষিয়ে বলতে থাকে, ‘কলঙ্কিনী, বেজাতের ছেলের গলায় মালা দিলি? তা-ও যে ছেলের বিয়া ঠিক?’
এই ভরত কে? সে নাকি পাশের পাড়ায় দুই বছর অন্য শহরে কাজ করে ফিরেছে। তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটিও ছুটে আসে।
‘এই রাক্ষসী, তুই আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলের গলায় মালা দিলি ক্যান?’
‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা গুলতির মালা।’
কিন্তু পুরো কথা শিখার আর বলা হয় না। আশপাশের তিন-চার পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে ভরত ও শিখা যে দুই পাপী এবং তারা এত দিন লুকিয়ে এবং এখন প্রকাশ্যে বেলেল্লাপনা শুরু করেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত মন্তব্য করতে থাকে। দুজনকেই নিজের নিজের মানুষেরা রাস্তার ওপরেই প্রচণ্ড পেটানো শুরু করে। অনেকটা সাপ পেটানোর মতো। পেটাতে পেটাতে এবং গালি দিতে দিতে তাদের যে যার পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
৫. ‘এই পাড়ায় লুকায়া লুকায়া কত মেয়ে কত কী করে! বিয়ার আগে পেটে বাচ্চা আসছে এমন মেয়েও লুকায়া গর্ভ নষ্ট করার পর আবার বিয়া হয়। আর তুই কিনা বলদের মতো এক গুলতির মালা দিয়া এত কলঙ্কিনী হইলি? কবে তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি হবে? মেয়েমানুষের ছেলেদের মতো নির্বাচনের প্রচারে নামা, কে ওয়ার্ড কমিশনার হবে কি না, মই না আনারসের পোস্টার—এসব ভাবার দরকারই নাই। সমাজ এতে মেয়েদের খারাপ মনে করে’—শিখার বিধবা পিসি মায়ের হাত থেকে শিখাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীর দিয়ে শিখাকে আড়াল করতে করতে বলেন।
৬. ভরতের সাথে দেখা হলো মাসখানেক পরে। আশপাশের কয়েকটা মহল্লায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। কয়েক দফা মার খেয়ে তাদের দুজনেরই হাতে-পায়ে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা। শিখার ফ্যাক্টরি এক মাস করোনায় বন্ধ ছিল। আজ খুলেছে। আজ বের হতেই হবে। যতই পাড়ায় ঢি ঢি পড়ুক। কিন্তু আসলে ভরতের সাথে সে কী করেছে? ওই মালাটা তো কোনো ফুলের মালা ছিল না, ছিল কিনা একটা গুলতির মালা, যা অপজিশনকে দেয়।
ওমা! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে—গলির মোড়েই ভরত। একী! ওর হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ কেন? খানিকটা মন খারাপও লাগে তার। তারা না হয় মই আর আনারস মার্কা নিয়ে ঝগড়া করেছে, কিন্তু লোকজন তাদের পেটালই বা কেন, আর এত নোংরা কথাই বা বলছে কেন?
‘অনেক পিটান খাইছিস?’
শক্ত মুখে বলে শিখা।
ভরত ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ব্যান্ডেজ লাগছে? এত পিটান কে পিটাইল?’
‘লক্ষ্মীর বাপের বাড়ির লোকেরা।’
‘মানে, তোর হবু বউয়ের বাড়ির লোকজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে কী করতে হবে? তোর হবু বউ বা তার বাড়ির লোকজনরে বুঝাব?’
‘তারা তো বুঝতেছে না। ইয়ে...মানে, তোমার চোখ-মুখ ফোলা কেন?’
‘মাইর খাইছি।’ শুকনো মুখে বলে ফ্যাক্টরির দিকে পা বাড়ায় শিখা।
কিন্তু জোসেফের কী হবে? নতুন ঢাকায় একটা রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করা জোসেফের সাথে পরিচয় হয়েছিল মাত্র তিন মাস আগে। ছোট মাসির বাসায়। মাসতুতো দাদার বন্ধু। শিখার ফোন নম্বর নিয়ে প্রায়ই ফোন করত।
‘কাউকে ভালো লাগেনি তোমার কখনো?’
‘পিটারকে ভালো লাগছিল, কিন্তু...’
‘তয় লজ্জাও লাগত, তাই এড়ায়া যাইতাম!’
‘আমি কিন্তু খোঁজ-খবর নিছি। সোলেমান পোলাডা একবার সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানোয় তোমার মুখ ঘুড়িতে আঁকছিল, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে ভালো লাগে নাই?’
‘হ্যাঁ, ঘুড়িতে আমার মুখ আঁকার পরে কিছুদিন খুব ঢি ঢি পড়ছিল। কিন্তু ও তো অন্য সম্প্রদায়ের পোলা। আমি তাই দূরে দূরে থাকতাম। এ ছাড়া সুলতান...’
‘সুলতান কে?’
‘সোলেমানের আগেই পরিচয়। ভারি জিদ্দি পোলা। মুখ ফুইটা কোনো দিন কিছু বলেও নাই। কিন্তু শুধু এক জিদ। আমার গায়ে মাছিটাও বসতে পারব না। তাইলেই আমারে খুন করবে। ভয়ে আমিও আগাইতে পারি নাই। তবে মন টানছিল এটা ঠিক। কিন্তু ওরে আমার সব সময়ই ভয় করত।’
‘ও বিয়া করছে?’
‘এই সেদিন। সোলেমান অনেক আগেই বিয়া করছে। পিটার কিন্তু একা। কাল সকালে আবার ফ্যাক্টরি আছে।’
‘তুমি ঘুমাবে, না?’
অপ্রস্তুত হয়ে চুপ হয়ে যেত শিখা। জোসেফের মতো সারা রাত জেগে মোবাইলে কথা সে বলতে পারে না। তার ঘুম পেয়ে যায়। আর জোসেফ মন খারাপ করে। তবে জোসেফ ভালো। কোনো দিন কোনো খারাপ কথা বলে নাই। কিন্তু সবাইকে সরিয়ে কোথাকার কোন ভরত—কেন যে সে আনারস মার্কা আর সে মই মার্কার পোস্টার দিতে গিয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে গুলতির মালা ছুড়তে গিয়ে এত ঝামেলা হলো? না পিটার, না জোসেফ আর কেউ তাকে কোনো দিন মনে করবে? ভরতের সাথে লক্ষ্মীর সবকিছু জোড়া লাগুক...কিন্তু লক্ষ্মী তাকে অনেক গালি দিয়েছে...লক্ষ্মীর বন্ধু-পরিবারও...আর ভরত পোলাডাও এত মাইর খাইল শুধু শুধু।
নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়। সূত্রাপুর-২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় বস্তি এলাকায় হরিদাসীর নিজেরই একটি ছোট চায়ের দোকানের মতো আছে। দোকান চালানো ছাড়াও সাদা থান পরা হরিদাসী অবসর সময়ে মাঝে মাঝেই মাটির ছোট ছোট চাড়া আগুনে পুড়িয়ে টুকরো ইটের মতো বানিয়ে, একটু দূরের কয়েক ঘর চামার বসতি থেকে মোটা সুই এনে সদ্য আগুনে পোড়া সেই চাড়াগুলো মালার মতো গাঁথে। কখনো সেই মালায় সে আরও যুক্ত করত নারকেলের আইচার টুকরা বা খেজুরের কাঁটা। ‘এই মালা—বুঝলি ছেমড়ি—অপজিশন, মানে বিরোধী পক্ষের গলায় ছুড়লে অপজিশন ঠান্ডা!’
এভাবে হরিদাসীর কাছ থেকেই শিখা মার্গারেট কস্টা প্রথম গুলতির মালা বানাতে শেখে। সূত্রাপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বলতে গেলে শিখারা মাত্র কয়েক ঘর খ্রিষ্টান আছে। খ্রিষ্টানও হয়েছে মাত্র তারা এক-দুই পুরুষ। বাকিটা তারাই সংখ্যায় ভারী, যারা শিখাদের পূর্বপুরুষ ছিল। সূত্রাপুর ছাড়ালে অবশ্য আবার মুসলমান বসতি শুরু।
‘শিখা! ঘুম দিয়া ওঠ। আইজ ফ্যাক্টরিত যাবি না?’
শিখা হাই তুলে ওঠে। মা গ্লাসে চা আর টোস্ট এনেছে। শিখার বয়স প্রায় কুড়ি। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েটরে একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে সে। এক গার্মেন্টসে ছিল দুই বছর, তারপর ব্যাটারি তৈরির একটি কারখানায় আরও দেড় বছর, লজেন্সের একটি কারখানায় দুই বছর, আবার এখন এই বিস্কুট তৈরির কারখানায় প্রায় এক বছর হতে চলল। বাবা-মাকে সবাই যদিও বলে যে শিখার বিয়ের কত দূর, তবু শিখা একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে বলে বিয়ের চাপ পাড়ায় উঠে উঠেও ওঠে না। যদিও শিখার বয়সী অধিকাংশ মেয়েই এই সূত্রাপুর, শাঁখারীবাজার, নারিন্দা, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, ওয়ারীসহ এন্তার পুরান ঢাকায় বিয়ে করে কমসে কম এক-দুটো বাচ্চার মা, শিখা দিব্যি একের পর এক কারখানায় কাজ নেয়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, তখন দু-তিন মাস বিয়ের কথা ওঠে, তারপর আবার কাজ পেলে বিয়ের কথা থিতিয়ে যায়। আর এ ছাড়া সবাই জানে যে শিখা একটু ‘ছিটেল’। ‘ছিটেল’ কেমন? যে মেয়ের নিজেরই বিয়ে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই, তাকে আলাদাভাবে কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে-ফিরতে বা হুট করে কোনো বাজে অবস্থায় কোনো ছেলের সঙ্গেই কারোর চোখে তেমন পড়েছে বলে তল্লাটের কেউই কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু আবার শিখার কিছু বদনামও আছে। শিখাকে প্রায়ই দেখা যায় শুধু এই কয়েক ঘর খ্রিষ্টানপাড়ার খ্রিষ্টান ছেলেই না, শাঁখারীবাজারের ছেলে থেকে শুরু করে মুসলমান বসতি যেখানে শুরু হয়েছে—সব তল্লাটের ছেলেদের সঙ্গেই তাকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড়ের ভেতর হইচই করতে দেখা যায় এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই সমবয়সী ছেলেদের সাথে তাকে ঝগড়া করতে বা মারামারি কি হাতাহাতি করতেও দেখা যায়।
‘এই মেয়েটার মাথায় কি ছিট আছে? অর বয়সী মেয়েরা যখন লুকায়া একটা পোলার লগে সিনেমা দেখতে যায়, ও দেখি পোলাগো লগে রাস্তায় দাঁড়ায়া ঝগড়া করে, মাইরপিট করে। চেহারাও কিন্তু খারাপ না! অর মায়ে-বাপে কিছু দ্যাখে না?’
‘অর মায়েই লাই দেয়। কিছু বললে বলে, পোলাগো সাথে ঝগড়া বা মাইরপিট করলেও তার মাইয়ারে একলা কোনো পোলার লগে কেউ খারাপভাবে কখনো চলতে-ফিরতে দ্যাখছে? তয় তার মেয়ের বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আবার বুদ্ধি কম হইলেও চাকরি তো করতেছে একের পর এক। বুঝি না বাবা!’
‘অর মায়েরই দোষ। সারা জীবন মাইয়া তো চাকরি করবে না। অনেক পোলার সাথে আড্ডা বা ঝগড়াঝাটি করার চাইতে একটা ছেলে ধইরা কয়েক দিন মিলামিশা কইরা বিয়া করলেও তো হয়। আইজকাল তো এইভাবেও কত বিয়া হইতেছে। অর মায়ে মেয়েরে কোথায় বুঝাইবে তা না।’
‘দ্যাখো, হয়তো মেয়ের ইনকাম খায়।’
২. ‘মই মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া!’
ওয়ার্ড কমিশনার পদে শিখাদের পাড়ায় শুক্রবারের মিছিলে সবার আগে আছে শিখা। ওমা! পাশের গলি থেকে আর একটি মিছিল আসছে দেখি।
‘আনারস মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া।’
শিখার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ‘মই’ মার্কায় দাঁড়ানো প্রার্থী গত বছর এলাকায় কিছু কাজ করেছে। তার পাল্টা এই ‘আনারস’ মার্কার প্রার্থী আবার কে? একটা এসপার-ওসপার তো করা লাগে দেখি!
৩. জোড়পুল পদ্মনিধি লেনের জুতার ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় শিখার মুখোমুখি হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় পিটার। রাগ হয় তার। প্রায় পাঁচ বছর আগে কী মনে করে শিখা নিজে থেকে একবার এসে খানিকক্ষণ তার সাথে কথা বলল। ওমা! তারপর পিটার যতবার কথা বলতে যায়, শিখা সরে যায়। কিন্তু শিখার যে কারো সাথে প্রেম আছে, সেটাও পিটার অনেক খুঁজে বার করতে পারছে না। শিখা ওই রকমই ফ্যাক্টরিতে যায়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, আবার কাজে ঢোকে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনের বিকালে কখনো বান্ধবীদের সাথে আবার কখনো মহল্লার ছেলেদের সাথেও কথা বলতে দেখা যায়। কখনো কখনো ছেলেদের সাথে ঝগড়া বা মারপিটও চলে। কিন্তু কারো সাথে একা রিকশায় বা সিনেমা হলে কি খাবারের দোকানে—কোথাও কি দেখেছে? না, তাহলে শিখা কেন পিটারের সাথে এক দিনই কথা বলে আশা জাগিয়ে আবার এমন হয়ে গেল? পিটার অপেক্ষা করে আছে তো করেই আছে।
হারামজাদি শিখা...। নাকি শাঁখারীবাজারের সোলেমান যে ওর পিছু কিছুদিন ঘুরছিল—না, সোলেমানের সাথেও আলাদাভাবে ওকে দেখা যায়নি। ইদানীং শুনছে হাসি-খুশি সোলেমান না, গম্ভীর মুখের সুলতানকে নাকি শিখা একটু পছন্দ করত। কিন্তু সুলতানের সাথেও তো শিখাকে দেখা যায়নি কোথাও। মেয়েরা একটু ঘুরলে-ফিরলে কি দেখা যায় না? তাহলে এই পিশাচি কেন পিটারের কাছে আসে না? পিটার আর কত দিন একা থাকবে?
৪. এক শুক্রবার গিয়ে আরেক শুক্রবার ছুটির দিন। বিকাল বেলা মহল্লার গলিতে ডালপুরি কিনতে গিয়ে শিখার চোখ ছানাবড়া। গলির দেয়ালে এই নতুন ছেলেটা কে পোস্টার মারছে? তা-ও আবার ‘আনারস’ মার্কার পোস্টার! বারে বাহ্, পোস্টার মারছে তো মারছেই। তা-ও কিনা শিখাদের পাড়ায়? দু-এক মিনিট চুপ থেকে অসহ্য লাগে শিখার।
‘এই যে, আপনি আনারস মার্কার পোস্টার দিতেছেন ক্যান?’
অবাক হয়ে আনারসের চিকা মারা ছেলেটা তার দিকে তাকায়।
‘আনারস মার্কার পোস্টার মারছি আমার ইচ্ছা!’
‘না, আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টারই থাকবে।’
ছেলেটা অবাক হয়ে শিখার দিকে তাকিয়ে আবার আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটতে থাকে। ভালো তো?
‘কথা শুনছেন? আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টার ছাড়া কিছু চলবে না।’
‘তুমি কে?’
ছেলেটা খুবই বিরক্ত হয়ে শিখার দিকে তাকায়, ‘আমি আনারস মার্কার পোস্টারই সাঁটব।’
‘আমি কে মানে? আমি এই পাড়ারই মেয়ে, তুমি কে?’
‘আমি আনারস মার্কার প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের সূত্রাপুর থানার সম্পাদক।’
‘হুমম-সম্পাদক। ভাগো তো!’
‘তোমার কথায় ভাগব নাকি?’
আজব ছেলে তো! তাদের পাড়ায় কেন আনারস মার্কার পোস্টার চলবে? শিখা থাকতে এমন হতেই পারে না। তাদের পাড়ায় চলবে মই মার্কার পোস্টার। কাজেই শিখা তর্ক চালাতে থাকে। আর নতুন ছেলেটাও মুখে মুখে জবাব দিতে থাকে। হুট করে কী যেন হয় শিখার। পাগলি হরিদাসীর দিকে ফিরে বলে, ‘মাসি, তোমার দোকানে ওই ইটের টুকরা আর নারকেলের আইচার যে মালা রাখো, একটা দাও তো!’
‘কী করবি?’
‘অপজিশনরে দেব।’
‘পাঁচ টাকা লাগবে।
‘নেও।’
পাঁচ টাকায় একটা গুলতির মালা নিয়ে এসে শিখা হনহন করে নতুন ছেলেটা যেখানে নিজেই একটি মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বৈদ্যুতিক তারের নিচে দেয়ালে আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটছে, সেদিকে এসে হুট করে ছেলেটার দিকে গুলতির মালা ছুড়ে মারল। পরবি তো পর গুলতির মালা, ছেলেটার গলায় ঢুকে গেল। ছেলেটি এক ঝলক বোকা বনে গিয়ে সে-ও হুড়মুড় করে মই থেকে নেমে—ওমা! সে-ও হরিদাসীর দোকানের দিকে ছুটছে। এক লহমায় তার হাতেও একটি গুলতির মালা এবং সেও গুলতির মালা শিখার দিকে ছুড়ল।
‘ঠাকুর, এই মেয়ে কী বেহায়া! একটা অচেনা ছেলের গলায় মালা দিয়া বসল!’
শিখা হুট করে একটি তির্যক মন্তব্যে পেছন ফিরে দেখে একদল নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে এবং প্রথম মন্তব্যের পরেই আর একটি মন্তব্য ছিটকে এল—‘ভরত হারামজাদাও দেখি পাল্টা এই মেয়ের গলায় মালা দিল। আরে ভরত হারামজাদার বিয়া ঠিক, তবু...’
অবাক শিখা পাল্টা প্রতিবাদ করে যেই না বলতে গেল, ‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা কি কোনো ফুলের মালা? এইটা তো গুলতির মালা, অপজিশনরে দ্যায়!’
পুরো বাক্য শেষ করার আগেই শিখা দ্যাখে তার মা ছুটে আসছে এবং শিখার ভয়ানক শান্ত, নরম মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিখার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দুই গালে চড় কষিয়ে বলতে থাকে, ‘কলঙ্কিনী, বেজাতের ছেলের গলায় মালা দিলি? তা-ও যে ছেলের বিয়া ঠিক?’
এই ভরত কে? সে নাকি পাশের পাড়ায় দুই বছর অন্য শহরে কাজ করে ফিরেছে। তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটিও ছুটে আসে।
‘এই রাক্ষসী, তুই আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলের গলায় মালা দিলি ক্যান?’
‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা গুলতির মালা।’
কিন্তু পুরো কথা শিখার আর বলা হয় না। আশপাশের তিন-চার পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে ভরত ও শিখা যে দুই পাপী এবং তারা এত দিন লুকিয়ে এবং এখন প্রকাশ্যে বেলেল্লাপনা শুরু করেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত মন্তব্য করতে থাকে। দুজনকেই নিজের নিজের মানুষেরা রাস্তার ওপরেই প্রচণ্ড পেটানো শুরু করে। অনেকটা সাপ পেটানোর মতো। পেটাতে পেটাতে এবং গালি দিতে দিতে তাদের যে যার পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
৫. ‘এই পাড়ায় লুকায়া লুকায়া কত মেয়ে কত কী করে! বিয়ার আগে পেটে বাচ্চা আসছে এমন মেয়েও লুকায়া গর্ভ নষ্ট করার পর আবার বিয়া হয়। আর তুই কিনা বলদের মতো এক গুলতির মালা দিয়া এত কলঙ্কিনী হইলি? কবে তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি হবে? মেয়েমানুষের ছেলেদের মতো নির্বাচনের প্রচারে নামা, কে ওয়ার্ড কমিশনার হবে কি না, মই না আনারসের পোস্টার—এসব ভাবার দরকারই নাই। সমাজ এতে মেয়েদের খারাপ মনে করে’—শিখার বিধবা পিসি মায়ের হাত থেকে শিখাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীর দিয়ে শিখাকে আড়াল করতে করতে বলেন।
৬. ভরতের সাথে দেখা হলো মাসখানেক পরে। আশপাশের কয়েকটা মহল্লায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। কয়েক দফা মার খেয়ে তাদের দুজনেরই হাতে-পায়ে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা। শিখার ফ্যাক্টরি এক মাস করোনায় বন্ধ ছিল। আজ খুলেছে। আজ বের হতেই হবে। যতই পাড়ায় ঢি ঢি পড়ুক। কিন্তু আসলে ভরতের সাথে সে কী করেছে? ওই মালাটা তো কোনো ফুলের মালা ছিল না, ছিল কিনা একটা গুলতির মালা, যা অপজিশনকে দেয়।
ওমা! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে—গলির মোড়েই ভরত। একী! ওর হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ কেন? খানিকটা মন খারাপও লাগে তার। তারা না হয় মই আর আনারস মার্কা নিয়ে ঝগড়া করেছে, কিন্তু লোকজন তাদের পেটালই বা কেন, আর এত নোংরা কথাই বা বলছে কেন?
‘অনেক পিটান খাইছিস?’
শক্ত মুখে বলে শিখা।
ভরত ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ব্যান্ডেজ লাগছে? এত পিটান কে পিটাইল?’
‘লক্ষ্মীর বাপের বাড়ির লোকেরা।’
‘মানে, তোর হবু বউয়ের বাড়ির লোকজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে কী করতে হবে? তোর হবু বউ বা তার বাড়ির লোকজনরে বুঝাব?’
‘তারা তো বুঝতেছে না। ইয়ে...মানে, তোমার চোখ-মুখ ফোলা কেন?’
‘মাইর খাইছি।’ শুকনো মুখে বলে ফ্যাক্টরির দিকে পা বাড়ায় শিখা।
কিন্তু জোসেফের কী হবে? নতুন ঢাকায় একটা রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করা জোসেফের সাথে পরিচয় হয়েছিল মাত্র তিন মাস আগে। ছোট মাসির বাসায়। মাসতুতো দাদার বন্ধু। শিখার ফোন নম্বর নিয়ে প্রায়ই ফোন করত।
‘কাউকে ভালো লাগেনি তোমার কখনো?’
‘পিটারকে ভালো লাগছিল, কিন্তু...’
‘তয় লজ্জাও লাগত, তাই এড়ায়া যাইতাম!’
‘আমি কিন্তু খোঁজ-খবর নিছি। সোলেমান পোলাডা একবার সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানোয় তোমার মুখ ঘুড়িতে আঁকছিল, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে ভালো লাগে নাই?’
‘হ্যাঁ, ঘুড়িতে আমার মুখ আঁকার পরে কিছুদিন খুব ঢি ঢি পড়ছিল। কিন্তু ও তো অন্য সম্প্রদায়ের পোলা। আমি তাই দূরে দূরে থাকতাম। এ ছাড়া সুলতান...’
‘সুলতান কে?’
‘সোলেমানের আগেই পরিচয়। ভারি জিদ্দি পোলা। মুখ ফুইটা কোনো দিন কিছু বলেও নাই। কিন্তু শুধু এক জিদ। আমার গায়ে মাছিটাও বসতে পারব না। তাইলেই আমারে খুন করবে। ভয়ে আমিও আগাইতে পারি নাই। তবে মন টানছিল এটা ঠিক। কিন্তু ওরে আমার সব সময়ই ভয় করত।’
‘ও বিয়া করছে?’
‘এই সেদিন। সোলেমান অনেক আগেই বিয়া করছে। পিটার কিন্তু একা। কাল সকালে আবার ফ্যাক্টরি আছে।’
‘তুমি ঘুমাবে, না?’
অপ্রস্তুত হয়ে চুপ হয়ে যেত শিখা। জোসেফের মতো সারা রাত জেগে মোবাইলে কথা সে বলতে পারে না। তার ঘুম পেয়ে যায়। আর জোসেফ মন খারাপ করে। তবে জোসেফ ভালো। কোনো দিন কোনো খারাপ কথা বলে নাই। কিন্তু সবাইকে সরিয়ে কোথাকার কোন ভরত—কেন যে সে আনারস মার্কা আর সে মই মার্কার পোস্টার দিতে গিয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে গুলতির মালা ছুড়তে গিয়ে এত ঝামেলা হলো? না পিটার, না জোসেফ আর কেউ তাকে কোনো দিন মনে করবে? ভরতের সাথে লক্ষ্মীর সবকিছু জোড়া লাগুক...কিন্তু লক্ষ্মী তাকে অনেক গালি দিয়েছে...লক্ষ্মীর বন্ধু-পরিবারও...আর ভরত পোলাডাও এত মাইর খাইল শুধু শুধু।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
৩ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে