ইশতিয়াক হাসান
ভারতের বর্ধমানের খনি এলাকা ভৈরবগড়ে কয়েক দিনের মধ্যে ঘটে তিনটি হত্যাকাণ্ড। খুন হওয়া ব্যক্তিদের দুজন ব্যবসায়ী, একজন অবসরপ্রাপ্ত খনি প্রকৌশলী। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মৃত্যুর আগের দিন তিনজনের কাছেই এসেছিলেন এক তান্ত্রিক সাধু বাবা। প্রতিটি লাশ পাওয়া গিয়েছে ভৈরব মন্দিরের চত্বরে, সবার হার্টের পেছনে পিঠের দিকে ছিল তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে আরও একটি যোগসূত্র আছে। প্রতিবারই খুনের পর ভৈরব মন্দিরের চূড়ায় আটকানো ত্রিশূলে মিলেছে টাটকা রক্ত। বিংশ শতকেও নরবলি! নাকি আরও জটিল কোনো রহস্য! ব্যাস, খনি এলাকা ভৈরব গড়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাজির টাক মাথার এক বৃদ্ধ।
কিংবা ধরমপুর রিজার্ভ ফরেস্টের রোমাঞ্চকর সেই কাহিনির কথাও বলতে পারি। ভয়ানক চেহারার একটি আফগান হাউন্ডকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছিল সেখানে। তার পরই রাকেশ শর্মা নামের এক ব্যক্তিকে মাছ ধরার সময় কুকুরটা গলা কামড়ে নিয়ে যাওয়ার খবর মিলল। আপাতদৃষ্টিতে একেবারে সোজা-সাপটা কেস। কিন্তু কী ভাগ্য! তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই বৃদ্ধ। আর তদন্তেই বেরিয়ে এল থলের ভেতরের বিড়াল। গল্পটার আরও খানিকটা বলা যেত। কিন্তু তাহলে হয়তো না পড়া থাকলে আগ্রহটা কমে যাবে আপনার!
এই বুড়োর পরিচয় যাঁরা এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি, তাঁদের বলছি, ইনি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনবদ্য সৃষ্টি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বাংলা-ইংরেজি রহস্যসাহিত্য মিলিয়ে হিসাব করলে আমার সবচেয়ে পছন্দের দুই-তিনটি চরিত্রের একটি এই নীলাদ্রি সরকার। মন খারাপ করা ব্যাপার হলো, রহস্যপ্রিয় পাঠকেরা ফেলুদা, শার্লক হোমস, মিস মার্পলের মতো চরিত্রগুলোকে যতটা চেনেন, ততটা চেনেন না নীলাদ্রি সরকারকে। অথচ স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও নীলাদ্রি সরকার চরিত্রটির ভক্ত ছিলেন। এমনকি মুস্তাফা সিরাজকে সন্দেশ পত্রিকায় কর্নেলকে নিয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করে চিঠিও লিখেছিলেন।
বলতে পারেন, নীলাদ্রি সরকার আর দশটা গোয়েন্দা চরিত্রের থেকে একেবারেই আলাদা। গোয়েন্দা বলে পরিচয়ও দেন না নিজের। তবে কথা হলো, রহস্যই সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তার ধ্যান-জ্ঞান। মাথার টাকটা বেশির ভাগ সময় ঢাকা পড়ে থাকে টুপিতে, মুখভর্তি লম্বা সাদা দাড়ি-গোঁফ। বয়সে বৃদ্ধ হলে কী হবে, গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। অনায়াসে পাহাড় বাইতে পারেন, হাঁটতে পারেন অনেকটা পথ, পিঠের কিটব্যাগ থেকে উঁকি দেয় প্রজাপতি ধরার জাল, গলায় ঝোলে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা। প্রথম দেখায় মনে হবে বিদেশি ট্যুরিস্ট, আসলে বাঙালি।
এই চরিত্র সৃষ্টির গল্পটাও ভারি মজার। ১৯৫৬ সালের এক শীতকাল। মুর্শিদাবাদের লালবাগের ঐতিহ্যবাহী হাজার দুয়ারি প্রাসাদে গিয়েছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। হঠাৎ চোখ আটকে গেল সান্তার মতো পাকা গোঁফ-দাড়ির এক বৃদ্ধে। টকটকে ফরসা রং। প্যান্ট-শার্ট পরনে। পিঠে কিটব্যাগ। বাইনোকুলার দিয়ে দূরের কোনো কিছুতে ছিল নজর। মুখ তুলতেই টুপি খসে বেরিয়ে পড়ল টাক, রোদ পড়ে ঝলমল করছিল। হামাগুঁড়ি দিয়ে রহস্যজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন একটা ঝোপের দিকে। আশপাশে ওত পেতে থাকা গাইডদের একজন সামনে উদয় হয়ে বিদেশি ভেবে তাঁকে একটা ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভুলভাল ইংরেজিতে। তখনই বুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে বাংলায় বলে উঠলেন, এই প্রজাপতিগুলো বড্ড সেয়ানা। গাইডের তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়, এমনকি চোখ কপালে মুস্তাফা সিরাজেরও। তিনিও যে এই বৃদ্ধকে বিদেশিই ভেবে বসেছিলেন!
এর বহু বছর পর এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের তাড়ায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে লেখকের মাথায় চলে এল ওই বুড়োর কথা। ব্যাস, তার আদলে বানিয়ে ফেললেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চরিত্রটি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ওই রহস্যোপন্যাসের নাম ‘ছায়া পড়ে’।
কর্নেলকে নিয়ে আরও কিছু লেখার আগে আজ কেন চরিত্রটিকে আপনাদের সামনে হাজির করছি তা বলছি। ২০১২ সালের আজকের দিনে মানে ৪ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নেন কর্নেল চরিত্রের স্রষ্টা ও বইয়ের লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। অর্থাৎ আজ তাঁর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
আবার কর্নেল নীলাদ্রি সরকারে ফিরে আসা যাক। ভারতের কোথাও কোথাও দুর্লভ প্রজাপতি, পাখি, অর্কিড, ক্যাকটাসের খবর পেলেই হলো, হাজির হয়ে যান। তা সেটা যতই দুর্গম পাহাড় কিংবা অরণ্যই হোক না কেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় খেয়াল রহস্যের পিছু নেওয়া। লালবাজারের (কলকাতা পুলিশের প্রধান কার্যালয়) দুঁদে গোয়েন্দারা যেখানে ব্যর্থ, সেখানেই শুরু নীলাদ্রি সরকারের। কখনো তাঁর সাহায্য চাইতে হাজির হয়ে যান গোয়েন্দা বিভাগের ডিসি ডিবি অরিজিৎ লাহিড়ী, কিংবা অন্য কোনো গোয়েন্দা। কর্নেল হয়তো তখন তাঁর ইলিয়ট রোডের তিনতলা দালানটার প্রিয় ছাদবাগানে শত মাইল দূরের কোনো পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা গাছের যত্ন নিচ্ছেন। অতিথিকে অভ্যর্থনা জানায় কর্নেলের একান্ত বিশ্বস্ত ভৃত্য ও গাছ পরিচর্যার সঙ্গী ষষ্ঠীচরণ।
মোটামুটি বেশির ভাগ অভিযানে কর্নেলের সঙ্গে থাকে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরী। দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চারগুলো জয়ন্তর মাধ্যমেই জানতে পারেন পত্রিকার পাঠকেরা। তবে সাংবাদিক হিসেবে তুখোড় হলেও জয়ন্তর রহস্যভেদী বুদ্ধি মোটেই আহামরি কিছু নয়। অবশ্য বেশির ভাগ বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনির পার্শ্ব চরিত্ররাই গল্পের প্রয়োজনে খুরদার বুদ্ধির হন না। কর্নেলের বইগুলোর আরেক অসাধারণ সংযোজন অবসরপ্রাপ্ত দারোগা এবং পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্ত কুমার হালদার। অনেক সময়ই দেখা যায় নিজের কোনো কেসে কিংবা কর্নেলকে সাহায্য করতে গিয়ে নানান অদ্ভুত কাণ্ডকীর্তি ঘটাচ্ছেন হালদার মশাই। পাঠকেরা এসব ঘটনার বর্ণনা পড়ে কখন হাসতে শুরু করেছেন নিজেরাই টের পান না। বলা চলে এই চরিত্রের উপস্থিতি কাহিনিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। মুস্তাফা সিরাজ নিজেই হালদার মশাইকে উল্লেখ করেছেন তাঁর রিলিফ হিসাবে। কে কে হালদারের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার স্টাইলটাও কিন্তু দারুণ।
কর্নেলের বইগুলো পড়তে গিয়ে তার সঙ্গে অসাধারণ সব জায়গায় ভ্রমণও হয়ে যাবে আপনার। আমার যেমনটা হয়। কখনো নেপাল সীমান্তের ডমরু পাহাড়ে, কখনো পার্বত্য শিল্প এলাকা রানীডিহি বা বিহার সীমান্তের খনি এলাকা বারাহিয়া কিংবা ওডিশার সাগর তীরবর্তী গোপালপুর অন সি, চন্দনপুর অন সি, নতুবা ধরমপুরের ধরিয়া ফলসে পৌঁছে যাই। বুড়োর সঙ্গে সারস পাখির খোঁজ করতে গিয়েও রহস্যের পাকে আটকা পড়ি। এসব দুর্গম জায়গায় গিয়ে অসাধারণ সুন্দর কোনো সেচ বাংলো কিংবা সরকারি অন্য কোনো বাংলোয় থাকার সুযোগ হয়ে যায় কর্নেল আর জয়ন্ত চৌধুরীর বদন্যতায়।
তবে কর্নেলের সঙ্গে জোট বাঁধার আগে একটি সাবধানবাণী। খুনোখুনি লেগেই থাকে তাঁর বইয়ে। তাই উত্তেজনার মাত্রাটাও বেশি, কখনো একটু বড়দের উপযোগী ঘটনা কিংবা রগরগে বর্ণনাও থাকে, কিছু বই আবার একেবারেই কিশোর উপযোগী। মোটের ওপর ছেলে-বুড়ো সবার জন্যই ‘কর্নেল’ লেখা হয়েছে। আমার মতো রহস্য ও প্রকৃতিপ্রেমিকের জন্য এর চেয়ে সরস কাহিনি পাওয়া মুশকিল। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন, কেবল পাঁড় গোয়েন্দাকাহিনির ভক্তরা নন, অ্যাডভেঞ্চার কিংবা বন-জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীপ্রেমী পাঠকদের জন্যও অসাধারণ এক চয়েজ হতে পারে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘কর্নেল’। পড়তে পড়তে এতটাই বুঁদ হয়ে যাবেন, মনে হবে আপনিও কাহিনিটির একটি চরিত্র। দেজ পাবলিশার্স থেকে কর্নেলর ১৭টি সমগ্র বের হয়েছে। আর কিশোরসমগ্র বের হয়েছে চারটি।
হাথিয়াগড় জঙ্গল। সেখানে বিশাল এক পাহাড়, নাম কোদণ্ড। ওই পাহাড়-জঙ্গলেই ভয়ানক এক মানুষখেকো বাঘের উৎপাতের খবর পেলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কিন্তু কী আশ্চর্য! বাঘটি শুধু মানুষ মারার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু সেই মানুষগুলোর মৃতদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এদিকে মানুষখেকোর এলাকায় ছোট্ট এক নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কারা? শিবচরণ পাণ্ডে নামে পুরোনো এক বন্ধুর চিঠি পেয়ে রহস্যের গন্ধ পেলেন কর্নেল। হাজির হলেন পাহাড়ি এলাকাটিতে। কিন্তু তিনি সেখানে যেতে না যেতেই পাণ্ডের রক্তাক্ত দেহ খুঁজে পেলেন কর্নেল ও জয়ন্ত। বলা চলে, তাঁদের চোখের সামনেই মারা গেলেন তিনি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল বাঘের আক্রমণেই মারা গেছেন তিনি। কিন্তু কর্নেলকে কি এত সহজে বোকা বানানো যায়? কী পাঠক, আর দেরি কেন, কর্নেলের একটি বই হাতে নিয়ে পড়া শুরু করুন, আর প্রবেশ করুন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের রহস্যভুবনে। ও একটা কথা, শেষ যে কাহিনিটি বললাম, সেটার নাম ‘কোদণ্ড পাহাড়ের বা-রহস্য’।
ভারতের বর্ধমানের খনি এলাকা ভৈরবগড়ে কয়েক দিনের মধ্যে ঘটে তিনটি হত্যাকাণ্ড। খুন হওয়া ব্যক্তিদের দুজন ব্যবসায়ী, একজন অবসরপ্রাপ্ত খনি প্রকৌশলী। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মৃত্যুর আগের দিন তিনজনের কাছেই এসেছিলেন এক তান্ত্রিক সাধু বাবা। প্রতিটি লাশ পাওয়া গিয়েছে ভৈরব মন্দিরের চত্বরে, সবার হার্টের পেছনে পিঠের দিকে ছিল তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে আরও একটি যোগসূত্র আছে। প্রতিবারই খুনের পর ভৈরব মন্দিরের চূড়ায় আটকানো ত্রিশূলে মিলেছে টাটকা রক্ত। বিংশ শতকেও নরবলি! নাকি আরও জটিল কোনো রহস্য! ব্যাস, খনি এলাকা ভৈরব গড়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাজির টাক মাথার এক বৃদ্ধ।
কিংবা ধরমপুর রিজার্ভ ফরেস্টের রোমাঞ্চকর সেই কাহিনির কথাও বলতে পারি। ভয়ানক চেহারার একটি আফগান হাউন্ডকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছিল সেখানে। তার পরই রাকেশ শর্মা নামের এক ব্যক্তিকে মাছ ধরার সময় কুকুরটা গলা কামড়ে নিয়ে যাওয়ার খবর মিলল। আপাতদৃষ্টিতে একেবারে সোজা-সাপটা কেস। কিন্তু কী ভাগ্য! তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই বৃদ্ধ। আর তদন্তেই বেরিয়ে এল থলের ভেতরের বিড়াল। গল্পটার আরও খানিকটা বলা যেত। কিন্তু তাহলে হয়তো না পড়া থাকলে আগ্রহটা কমে যাবে আপনার!
এই বুড়োর পরিচয় যাঁরা এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি, তাঁদের বলছি, ইনি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনবদ্য সৃষ্টি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বাংলা-ইংরেজি রহস্যসাহিত্য মিলিয়ে হিসাব করলে আমার সবচেয়ে পছন্দের দুই-তিনটি চরিত্রের একটি এই নীলাদ্রি সরকার। মন খারাপ করা ব্যাপার হলো, রহস্যপ্রিয় পাঠকেরা ফেলুদা, শার্লক হোমস, মিস মার্পলের মতো চরিত্রগুলোকে যতটা চেনেন, ততটা চেনেন না নীলাদ্রি সরকারকে। অথচ স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও নীলাদ্রি সরকার চরিত্রটির ভক্ত ছিলেন। এমনকি মুস্তাফা সিরাজকে সন্দেশ পত্রিকায় কর্নেলকে নিয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করে চিঠিও লিখেছিলেন।
বলতে পারেন, নীলাদ্রি সরকার আর দশটা গোয়েন্দা চরিত্রের থেকে একেবারেই আলাদা। গোয়েন্দা বলে পরিচয়ও দেন না নিজের। তবে কথা হলো, রহস্যই সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তার ধ্যান-জ্ঞান। মাথার টাকটা বেশির ভাগ সময় ঢাকা পড়ে থাকে টুপিতে, মুখভর্তি লম্বা সাদা দাড়ি-গোঁফ। বয়সে বৃদ্ধ হলে কী হবে, গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। অনায়াসে পাহাড় বাইতে পারেন, হাঁটতে পারেন অনেকটা পথ, পিঠের কিটব্যাগ থেকে উঁকি দেয় প্রজাপতি ধরার জাল, গলায় ঝোলে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা। প্রথম দেখায় মনে হবে বিদেশি ট্যুরিস্ট, আসলে বাঙালি।
এই চরিত্র সৃষ্টির গল্পটাও ভারি মজার। ১৯৫৬ সালের এক শীতকাল। মুর্শিদাবাদের লালবাগের ঐতিহ্যবাহী হাজার দুয়ারি প্রাসাদে গিয়েছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। হঠাৎ চোখ আটকে গেল সান্তার মতো পাকা গোঁফ-দাড়ির এক বৃদ্ধে। টকটকে ফরসা রং। প্যান্ট-শার্ট পরনে। পিঠে কিটব্যাগ। বাইনোকুলার দিয়ে দূরের কোনো কিছুতে ছিল নজর। মুখ তুলতেই টুপি খসে বেরিয়ে পড়ল টাক, রোদ পড়ে ঝলমল করছিল। হামাগুঁড়ি দিয়ে রহস্যজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন একটা ঝোপের দিকে। আশপাশে ওত পেতে থাকা গাইডদের একজন সামনে উদয় হয়ে বিদেশি ভেবে তাঁকে একটা ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভুলভাল ইংরেজিতে। তখনই বুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে বাংলায় বলে উঠলেন, এই প্রজাপতিগুলো বড্ড সেয়ানা। গাইডের তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়, এমনকি চোখ কপালে মুস্তাফা সিরাজেরও। তিনিও যে এই বৃদ্ধকে বিদেশিই ভেবে বসেছিলেন!
এর বহু বছর পর এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের তাড়ায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে লেখকের মাথায় চলে এল ওই বুড়োর কথা। ব্যাস, তার আদলে বানিয়ে ফেললেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চরিত্রটি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ওই রহস্যোপন্যাসের নাম ‘ছায়া পড়ে’।
কর্নেলকে নিয়ে আরও কিছু লেখার আগে আজ কেন চরিত্রটিকে আপনাদের সামনে হাজির করছি তা বলছি। ২০১২ সালের আজকের দিনে মানে ৪ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নেন কর্নেল চরিত্রের স্রষ্টা ও বইয়ের লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। অর্থাৎ আজ তাঁর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
আবার কর্নেল নীলাদ্রি সরকারে ফিরে আসা যাক। ভারতের কোথাও কোথাও দুর্লভ প্রজাপতি, পাখি, অর্কিড, ক্যাকটাসের খবর পেলেই হলো, হাজির হয়ে যান। তা সেটা যতই দুর্গম পাহাড় কিংবা অরণ্যই হোক না কেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় খেয়াল রহস্যের পিছু নেওয়া। লালবাজারের (কলকাতা পুলিশের প্রধান কার্যালয়) দুঁদে গোয়েন্দারা যেখানে ব্যর্থ, সেখানেই শুরু নীলাদ্রি সরকারের। কখনো তাঁর সাহায্য চাইতে হাজির হয়ে যান গোয়েন্দা বিভাগের ডিসি ডিবি অরিজিৎ লাহিড়ী, কিংবা অন্য কোনো গোয়েন্দা। কর্নেল হয়তো তখন তাঁর ইলিয়ট রোডের তিনতলা দালানটার প্রিয় ছাদবাগানে শত মাইল দূরের কোনো পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা গাছের যত্ন নিচ্ছেন। অতিথিকে অভ্যর্থনা জানায় কর্নেলের একান্ত বিশ্বস্ত ভৃত্য ও গাছ পরিচর্যার সঙ্গী ষষ্ঠীচরণ।
মোটামুটি বেশির ভাগ অভিযানে কর্নেলের সঙ্গে থাকে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরী। দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চারগুলো জয়ন্তর মাধ্যমেই জানতে পারেন পত্রিকার পাঠকেরা। তবে সাংবাদিক হিসেবে তুখোড় হলেও জয়ন্তর রহস্যভেদী বুদ্ধি মোটেই আহামরি কিছু নয়। অবশ্য বেশির ভাগ বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনির পার্শ্ব চরিত্ররাই গল্পের প্রয়োজনে খুরদার বুদ্ধির হন না। কর্নেলের বইগুলোর আরেক অসাধারণ সংযোজন অবসরপ্রাপ্ত দারোগা এবং পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্ত কুমার হালদার। অনেক সময়ই দেখা যায় নিজের কোনো কেসে কিংবা কর্নেলকে সাহায্য করতে গিয়ে নানান অদ্ভুত কাণ্ডকীর্তি ঘটাচ্ছেন হালদার মশাই। পাঠকেরা এসব ঘটনার বর্ণনা পড়ে কখন হাসতে শুরু করেছেন নিজেরাই টের পান না। বলা চলে এই চরিত্রের উপস্থিতি কাহিনিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। মুস্তাফা সিরাজ নিজেই হালদার মশাইকে উল্লেখ করেছেন তাঁর রিলিফ হিসাবে। কে কে হালদারের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার স্টাইলটাও কিন্তু দারুণ।
কর্নেলের বইগুলো পড়তে গিয়ে তার সঙ্গে অসাধারণ সব জায়গায় ভ্রমণও হয়ে যাবে আপনার। আমার যেমনটা হয়। কখনো নেপাল সীমান্তের ডমরু পাহাড়ে, কখনো পার্বত্য শিল্প এলাকা রানীডিহি বা বিহার সীমান্তের খনি এলাকা বারাহিয়া কিংবা ওডিশার সাগর তীরবর্তী গোপালপুর অন সি, চন্দনপুর অন সি, নতুবা ধরমপুরের ধরিয়া ফলসে পৌঁছে যাই। বুড়োর সঙ্গে সারস পাখির খোঁজ করতে গিয়েও রহস্যের পাকে আটকা পড়ি। এসব দুর্গম জায়গায় গিয়ে অসাধারণ সুন্দর কোনো সেচ বাংলো কিংবা সরকারি অন্য কোনো বাংলোয় থাকার সুযোগ হয়ে যায় কর্নেল আর জয়ন্ত চৌধুরীর বদন্যতায়।
তবে কর্নেলের সঙ্গে জোট বাঁধার আগে একটি সাবধানবাণী। খুনোখুনি লেগেই থাকে তাঁর বইয়ে। তাই উত্তেজনার মাত্রাটাও বেশি, কখনো একটু বড়দের উপযোগী ঘটনা কিংবা রগরগে বর্ণনাও থাকে, কিছু বই আবার একেবারেই কিশোর উপযোগী। মোটের ওপর ছেলে-বুড়ো সবার জন্যই ‘কর্নেল’ লেখা হয়েছে। আমার মতো রহস্য ও প্রকৃতিপ্রেমিকের জন্য এর চেয়ে সরস কাহিনি পাওয়া মুশকিল। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন, কেবল পাঁড় গোয়েন্দাকাহিনির ভক্তরা নন, অ্যাডভেঞ্চার কিংবা বন-জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীপ্রেমী পাঠকদের জন্যও অসাধারণ এক চয়েজ হতে পারে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘কর্নেল’। পড়তে পড়তে এতটাই বুঁদ হয়ে যাবেন, মনে হবে আপনিও কাহিনিটির একটি চরিত্র। দেজ পাবলিশার্স থেকে কর্নেলর ১৭টি সমগ্র বের হয়েছে। আর কিশোরসমগ্র বের হয়েছে চারটি।
হাথিয়াগড় জঙ্গল। সেখানে বিশাল এক পাহাড়, নাম কোদণ্ড। ওই পাহাড়-জঙ্গলেই ভয়ানক এক মানুষখেকো বাঘের উৎপাতের খবর পেলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কিন্তু কী আশ্চর্য! বাঘটি শুধু মানুষ মারার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু সেই মানুষগুলোর মৃতদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এদিকে মানুষখেকোর এলাকায় ছোট্ট এক নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কারা? শিবচরণ পাণ্ডে নামে পুরোনো এক বন্ধুর চিঠি পেয়ে রহস্যের গন্ধ পেলেন কর্নেল। হাজির হলেন পাহাড়ি এলাকাটিতে। কিন্তু তিনি সেখানে যেতে না যেতেই পাণ্ডের রক্তাক্ত দেহ খুঁজে পেলেন কর্নেল ও জয়ন্ত। বলা চলে, তাঁদের চোখের সামনেই মারা গেলেন তিনি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল বাঘের আক্রমণেই মারা গেছেন তিনি। কিন্তু কর্নেলকে কি এত সহজে বোকা বানানো যায়? কী পাঠক, আর দেরি কেন, কর্নেলের একটি বই হাতে নিয়ে পড়া শুরু করুন, আর প্রবেশ করুন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের রহস্যভুবনে। ও একটা কথা, শেষ যে কাহিনিটি বললাম, সেটার নাম ‘কোদণ্ড পাহাড়ের বা-রহস্য’।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ছায়া পড়েছে দেশের শিল্পাঙ্গনেও। শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা চর্চার প্রাণকেন্দ্র শিল্পকলা একাডেমিতে চলছিল অস্থিরতা ও কিছুটা স্থবিরতা। সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়েছে কর্তৃপক্ষ। তার অংশ হিসেবে চলছে নানা কার্যক্রম। চীন থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একাডেমির শিল্পীরা গতকাল শনিবার...
২০ ঘণ্টা আগেআকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
৫ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৫ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২২ দিন আগে