সুদেব চক্রবর্তী
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে