প্রমথ চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
নূতন কাগজের নূতন সম্পাদকরা, যখন আমাকে তাদের কাগজের পৃষ্ঠা-পূরণ করতে অনুরোধ করেন, তখন আমি উভয় সংকটে পড়ি। কেন, সে কথা আমি বহু বার বলেছি। আসল কথা, এ ক্ষেত্রে কী লিখব ভেবে পাইনে। আর নূতন সম্পাদকরাও কী লিখতে হবে, তা বলে দেন না। যদি দিতেন, তা হলে আরও মুশকিলে পড়তুম। কারণ, ফরমায়েশি লেখা আমি লিখতে পারিনে। আমার মন এত দূর নমনীয় নয় যে যে-দিকে বাঁকাতে চাই, তখনই সে দিকে তাকে বাঁকাতে পারি। এখন যদি অনুমতি করেন তো আমার লেখার একটু পরিচয় দিই।
আমি এককালে পদ্যও লিখেছি, কিন্তু কেউ আমাকে কবি বলে ভুল করেনি। আমার রচিত সনেটগুলিকে লোকে experiment হিসেবেই ধরে নিয়েছে, আর যদি সে experiment successful হয়ে থাকে, তা হলেও তা experiment মাত্র। অতএব কোন সম্পাদকই আমাকে কবিতা লেখবার ফরমায়েশ করেন না, বিশেষত যখন lisp in numbers করবার তরুণ-তরুণী অসংখ্য আছেন।
আমি গল্পও লিখেছি, কিন্তু সে সব গল্পের মান্য আছে, আদর নেই। অর্থাৎ অনেক লেখক সে গল্পের তারিফ করেন, কিন্তু বাজারে তার কাটতি নেই। তাই আশা করি, সম্পাদক মহাশয়রা আমার কাছে গল্প চান না। এ জ্ঞান তাদের আছে যে গল্প লেখা আমার পক্ষে অনায়াসসাধ্য নয়। কোন কালেই আমি হাত ঝাড়লেই গল্প বেরোত না। আর এ বয়সে প্রেমকে নূতন নূতন সাজে বার করা আমার পক্ষে অসাধ্য। ও-বস্তুকে যে-সাজই পরাই না কেন, তার ভিতর থেকে প্রেমের চিরকেলে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়বে। আর প্রেম বাদ দিয়ে গল্প লেখা, সে সোনা ফেলে আঁচলে গেরো দেওয়া।
সাহিত্যসমাজে জনরব এই যে আমি একজন ক্রিটিক। এ খ্যাতি যে আমার আছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অর্থাৎ যা আমি করিনি, তার জন্যই আমি বিখ্যাত। বাংলায় সমালোচনার অর্থ পুস্তক সমালোচনা। আর আমার যত দূর মনে পড়ে আমি অদ্যাবধি মাত্র দুইখানি বইয়ের সমালোচনা করেছি। এক ‘চিত্রাঙ্গদা’র, আর সম্প্রতি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র! প্রথমখানি কাব্য, আর দ্বিতীয়খানি ভ্রমণ-কাহিনী। চিত্রাঙ্গদা’র সমালোচনা দীর্ঘ ও মহাপ্রস্থানের পথের সমালোচনা হ্রস্ব। এর কারণ আমার বিশ্বাস যে, চিত্রাঙ্গদা অনেক কথার ভার সয়, আর মহাপ্রস্থানের পথে তা সয় না।
প্রথম সমালোচনা সম্বন্ধে জনৈক নবীন সমালোচক এই মত প্রকাশ করেছেন যে, তাতে অনেক কথা আছে, কিন্তু আসল কথা নেই। সম্ভবত এ দোষ সে সমালোচনার আছে। অনেক কথা বলবার দোষ এই যে, বকতে বকতে আসল কথা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আসল কথাটি যে কী, তা নবীন ভাবুক মহাশয় অনুগ্রহ করে পাঠকসমাজকে বলে দেননি। এর থেকে অনুমান করছি যে, এ কাব্যের যে একটি moral আছে, সে বিষয়ে আমি অজ্ঞ বা উদাসীন। কাব্য মাত্রেরই অন্তরে একটি বা একাধিক moral থাকে। এর কারণ কবি মাত্রেই মানুষ—আর মানুষ মাত্রেই ’moral’ চিন্তার অধীন। ফল-মূল-পাতার অন্তরে যে ওষুধ আছে, তা আমরা সকলেই জানি। আর সম্ভবত সেইটিই হচ্ছে ও-সকলের সারবস্তু—কারণ মানুষের মহা উপকারী বস্তু। তা হলেও ফলমূল পিষে আর পাতা নিংড়ে বিষ কিংবা অমৃত বার করা কাব্যরসিকের কাজ নয়, কারণ আলঙ্কারিক ভিষক নন। কাব্যামৃত বলে সংস্কৃতে একটা কথা আছে, কিন্তু এ অমৃত মকরধ্বজ নয়।
মহাপ্রস্থানের পথের সম্বন্ধে যে বেশি কিছু লিখিনি, তার কারণ ও গ্রন্থের লম্বা সমালোচনা করলে সেটা হত, মহাত্মা গান্ধি যাকে বলেন, Himalayan error। আমাদের মতো ক্ষুদ্রাত্মা লেখকদের পর্বতপ্রমাণ ফাঁকা কথা বলবার অধিকার নেই।
ভালো কথা, আমি কলম ধরে প্রথমেই একখানি প্রসিদ্ধ সংস্কৃত কাব্যের (জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এর) সমালোচনা করি। তার পূর্বে আমি কখনও সাদা কাগজের গায়ে বাংলা-কালির আঁচড় কাটিনি। তখন আমি কলেজের ছাত্র; সুতরাং সে প্রবন্ধ যে একাডেমিক পদ্ধতিতে লেখা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সে প্রবন্ধটি সেকালের ’ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, অবশ্য তার অনেক ছাঁটকাট করে। আমি এই কাটাকুটিতে খুব সন্তুষ্ট হইনি। কারণ আমি সেকালেও আমার লেখার উপর কেউ হস্তক্ষেপ করলে প্রসন্ন হতুম না। আমার লেখার জন্য যে একমাত্র আমিই দায়ী, সে জ্ঞান সে বয়েসেও আমার ছিল। আর এ জ্ঞানও আমার ছিল যে, পাঠকের নিন্দা-প্রশংসা কোন লেখার কপালে জুটবে অথবা জুটবে না, তা নির্ভর করে কলমের লেখার উপরে নয়; কপালের লেখার উপরে।
উক্ত লেখাটির প্রতি আমার একটু মায়া ছিল, কারণ সেটি আমার আদি লেখা। তাই তার manuscript-টি আমি সযত্নে রক্ষা করি, এবং বহু কাল পরে সেটি ‘সবুজ পত্র’-এ পুনঃপ্রকাশিত করি। এখন সেটি পড়ে দেখতে পাই, সেই লেখাটিতে আমার লেখার দোষগুণ সবই সমান বর্তমান। আমার লেখার দোষ এই যে, আমার মন সব সময়ে অপরের মতের পশ্চাদ্ধাবন করে না; আর তার গুণ এই যে, আমি যা বলতে চাই তা বাংলায় বলতে পারি—এমনকি সাধু ভাষাতেও। যদিচ আমার মনের ভাষা বিদেশি। উক্ত প্রবন্ধের এ স্থলে উল্লেখ করবার প্রয়োজন এই যে, আমার যদি সত্য-সত্যই critical faculty থাকে, আমার এই আদি লেখাতেই তা পরিস্ফুট হয়েছে।
আর এই দীর্ঘজীবনে কাব্য সম্বন্ধে আমার মতামতের বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। ইংরেজি ভাষায় criticism-এর অর্থ শুধু সাহিত্য সমালোচনা নয়। যদি তা হয় তো Renan-কে ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি অগ্রগণ্য critic বলে ইউরোপের লোকে শ্রদ্ধা করত না; কেননা তিনি কখনও কোন পুস্তক সমালোচনা করেননি। অবশ্য Biblical Criticism-কে কেউ আর সাহিত্য সমালোচনা বলেন না।
ইংলন্ডের জনৈক বড় critic, Mathew Arnold তো সাহিত্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন criticism of life। এ কথার অর্থ নিয়ে ইংলন্ডের সাহিত্য সমাজে বহু আলোচনা হয়েছে। অবশ্য এ গোলযোগ ঘটেছিল criticism কথাটা নিয়ে। আধুনিক ফরাসি সমালোচকরা বলেন, সাহিত্য হচ্ছে meditation of life। এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ শুনিনি। এর থেকে বোঝা যায় যে, ইউরোপে সাহিত্য মানবজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ শুনিনি। এর থেকে বোঝা যায় যে, ইউরোপে সাহিত্য মানবজাবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
মানুষের মন শুধু সাহিত্যের গণ্ডিবদ্ধ নয়। ধর্ম, পলিটিকস প্রভৃতির সঙ্গে সে মনের যোগাযোগ আছে। বাঙালিদের মনও যে এ সব বিষয় থেকে আলগা নয়, তার প্রমাণ নিত্য তাদের কথাবার্তায় পাওয়া যায়। আমিও অবশ্য নানা বিষয়ে নানা কথা বলেছি, যেমন সামাজিক লোকে নিত্য বলেন। সে সব বলা-কওয়া হচ্ছে আসলে স্ব-সমাজের সঙ্গে কথোপকথন। তবে আমার কথা একটু ভেবে বলা আর একটু গুছিয়ে বলা। সে হচ্ছে এই সব বড়-বড় বিষয়ে শুধু টীকাটিপ্পনী, এক কথায় criticism। এ হিসেবে আমি অবশ্য এক রকম সমালোচক। সে সব কথায় কার কী ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে জানিনে। তবে এইটুকু জানি যে, জীবনের প্রতি, অতএব সাহিত্যের প্রতি আমাদের জাতির critical attitude আজও জন্মায়নি। আজও আমরা পরের কথার পিছনে প্রশ্নচিহ্ন দিতে শিখিনি। সেই জন্য বাংলায় আজও সমালোচনা-সাহিত্য গড়ে ওঠেনি। আমাদের সাহিত্যসমাজে এই criticial বুদ্ধি উদ্বুদ্ধ করবার বোধ হয় একটি সহজ উপায় আছে। প্রতি লেখক যদি নিজের লেখার দোষগুণ নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে শেখেন, তা হলে অপরের লেখাও খুব সম্ভবত সুবিচার করতে শিখবেন। কারণ সকল criticism-এর ভিত্তি হচ্ছে আত্ম-criticism।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
নূতন কাগজের নূতন সম্পাদকরা, যখন আমাকে তাদের কাগজের পৃষ্ঠা-পূরণ করতে অনুরোধ করেন, তখন আমি উভয় সংকটে পড়ি। কেন, সে কথা আমি বহু বার বলেছি। আসল কথা, এ ক্ষেত্রে কী লিখব ভেবে পাইনে। আর নূতন সম্পাদকরাও কী লিখতে হবে, তা বলে দেন না। যদি দিতেন, তা হলে আরও মুশকিলে পড়তুম। কারণ, ফরমায়েশি লেখা আমি লিখতে পারিনে। আমার মন এত দূর নমনীয় নয় যে যে-দিকে বাঁকাতে চাই, তখনই সে দিকে তাকে বাঁকাতে পারি। এখন যদি অনুমতি করেন তো আমার লেখার একটু পরিচয় দিই।
আমি এককালে পদ্যও লিখেছি, কিন্তু কেউ আমাকে কবি বলে ভুল করেনি। আমার রচিত সনেটগুলিকে লোকে experiment হিসেবেই ধরে নিয়েছে, আর যদি সে experiment successful হয়ে থাকে, তা হলেও তা experiment মাত্র। অতএব কোন সম্পাদকই আমাকে কবিতা লেখবার ফরমায়েশ করেন না, বিশেষত যখন lisp in numbers করবার তরুণ-তরুণী অসংখ্য আছেন।
আমি গল্পও লিখেছি, কিন্তু সে সব গল্পের মান্য আছে, আদর নেই। অর্থাৎ অনেক লেখক সে গল্পের তারিফ করেন, কিন্তু বাজারে তার কাটতি নেই। তাই আশা করি, সম্পাদক মহাশয়রা আমার কাছে গল্প চান না। এ জ্ঞান তাদের আছে যে গল্প লেখা আমার পক্ষে অনায়াসসাধ্য নয়। কোন কালেই আমি হাত ঝাড়লেই গল্প বেরোত না। আর এ বয়সে প্রেমকে নূতন নূতন সাজে বার করা আমার পক্ষে অসাধ্য। ও-বস্তুকে যে-সাজই পরাই না কেন, তার ভিতর থেকে প্রেমের চিরকেলে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়বে। আর প্রেম বাদ দিয়ে গল্প লেখা, সে সোনা ফেলে আঁচলে গেরো দেওয়া।
সাহিত্যসমাজে জনরব এই যে আমি একজন ক্রিটিক। এ খ্যাতি যে আমার আছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অর্থাৎ যা আমি করিনি, তার জন্যই আমি বিখ্যাত। বাংলায় সমালোচনার অর্থ পুস্তক সমালোচনা। আর আমার যত দূর মনে পড়ে আমি অদ্যাবধি মাত্র দুইখানি বইয়ের সমালোচনা করেছি। এক ‘চিত্রাঙ্গদা’র, আর সম্প্রতি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র! প্রথমখানি কাব্য, আর দ্বিতীয়খানি ভ্রমণ-কাহিনী। চিত্রাঙ্গদা’র সমালোচনা দীর্ঘ ও মহাপ্রস্থানের পথের সমালোচনা হ্রস্ব। এর কারণ আমার বিশ্বাস যে, চিত্রাঙ্গদা অনেক কথার ভার সয়, আর মহাপ্রস্থানের পথে তা সয় না।
প্রথম সমালোচনা সম্বন্ধে জনৈক নবীন সমালোচক এই মত প্রকাশ করেছেন যে, তাতে অনেক কথা আছে, কিন্তু আসল কথা নেই। সম্ভবত এ দোষ সে সমালোচনার আছে। অনেক কথা বলবার দোষ এই যে, বকতে বকতে আসল কথা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আসল কথাটি যে কী, তা নবীন ভাবুক মহাশয় অনুগ্রহ করে পাঠকসমাজকে বলে দেননি। এর থেকে অনুমান করছি যে, এ কাব্যের যে একটি moral আছে, সে বিষয়ে আমি অজ্ঞ বা উদাসীন। কাব্য মাত্রেরই অন্তরে একটি বা একাধিক moral থাকে। এর কারণ কবি মাত্রেই মানুষ—আর মানুষ মাত্রেই ’moral’ চিন্তার অধীন। ফল-মূল-পাতার অন্তরে যে ওষুধ আছে, তা আমরা সকলেই জানি। আর সম্ভবত সেইটিই হচ্ছে ও-সকলের সারবস্তু—কারণ মানুষের মহা উপকারী বস্তু। তা হলেও ফলমূল পিষে আর পাতা নিংড়ে বিষ কিংবা অমৃত বার করা কাব্যরসিকের কাজ নয়, কারণ আলঙ্কারিক ভিষক নন। কাব্যামৃত বলে সংস্কৃতে একটা কথা আছে, কিন্তু এ অমৃত মকরধ্বজ নয়।
মহাপ্রস্থানের পথের সম্বন্ধে যে বেশি কিছু লিখিনি, তার কারণ ও গ্রন্থের লম্বা সমালোচনা করলে সেটা হত, মহাত্মা গান্ধি যাকে বলেন, Himalayan error। আমাদের মতো ক্ষুদ্রাত্মা লেখকদের পর্বতপ্রমাণ ফাঁকা কথা বলবার অধিকার নেই।
ভালো কথা, আমি কলম ধরে প্রথমেই একখানি প্রসিদ্ধ সংস্কৃত কাব্যের (জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এর) সমালোচনা করি। তার পূর্বে আমি কখনও সাদা কাগজের গায়ে বাংলা-কালির আঁচড় কাটিনি। তখন আমি কলেজের ছাত্র; সুতরাং সে প্রবন্ধ যে একাডেমিক পদ্ধতিতে লেখা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সে প্রবন্ধটি সেকালের ’ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, অবশ্য তার অনেক ছাঁটকাট করে। আমি এই কাটাকুটিতে খুব সন্তুষ্ট হইনি। কারণ আমি সেকালেও আমার লেখার উপর কেউ হস্তক্ষেপ করলে প্রসন্ন হতুম না। আমার লেখার জন্য যে একমাত্র আমিই দায়ী, সে জ্ঞান সে বয়েসেও আমার ছিল। আর এ জ্ঞানও আমার ছিল যে, পাঠকের নিন্দা-প্রশংসা কোন লেখার কপালে জুটবে অথবা জুটবে না, তা নির্ভর করে কলমের লেখার উপরে নয়; কপালের লেখার উপরে।
উক্ত লেখাটির প্রতি আমার একটু মায়া ছিল, কারণ সেটি আমার আদি লেখা। তাই তার manuscript-টি আমি সযত্নে রক্ষা করি, এবং বহু কাল পরে সেটি ‘সবুজ পত্র’-এ পুনঃপ্রকাশিত করি। এখন সেটি পড়ে দেখতে পাই, সেই লেখাটিতে আমার লেখার দোষগুণ সবই সমান বর্তমান। আমার লেখার দোষ এই যে, আমার মন সব সময়ে অপরের মতের পশ্চাদ্ধাবন করে না; আর তার গুণ এই যে, আমি যা বলতে চাই তা বাংলায় বলতে পারি—এমনকি সাধু ভাষাতেও। যদিচ আমার মনের ভাষা বিদেশি। উক্ত প্রবন্ধের এ স্থলে উল্লেখ করবার প্রয়োজন এই যে, আমার যদি সত্য-সত্যই critical faculty থাকে, আমার এই আদি লেখাতেই তা পরিস্ফুট হয়েছে।
আর এই দীর্ঘজীবনে কাব্য সম্বন্ধে আমার মতামতের বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। ইংরেজি ভাষায় criticism-এর অর্থ শুধু সাহিত্য সমালোচনা নয়। যদি তা হয় তো Renan-কে ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি অগ্রগণ্য critic বলে ইউরোপের লোকে শ্রদ্ধা করত না; কেননা তিনি কখনও কোন পুস্তক সমালোচনা করেননি। অবশ্য Biblical Criticism-কে কেউ আর সাহিত্য সমালোচনা বলেন না।
ইংলন্ডের জনৈক বড় critic, Mathew Arnold তো সাহিত্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন criticism of life। এ কথার অর্থ নিয়ে ইংলন্ডের সাহিত্য সমাজে বহু আলোচনা হয়েছে। অবশ্য এ গোলযোগ ঘটেছিল criticism কথাটা নিয়ে। আধুনিক ফরাসি সমালোচকরা বলেন, সাহিত্য হচ্ছে meditation of life। এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ শুনিনি। এর থেকে বোঝা যায় যে, ইউরোপে সাহিত্য মানবজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ শুনিনি। এর থেকে বোঝা যায় যে, ইউরোপে সাহিত্য মানবজাবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
মানুষের মন শুধু সাহিত্যের গণ্ডিবদ্ধ নয়। ধর্ম, পলিটিকস প্রভৃতির সঙ্গে সে মনের যোগাযোগ আছে। বাঙালিদের মনও যে এ সব বিষয় থেকে আলগা নয়, তার প্রমাণ নিত্য তাদের কথাবার্তায় পাওয়া যায়। আমিও অবশ্য নানা বিষয়ে নানা কথা বলেছি, যেমন সামাজিক লোকে নিত্য বলেন। সে সব বলা-কওয়া হচ্ছে আসলে স্ব-সমাজের সঙ্গে কথোপকথন। তবে আমার কথা একটু ভেবে বলা আর একটু গুছিয়ে বলা। সে হচ্ছে এই সব বড়-বড় বিষয়ে শুধু টীকাটিপ্পনী, এক কথায় criticism। এ হিসেবে আমি অবশ্য এক রকম সমালোচক। সে সব কথায় কার কী ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে জানিনে। তবে এইটুকু জানি যে, জীবনের প্রতি, অতএব সাহিত্যের প্রতি আমাদের জাতির critical attitude আজও জন্মায়নি। আজও আমরা পরের কথার পিছনে প্রশ্নচিহ্ন দিতে শিখিনি। সেই জন্য বাংলায় আজও সমালোচনা-সাহিত্য গড়ে ওঠেনি। আমাদের সাহিত্যসমাজে এই criticial বুদ্ধি উদ্বুদ্ধ করবার বোধ হয় একটি সহজ উপায় আছে। প্রতি লেখক যদি নিজের লেখার দোষগুণ নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে শেখেন, তা হলে অপরের লেখাও খুব সম্ভবত সুবিচার করতে শিখবেন। কারণ সকল criticism-এর ভিত্তি হচ্ছে আত্ম-criticism।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে