সৈকত দে
১
আমাদের জীবন আয়নাজীবন। আয়না আমাদের উল্টো করে দেখায় আমাদের সত্যি চেহারা, উল্টো আমাদের দেখায় সোজা করে। নারীর কাছে আয়না নিভৃত আশ্রয়। নির্জন বন্ধু নারীর এই আয়না, সারা জীবনের সঙ্গে জড়ানো বিশ্বস্ত সঙ্গী। আধুনিক বিবাহব্যবস্থার শিকার, নিজস্ব ভূমি থেকে শিকড় উৎপাটিত কন্যা যখন পরিবার অথবা নিজের নির্ধারিত জীবনসঙ্গীর কাছে যায়, পরিবারের দেওয়া সাজের বাক্সে থাকে আয়না। বিয়ের আগের ও পরের জীবনের যোগসূত্র নারীর কাছে আয়না। তার একান্ত কান্না, আন্তরিক হাসি—সবকিছুর একমাত্র দর্শক আয়না। নারীর রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধান পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো আয়নাই পেয়েছে। পুরাণে নার্সিসাসের কথা আছে। রূপমুগ্ধ এক মানুষ। তিনি সভ্যতার প্রথম সেলিব্রেটেড শিল্পী, এই সেলিব্রেশন নিজের কাছেই, নিজের অবিনশ্বর সত্তার কাছে। আত্মমগ্নতা, বলা ভালো আত্মরতি শিল্পীর পক্ষে কতটা বিপদের, পুরাণ আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। মানবসভ্যতাকে প্রকৃতি প্রথম উপহার দিয়েছে সুর আর তারপর আয়না। পৃথিবীর তিন ভাগ জল। জল মূলত আয়না। আকাশ আর মাটির যোগাযোগের চিহ্ন জলের বুকে। মানুষ পাখির ডাক থেকে, জলের ধাবমান শব্দ থেকে সংগীতের সুর নিয়েছে।
ইশারাভাষা থেকে মানুষ গিয়েছে গুহাচিত্রে আঁকার দিকে আর পাখির ডাক থেকে নিতে চেয়েছে সুরের দিকটা। শিল্পসন্ধানী মানুষের প্রয়োজন হয়েছে প্রকৃতিকে, নিজের চারপাশে দেখা জগৎকে নিজের মতো করে অনুবাদ করার। তখন এল ‘মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোকে’র কথা, আলোর অদৃশ্য রেখাকে মানুষ ধরল দৃশ্যমান রেখায়। আর রেখার সূত্রমালা জন্ম দিল নানা রকম আকৃতির আয়নার। গোল, লম্বাটে, চার কোনা আয়নার আকৃতির বিচিত্র বিবর্তন নিয়েই এখন অসংখ্য বই রচিত হয়ে গিয়েছে। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ নামক মহৎ গ্রন্থটিতে শরীর ব্যবহারের ইতিহাসে আয়নাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শরীর অন্য শরীরের সাথে সংযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আনন্দ বিকিরণে, বিচ্ছুরণে সক্ষম। আয়না বাসনাকেও বিবর্ধিত চেহারায় দেখায়। মোগল সম্রাটদের আবাসস্থল, শয্যাকক্ষ আয়নায় সজ্জিত ছিল। ‘সিটি অব উইমেন’ চলচ্চিত্রে আমাদের অনেকেরই মনে আছে, আয়নাবহুল সেই বিখ্যাত দৃশ্যের কথা। মোগল, রাজপুত নারীদের ইতিহাসে অনুচ্চারিত আনন্দ-বেদনার গল্প আমরা পেতে পারতাম, যদি আয়নার ভাষা আমরা বুঝতে পারতাম। মোগল মিনিয়েচার চিত্রেও আয়নার উপস্থিতি সাবলীল। ইউরোপের ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের তুলি সম্ভবত প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছে আয়নার ভাষা, এই শিল্পীরাই মানুষের সাথে আয়নার যোগাযোগের প্রকৃত চেহারাটি হয়তো খুঁজে পেলেন। আমরা ক্লদ মোনের পদ্ম সমারোহ তো ভুলে যাইনি। পৃথিবীর সমূহ জলভাগ আকাশকে এইভাবেই তো প্রেমের চিঠি, সংরাগের চিঠি লিখেছে।
২
সুফি সাধকেরা নিজের ভেতরটাকেই আয়নার মতো স্বচ্ছ করে তুলতে চেয়েছেন। ঈশ্বরের সাথে নিজেদের লুপ্ত করে ফেলতে চেয়েছেন। ইশক বা প্রেমের চূড়ান্ত পরিস্থিতি এই—পরস্পরে লীন হয়ে যাওয়া। পরস্পরের যে আলাদা সত্তা, স্রষ্টা ও তাঁর সৃজন, বাসনাকারী ও প্রার্থনার লক্ষ্য—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ফারাক নেই সুফিদের কাছে। সুফি সাধকদের উল্টো দিকের চেহারা আছে আমাদের রূপকথায়। আমরা জানি, এই মর্ত্যপৃথিবীর সকল রূপকথা, লোককথা পরস্পর সংযুক্ত, উড়ন্ত ঘোড়া এক লহমায় ঘুরে আসতে পারে সারা দুনিয়া। আয়নায় নিজের মুখ দেখা সেই নিষ্ঠুর রাজকন্যার কথাও আমাদের ছেলেবেলার বেড়ে ওঠার সাথে যুক্ত, ‘বল তো আয়না, কে বেশি সুন্দরী?’, আয়নার উত্তরের সাথে সাথে আমাদের চেনাজানা রূপকথার গল্প শুরু হয়ে যায়। আয়নার আছে শ্রেণিচরিত্র, যেমন সুয়োরানি আর দুয়োরানি, এই দুইয়ের আয়নার চরিত্র দুই রকম। আরব্য রজনীর গল্পে আয়নার ভূমিকা অবিসংবাদিত। আয়না এখানে বার্তাবাহক। প্রাচ্যের আর পাশ্চাত্যের রূপকথার মধ্যে আয়নার প্রয়োগ একই রকম। ছোট হাত-আয়নার পেছনে চিত্রনায়িকাদের ছবি কত একলা যুবকের বন্ধু হয়েছিল সেই ষাট-সত্তর দশকের দিনগুলোতে। বিনোদনের এত উপায় বা পদ্ধতি যখন ছিল না, তখন আয়না কিংবা চোখ সম্বল করে কেবল প্রকৃতি দেখে যাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষের আনন্দের উপকরণ ছিল। আমাদের দাদারা দাদিদের এক টুকরো রঙিন আয়না দিলেই দাম্পত্য সম্পর্কে মধুর রসের সঞ্চার করতে পারতেন; কেননা সেই কাচের টুকরোয় থাকত নবযুবকের ভালোবাসা। গ্রামের মেলায় কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতের সাথে ছোট আয়না এখনো অনেক অকথিত ইতিহাসের জন্ম দিতে পারে।
৩
সুইডিশ নির্মাতা ইংমার ব্যারিম্যানের কথায় আসা যাক। তিনি আক্ষেপ করছিলেন একবার, ‘হোয়াট ডু আই সে, উইথ মাই ক্লাউন অ্যাক্ট, হোয়াইল দ্য ওয়ার্ল্ড ইন বার্নিং?’, এই জ্বলতে থাকা নশ্বর অস্তিত্বের সাথে তিনি বোঝাপড়া করে নিয়েছিলেন মঞ্চনাটক এবং সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমে। ছেলেবেলায় মা-বাবার যে পিটুনির ট্রমা, তা তাঁকে বড়বেলাতেও ছেড়ে যায়নি, ঘুমের মধ্যেও এসব স্মৃতি তাঁকে আক্রান্ত করত। কাজের মধ্য দিয়েই তিনি এই পরিস্থিতি অতিক্রমের চেষ্টা করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকেই তিনি বিশ্ব সিনেমার পরিচিত মুখ, কিংবদন্তিপ্রতিম। ‘সামার উইথ মনিকা’, তেপ্পান্ন সালের সিনেমা, মুক্তির পর কেউ কেউ একে চিহ্নিত করলেন আধুনিক সিনেমার জন্মদিন বলে। ক্যামেরার দিকে সোজা তাকিয়ে কথা বলার প্রথা তাঁর আগে ছিল না তো। বছরে চারটে মঞ্চনাটক আর গ্রীষ্মে একটা সিনেমার রুটিনে বেশ কিছুদিন থাকার পর ব্যারিমান পড়লেন অস্তিত্বের সংকটে। ‘পারসোনা’ চলচ্চিত্রের আগে দেখা গেল মনের এই জটিলতা। এই সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘...আর আমি কেবল এইমাত্র বলতে পারি, পারসোনা একটা অতি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জন্মেছে, একধরনের সত্যের সংকটের মধ্য থেকে। শেষ পর্যন্ত আমার মনে হলো, নীরবতাই একমাত্র সত্য হতে পারে।’ মিথ্যার জগৎ নির্মাণ আর সত্যের প্রতি আমর্ম বাসনা ব্যারিমানের কাজ ও সমগ্র জীবনের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ‘তিনি সত্য না বলায় একধরনের পেশাগত গর্ব অনুভব করতেন’—কথাটা বলছেন ব্যারিমান ফাউন্ডেশনের পরিচালক। আমরা জানি, আয়না আমাদের সত্য বলে না। ব্যারিম্যান অন্য, হাতে গোনা মহৎ পরিচালকদের মতোই ছিলেন আয়নামানুষ। তিনি বলেন, ‘আমি অনুভব করতে পারি, সংযোগের একটা অনিবার্য প্রয়োজন থেকেই আমার ফিল্মগুলো জন্মায়।’ একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘শিল্প সব সময়ই একটা আয়না। এবং তোমাকে অবশ্যই শিখতে হবে আয়নাটা কেমন করে ধরতে হয়। যদি তুমি ভয়ে কাঁপতে থাকো, আয়না আউট অব ফোকাস হয়ে যাবে।’ স্বপ্ন ব্যারিম্যানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁর চরিত্রদের স্বপ্ন তাড়া করে, নিপীড়িত হওয়ার স্মৃতি কিংবা ভয়।
স্বপ্ন সব সময়ই বিপদের। স্বপ্ন দেখা বিপদের জিনিস। এ জন্যই দুঃস্বপ্ন এমনি স্বপ্নের চেয়ে অনেক ইন্টারেস্টিং, ওই বিপদের কারণেই। স্বপ্নের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া পুরোটাই তো অবচেতনের আয়না। আমরা যা দেখি সচেতন জাগরণে, স্বপ্ন সেসব দেখায় আমাদের। আমাদের চূড়ান্ত অর্থহীন কল্পনা কিংবা স্বপ্নেরাও তাই অর্থের বাইরে যেতে পারে না। আমাদের নিশ্চয়ই ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’-এর বৃদ্ধ অধ্যাপককে মনে আছে। পারসোনা সিনেমার প্রথম নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সিনেমাটোগ্রাফ’। এই সিনেমা ছেষট্টির অক্টোবরে মুক্তি পায়, অস্তিত্বের অসহ ভার থেকে ব্যারিম্যান উদ্ধার পান। প্রসঙ্গত, লিভ উলম্যানের একটা স্মৃতিচারণার অংশবিশেষের দিকে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি, ‘শুটিংয়ের সময়, আমি ভাবতাম, লোকটা সব সময়ই ক্যামেরার পাশে, সে সব সময়ই আমাকে দেখেই চলেছে।...তারপর এক বিকেলে আমি আর ইংমার হাঁটতে হাঁটতে এক পাথরের ওপর বসলাম, এইখানটাতেই পরে তিনি বাড়ি বানিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন তখন, “লিভ, আই হ্যাড আ ড্রিম লাস্ট নাইট। আই ড্রেমট দ্যাট দ্য টু অব আস ওয়্যার পেইনফুলি ম্যারিড।” শেষ শব্দ দুটোর সঠিক অভিঘাত বাংলায় আনতে অক্ষম বলে ইংরেজিটাই তুলে দিলাম। পেইনফুলি ম্যারিড এই দম্পতি, পরবর্তী পাঁচ বছর অত্যন্ত সুখে পরস্পরের সাথে কাটান। তারপর তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। নিজেদের যৌথ মালিকানাধীন আয়না একদিন ভেঙেচুরে যায় পৃথিবীর দম্পতিদের।
৪
জাফর পানাহির ‘দ্য মিরর’ চলচ্চিত্রের কন্যাশিশুটিকে কার কার মনে আছে? ক্লাস টুয়ের মেয়েটিকে নিতে মা আসেননি একদিন, সে বাড়ি ফেরার জন্যে সিনেমার অর্ধেকজুড়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমান্তরালে চলছে সাউথ কোরিয়া আর ইরানের ফুটবল খেলা। অর্ধেক সিনেমা যেতে যেতে, মেয়েটি যখন নগরের রাস্তায় আর বাসে, ট্যাক্সিতে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন একসময় আমরা দেখলাম, এটা আসলে সিনেমা, বাস থেকে কন্যা নেমে আসে অভিনয়ে অসম্মতি জানিয়ে, কেননা পুরো সিনেমাজুড়ে সে কাঁদতে চায় না, উদ্বিগ্ন থাকতে চায় না। পরিচালক তখন বাস্তবের শিশুটির বাড়ি ফেরাটির চিত্রায়ণ করতে থাকেন। সিনেমা আর বাস্তব এখানে একাকার। আয়না নাম এইখানে সুন্দর হয়ে ওঠে, সিনেমার দুটো অংশ পরস্পরের প্রতিফলন। আমাদের স্বপ্নদৃশ্যের মতো। গত জন্মের প্রেমিকারাও এখানে ফিরে আসতে পারে, ফিরে আসতে পারে চলে যাওয়া বউ, আপনি সুন্দর সংসার পেতে বসতে পারেন, কোনো একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আমরা দেখি, একা ঘরে শুয়ে আছে আমার সহনাগরিক। আয়না এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে আয়না এক ভিন্ন মাত্রা, অন্য স্তরের কথা বলে। আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘মিরর’ নিজের জীবনের সর্বাধিক প্রতিফলিত করেছে। নিজের জীবনের স্মৃতিকথা, নিজের বেড়ে ওঠা বলতে ওঠা বলতে গিয়ে তিনি ‘আয়না’ নামটি বেছে নিয়েছেন। অতটা বিখ্যাত নয় কবি আন্দ্রেই তারকোভস্কির সুপুত্র আন্দ্রেই বাবার কবিতা এই চলচ্চিত্রে এমনভাবে ব্যবহার করেন, কখনো কখনো বিভ্রম জাগে, এটা বাবাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নয় তো! আমাদের অবাক লাগে, যখন দেখি মা আর স্ত্রী চরিত্রে একই অভিনেত্রী অভিনয় করছেন। তারকোভস্কির দিনপঞ্জি ঘাঁটতে গেলে এই রহস্যের তল পাওয়া যাবে। এই রহস্য আগ্রহীদের জন্য তোলা থাক। যারা দিনপঞ্জিযাত্রায় যাব, তারাই উপলব্ধি করতে পারব বিশ্ব চলচ্চিত্রে আয়না রহস্যের অম্লমধুর রস।
১
আমাদের জীবন আয়নাজীবন। আয়না আমাদের উল্টো করে দেখায় আমাদের সত্যি চেহারা, উল্টো আমাদের দেখায় সোজা করে। নারীর কাছে আয়না নিভৃত আশ্রয়। নির্জন বন্ধু নারীর এই আয়না, সারা জীবনের সঙ্গে জড়ানো বিশ্বস্ত সঙ্গী। আধুনিক বিবাহব্যবস্থার শিকার, নিজস্ব ভূমি থেকে শিকড় উৎপাটিত কন্যা যখন পরিবার অথবা নিজের নির্ধারিত জীবনসঙ্গীর কাছে যায়, পরিবারের দেওয়া সাজের বাক্সে থাকে আয়না। বিয়ের আগের ও পরের জীবনের যোগসূত্র নারীর কাছে আয়না। তার একান্ত কান্না, আন্তরিক হাসি—সবকিছুর একমাত্র দর্শক আয়না। নারীর রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধান পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো আয়নাই পেয়েছে। পুরাণে নার্সিসাসের কথা আছে। রূপমুগ্ধ এক মানুষ। তিনি সভ্যতার প্রথম সেলিব্রেটেড শিল্পী, এই সেলিব্রেশন নিজের কাছেই, নিজের অবিনশ্বর সত্তার কাছে। আত্মমগ্নতা, বলা ভালো আত্মরতি শিল্পীর পক্ষে কতটা বিপদের, পুরাণ আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। মানবসভ্যতাকে প্রকৃতি প্রথম উপহার দিয়েছে সুর আর তারপর আয়না। পৃথিবীর তিন ভাগ জল। জল মূলত আয়না। আকাশ আর মাটির যোগাযোগের চিহ্ন জলের বুকে। মানুষ পাখির ডাক থেকে, জলের ধাবমান শব্দ থেকে সংগীতের সুর নিয়েছে।
ইশারাভাষা থেকে মানুষ গিয়েছে গুহাচিত্রে আঁকার দিকে আর পাখির ডাক থেকে নিতে চেয়েছে সুরের দিকটা। শিল্পসন্ধানী মানুষের প্রয়োজন হয়েছে প্রকৃতিকে, নিজের চারপাশে দেখা জগৎকে নিজের মতো করে অনুবাদ করার। তখন এল ‘মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোকে’র কথা, আলোর অদৃশ্য রেখাকে মানুষ ধরল দৃশ্যমান রেখায়। আর রেখার সূত্রমালা জন্ম দিল নানা রকম আকৃতির আয়নার। গোল, লম্বাটে, চার কোনা আয়নার আকৃতির বিচিত্র বিবর্তন নিয়েই এখন অসংখ্য বই রচিত হয়ে গিয়েছে। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ নামক মহৎ গ্রন্থটিতে শরীর ব্যবহারের ইতিহাসে আয়নাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শরীর অন্য শরীরের সাথে সংযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আনন্দ বিকিরণে, বিচ্ছুরণে সক্ষম। আয়না বাসনাকেও বিবর্ধিত চেহারায় দেখায়। মোগল সম্রাটদের আবাসস্থল, শয্যাকক্ষ আয়নায় সজ্জিত ছিল। ‘সিটি অব উইমেন’ চলচ্চিত্রে আমাদের অনেকেরই মনে আছে, আয়নাবহুল সেই বিখ্যাত দৃশ্যের কথা। মোগল, রাজপুত নারীদের ইতিহাসে অনুচ্চারিত আনন্দ-বেদনার গল্প আমরা পেতে পারতাম, যদি আয়নার ভাষা আমরা বুঝতে পারতাম। মোগল মিনিয়েচার চিত্রেও আয়নার উপস্থিতি সাবলীল। ইউরোপের ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের তুলি সম্ভবত প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছে আয়নার ভাষা, এই শিল্পীরাই মানুষের সাথে আয়নার যোগাযোগের প্রকৃত চেহারাটি হয়তো খুঁজে পেলেন। আমরা ক্লদ মোনের পদ্ম সমারোহ তো ভুলে যাইনি। পৃথিবীর সমূহ জলভাগ আকাশকে এইভাবেই তো প্রেমের চিঠি, সংরাগের চিঠি লিখেছে।
২
সুফি সাধকেরা নিজের ভেতরটাকেই আয়নার মতো স্বচ্ছ করে তুলতে চেয়েছেন। ঈশ্বরের সাথে নিজেদের লুপ্ত করে ফেলতে চেয়েছেন। ইশক বা প্রেমের চূড়ান্ত পরিস্থিতি এই—পরস্পরে লীন হয়ে যাওয়া। পরস্পরের যে আলাদা সত্তা, স্রষ্টা ও তাঁর সৃজন, বাসনাকারী ও প্রার্থনার লক্ষ্য—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ফারাক নেই সুফিদের কাছে। সুফি সাধকদের উল্টো দিকের চেহারা আছে আমাদের রূপকথায়। আমরা জানি, এই মর্ত্যপৃথিবীর সকল রূপকথা, লোককথা পরস্পর সংযুক্ত, উড়ন্ত ঘোড়া এক লহমায় ঘুরে আসতে পারে সারা দুনিয়া। আয়নায় নিজের মুখ দেখা সেই নিষ্ঠুর রাজকন্যার কথাও আমাদের ছেলেবেলার বেড়ে ওঠার সাথে যুক্ত, ‘বল তো আয়না, কে বেশি সুন্দরী?’, আয়নার উত্তরের সাথে সাথে আমাদের চেনাজানা রূপকথার গল্প শুরু হয়ে যায়। আয়নার আছে শ্রেণিচরিত্র, যেমন সুয়োরানি আর দুয়োরানি, এই দুইয়ের আয়নার চরিত্র দুই রকম। আরব্য রজনীর গল্পে আয়নার ভূমিকা অবিসংবাদিত। আয়না এখানে বার্তাবাহক। প্রাচ্যের আর পাশ্চাত্যের রূপকথার মধ্যে আয়নার প্রয়োগ একই রকম। ছোট হাত-আয়নার পেছনে চিত্রনায়িকাদের ছবি কত একলা যুবকের বন্ধু হয়েছিল সেই ষাট-সত্তর দশকের দিনগুলোতে। বিনোদনের এত উপায় বা পদ্ধতি যখন ছিল না, তখন আয়না কিংবা চোখ সম্বল করে কেবল প্রকৃতি দেখে যাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষের আনন্দের উপকরণ ছিল। আমাদের দাদারা দাদিদের এক টুকরো রঙিন আয়না দিলেই দাম্পত্য সম্পর্কে মধুর রসের সঞ্চার করতে পারতেন; কেননা সেই কাচের টুকরোয় থাকত নবযুবকের ভালোবাসা। গ্রামের মেলায় কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতের সাথে ছোট আয়না এখনো অনেক অকথিত ইতিহাসের জন্ম দিতে পারে।
৩
সুইডিশ নির্মাতা ইংমার ব্যারিম্যানের কথায় আসা যাক। তিনি আক্ষেপ করছিলেন একবার, ‘হোয়াট ডু আই সে, উইথ মাই ক্লাউন অ্যাক্ট, হোয়াইল দ্য ওয়ার্ল্ড ইন বার্নিং?’, এই জ্বলতে থাকা নশ্বর অস্তিত্বের সাথে তিনি বোঝাপড়া করে নিয়েছিলেন মঞ্চনাটক এবং সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমে। ছেলেবেলায় মা-বাবার যে পিটুনির ট্রমা, তা তাঁকে বড়বেলাতেও ছেড়ে যায়নি, ঘুমের মধ্যেও এসব স্মৃতি তাঁকে আক্রান্ত করত। কাজের মধ্য দিয়েই তিনি এই পরিস্থিতি অতিক্রমের চেষ্টা করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকেই তিনি বিশ্ব সিনেমার পরিচিত মুখ, কিংবদন্তিপ্রতিম। ‘সামার উইথ মনিকা’, তেপ্পান্ন সালের সিনেমা, মুক্তির পর কেউ কেউ একে চিহ্নিত করলেন আধুনিক সিনেমার জন্মদিন বলে। ক্যামেরার দিকে সোজা তাকিয়ে কথা বলার প্রথা তাঁর আগে ছিল না তো। বছরে চারটে মঞ্চনাটক আর গ্রীষ্মে একটা সিনেমার রুটিনে বেশ কিছুদিন থাকার পর ব্যারিমান পড়লেন অস্তিত্বের সংকটে। ‘পারসোনা’ চলচ্চিত্রের আগে দেখা গেল মনের এই জটিলতা। এই সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘...আর আমি কেবল এইমাত্র বলতে পারি, পারসোনা একটা অতি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জন্মেছে, একধরনের সত্যের সংকটের মধ্য থেকে। শেষ পর্যন্ত আমার মনে হলো, নীরবতাই একমাত্র সত্য হতে পারে।’ মিথ্যার জগৎ নির্মাণ আর সত্যের প্রতি আমর্ম বাসনা ব্যারিমানের কাজ ও সমগ্র জীবনের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ‘তিনি সত্য না বলায় একধরনের পেশাগত গর্ব অনুভব করতেন’—কথাটা বলছেন ব্যারিমান ফাউন্ডেশনের পরিচালক। আমরা জানি, আয়না আমাদের সত্য বলে না। ব্যারিম্যান অন্য, হাতে গোনা মহৎ পরিচালকদের মতোই ছিলেন আয়নামানুষ। তিনি বলেন, ‘আমি অনুভব করতে পারি, সংযোগের একটা অনিবার্য প্রয়োজন থেকেই আমার ফিল্মগুলো জন্মায়।’ একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘শিল্প সব সময়ই একটা আয়না। এবং তোমাকে অবশ্যই শিখতে হবে আয়নাটা কেমন করে ধরতে হয়। যদি তুমি ভয়ে কাঁপতে থাকো, আয়না আউট অব ফোকাস হয়ে যাবে।’ স্বপ্ন ব্যারিম্যানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁর চরিত্রদের স্বপ্ন তাড়া করে, নিপীড়িত হওয়ার স্মৃতি কিংবা ভয়।
স্বপ্ন সব সময়ই বিপদের। স্বপ্ন দেখা বিপদের জিনিস। এ জন্যই দুঃস্বপ্ন এমনি স্বপ্নের চেয়ে অনেক ইন্টারেস্টিং, ওই বিপদের কারণেই। স্বপ্নের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া পুরোটাই তো অবচেতনের আয়না। আমরা যা দেখি সচেতন জাগরণে, স্বপ্ন সেসব দেখায় আমাদের। আমাদের চূড়ান্ত অর্থহীন কল্পনা কিংবা স্বপ্নেরাও তাই অর্থের বাইরে যেতে পারে না। আমাদের নিশ্চয়ই ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’-এর বৃদ্ধ অধ্যাপককে মনে আছে। পারসোনা সিনেমার প্রথম নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সিনেমাটোগ্রাফ’। এই সিনেমা ছেষট্টির অক্টোবরে মুক্তি পায়, অস্তিত্বের অসহ ভার থেকে ব্যারিম্যান উদ্ধার পান। প্রসঙ্গত, লিভ উলম্যানের একটা স্মৃতিচারণার অংশবিশেষের দিকে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি, ‘শুটিংয়ের সময়, আমি ভাবতাম, লোকটা সব সময়ই ক্যামেরার পাশে, সে সব সময়ই আমাকে দেখেই চলেছে।...তারপর এক বিকেলে আমি আর ইংমার হাঁটতে হাঁটতে এক পাথরের ওপর বসলাম, এইখানটাতেই পরে তিনি বাড়ি বানিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন তখন, “লিভ, আই হ্যাড আ ড্রিম লাস্ট নাইট। আই ড্রেমট দ্যাট দ্য টু অব আস ওয়্যার পেইনফুলি ম্যারিড।” শেষ শব্দ দুটোর সঠিক অভিঘাত বাংলায় আনতে অক্ষম বলে ইংরেজিটাই তুলে দিলাম। পেইনফুলি ম্যারিড এই দম্পতি, পরবর্তী পাঁচ বছর অত্যন্ত সুখে পরস্পরের সাথে কাটান। তারপর তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। নিজেদের যৌথ মালিকানাধীন আয়না একদিন ভেঙেচুরে যায় পৃথিবীর দম্পতিদের।
৪
জাফর পানাহির ‘দ্য মিরর’ চলচ্চিত্রের কন্যাশিশুটিকে কার কার মনে আছে? ক্লাস টুয়ের মেয়েটিকে নিতে মা আসেননি একদিন, সে বাড়ি ফেরার জন্যে সিনেমার অর্ধেকজুড়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমান্তরালে চলছে সাউথ কোরিয়া আর ইরানের ফুটবল খেলা। অর্ধেক সিনেমা যেতে যেতে, মেয়েটি যখন নগরের রাস্তায় আর বাসে, ট্যাক্সিতে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন একসময় আমরা দেখলাম, এটা আসলে সিনেমা, বাস থেকে কন্যা নেমে আসে অভিনয়ে অসম্মতি জানিয়ে, কেননা পুরো সিনেমাজুড়ে সে কাঁদতে চায় না, উদ্বিগ্ন থাকতে চায় না। পরিচালক তখন বাস্তবের শিশুটির বাড়ি ফেরাটির চিত্রায়ণ করতে থাকেন। সিনেমা আর বাস্তব এখানে একাকার। আয়না নাম এইখানে সুন্দর হয়ে ওঠে, সিনেমার দুটো অংশ পরস্পরের প্রতিফলন। আমাদের স্বপ্নদৃশ্যের মতো। গত জন্মের প্রেমিকারাও এখানে ফিরে আসতে পারে, ফিরে আসতে পারে চলে যাওয়া বউ, আপনি সুন্দর সংসার পেতে বসতে পারেন, কোনো একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আমরা দেখি, একা ঘরে শুয়ে আছে আমার সহনাগরিক। আয়না এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে আয়না এক ভিন্ন মাত্রা, অন্য স্তরের কথা বলে। আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘মিরর’ নিজের জীবনের সর্বাধিক প্রতিফলিত করেছে। নিজের জীবনের স্মৃতিকথা, নিজের বেড়ে ওঠা বলতে ওঠা বলতে গিয়ে তিনি ‘আয়না’ নামটি বেছে নিয়েছেন। অতটা বিখ্যাত নয় কবি আন্দ্রেই তারকোভস্কির সুপুত্র আন্দ্রেই বাবার কবিতা এই চলচ্চিত্রে এমনভাবে ব্যবহার করেন, কখনো কখনো বিভ্রম জাগে, এটা বাবাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নয় তো! আমাদের অবাক লাগে, যখন দেখি মা আর স্ত্রী চরিত্রে একই অভিনেত্রী অভিনয় করছেন। তারকোভস্কির দিনপঞ্জি ঘাঁটতে গেলে এই রহস্যের তল পাওয়া যাবে। এই রহস্য আগ্রহীদের জন্য তোলা থাক। যারা দিনপঞ্জিযাত্রায় যাব, তারাই উপলব্ধি করতে পারব বিশ্ব চলচ্চিত্রে আয়না রহস্যের অম্লমধুর রস।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে