সমালোচনা

প্রমথ চৌধুরী
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩: ০৫
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩: ২৪

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।

আমরা যারা লিখি, আমরা সকলেই চাই, আমাদের লেখা অপরে সমালোচনা করুক। এর কারণও অতি স্পষ্ট। লেখক মাত্রেই লেখেন পাঠকের জন্য। যদি আমাদের লেখা সম্বন্ধে সকলে নীরব থাকেন তো বুঝতে পারি নে, সে লেখা কেউ পড়েছেন কি না। অপর পক্ষে তার সমালোচনার সাক্ষাৎ পেলেই আমরা এই মনে করে কতকটা স্বস্তি অনুভব করি, অন্তত একজন পাঠকও তা পড়েছেন। সমালোচনা মাত্রই যে স্তুতিবাচক হবে এমন কোনো কথা নেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তার ঠিক উল্টো হয়। কিন্তু সত্য কথা বলতে গেলে, তাতে লেখকদের বড় বেশি আসে যায় না।

আমরা সকলেই অবশ্য প্রশংসালোভী! এবং একজন পাঠকও যদি আমাদের রচনার সুখ্যাতি করেন, তা হলেই আমরা হাতে স্বর্গ পাই। কিন্তু সমালোচকের মুখে প্রশংসার মতো নিন্দারও একটা বিশেষ মূল্য আছে। নিন্দার প্রসাদেও আমাদের লেখা জনসমাজে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। বিজ্ঞাপন হিসেবে কোনো বইয়ের নিন্দা ও প্রশংসার মধ্যে কোনটি বেশি মূল্যবান, বলা কঠিন। অনেক সমালোচক-নিন্দিত সাহিত্যও যে সমাজে দিব্যি চলে যায়, তার প্রমাণ দেদার আছে। একখানি সেকেলে কাব্যের নাম করলেই বুঝতে পারবেন, আমার কথা ঠিক। বিদ্যাসুন্দরকে অনেক দিন থেকেই লোকে অপাঠ্য বলে আসছে। অথচ আমার বিশ্বাস, বিদ্যাসুন্দরের প্রচলন বাঙালি সমাজে মোটেই কম নয়। ইংরেজি শিক্ষিত সমাজে ও-কাব্যের নিন্দা তো বহুকালাবধি সকল শিক্ষিত লোকের মুখেই শোনা গিয়েছে, তৎসত্ত্বেও ভারতচন্দ্রকে কবি বলতে আজকের দিনে আমরা ভয় পাইনে। যে-কারণে ভারতচন্দ্র নিন্দিত, সে কারণে আজকের দিনে যদি কোনো লেখক নিন্দিত হন, তা হলে সে নিন্দা তাঁর পক্ষে একটা মস্ত বিজ্ঞাপন হবে।

সে যা-ই হোক, এ কথা নির্ভুল যে আমরা লেখকরা চাই সমালোচকদের কাছ থেকে নিন্দা নয়–প্রশংসা। এ আমাদের জাতিধর্ম। লেখকেরা আবহমান কাল প্রশংসার ভিখারি ছিলেন, আজও আছেন। ‘গুণী গুণং বেত্তি’, ‘মধুমিচ্ছন্তি ষট্পদা’,

এ সকল সংস্কৃত বচন লেখকদের হাত থেকে বেরিয়েছে, সমালোচকদের হাত থেকে নয়।

সাহিত্যিকদের এ প্রবৃত্তির সঙ্গে ঝগড়া করে কোনো ফল নেই। এ প্রবৃত্তিকে দুর্বলতা বললেও সে দুর্বলতা আমরা ত্যাগ করতে পারব না, আর যিনি পারেন তাঁর পত্রপাঠ সমালোচকদের দলে গিয়ে ভর্তি হওয়া উচিত।

কে না জানে যে বাহবা না পেলে গাইয়ে-বাজিয়েরা আসর জমাতে পারে না। এবং যে-শ্রোতা যত বেশি বার ‘কিয়াবাৎ’ ‘কিয়াবাৎ’ বলে, ওস্তাদেরা তাকেই তত বড় সমঝদার বলে মেনে নেন। এর কারণও স্পষ্টই। সাহিত্যের ফুল অনুকূল জলবায়ু না পেলে স্ব-রূপে ফুটে উঠতে পারে না। এই প্রশংসা জিনিসটা হচ্ছে সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির একটি প্রধান সহায়। কাব্যের রস উপভোগ করার অক্ষমতা সমালোচকদের একটা ক্ষমতার মধ্যে গণ্য নয়। 

ইংল্যান্ডের সর্বাগ্রগণ্য মনীষী Bertrand Russell তাঁর শিক্ষা সম্বন্ধে নতুন বইয়ে লিখেছেন যে—‘Praise is less harmful. But it should not be given so easily as to lose its value, nor should it be used to over-stimulate a child.’ উপরিউক্ত child কথা থেকেই বুঝতে পারছেন যে এ হচ্ছে শিশুশিক্ষার ব্যবস্থা। কিন্তু আমরা সাহিত্যিকরা উকিল-মোক্তার পলিটিশিয়ান-দোকানদারদের মতে কি সব শিশু নই? অন্তত সমাজ উপরিউক্ত সেয়ানাদের তুলনায় আমাদের কি ছেলেমানুষ হিসেবে দেখেন না? অতএব Russell-এর মতানুসরণ করে সমালোচকদের আমাদের প্রশংসা করাই কর্তব্য। 

কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমালোচকদের একটু বিপদ আছে। তাঁরা যদি রামের প্রশংসা করেন তো শ্যাম মনঃক্ষুণ্ণ হবে এবং এই অবস্থায় শ্যামচন্দ্রকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না যে রামচন্দ্রের প্রশংসার অর্থ শ্যামচন্দ্রের নিন্দা নয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে কথাটা আর একটু পরিষ্কার করছি। গত মাসের কল্লোলে শ্রীযুক্ত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তিনখানি বইয়ের গুণ গেয়েছেন। তার মধ্যে একখানি হচ্ছে ‘গড্ডলিকা’। কিছুদিন আগেও আমিও এ বইয়ের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছি।

আমার যতদূর মনে পড়ে, এ প্রশংসাসূত্রে এক জায়গায় বলেছিলাম যে বঙ্গসাহিত্যে এর তুলনা নেই। এই কথা শুনে বীরবল যদি বেজার হতেন তো ভেবে দেখুন, কী মুশকিলেই পড়তুম। তখন তাঁকে গিয়ে বলতে হতো যে ‘গড্ডলিকার হাস্যরস আর তোমার হাস্যরস এক জাতীয় নয়।’ এ কথা শুনে তিনি যদি প্রশ্ন করতেন যে ও-দুয়ের প্রভেদটা কী? তা হলে উত্তরে আলঙ্কারিকদের এই বচন আওড়াতে বাধ্য হতুম

ইক্ষুক্ষীর গুড়াদীনাং মাধুর্য্য স্যাস্তরং মহৎ। 
তথাপি ন তদাখ্যাতুঃ সরস্বতাপি শক্যতে।। 

বীরবলের উদাহরণ দিচ্ছি এই কারণে যে তিনি আমার ঘরের লোক, সুতরাং তাঁর নাম করায় আমার বিশেষ কোনো ভয়ের কারণ নেই। কিন্তু বীরবল না হয়ে যদি কোনো নির্বল রসিক আমার ওপর নারাজ হতেন, সেটা অবশ্য নিতান্ত আক্ষেপের কারণ হতো। শ্রীযুক্ত ধূর্জটিপ্রসাদের সমালোচনার ওপর আপনারা যে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন, তা-ই পড়েই আমার মনে এই কথা উদয় হয়েছে যে সমালোচকের পক্ষে এ যুগে কারও প্রশংসা করা তার নিন্দা করার চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। এ যুগ তো আর বঙ্গদর্শনের যুগ নয়, যখন বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে লেখকদের সরাসরি বিচার করতেন ও খুশিমতো তাঁদের তিরস্কৃত ও পুরস্কৃত করতেন ও পাঠকসমাজ তাঁর কথাই বেদবাক্য বলে মেনে নিত। এ যুগ যে সাহিত্যেরও ডেমোক্রেটিক যুগ। আপনারা জানিয়ে রেখেছেন যে শ্রীযুক্ত ধূর্জটিপ্রসাদের প্রবন্ধের স্বপক্ষে-বিপক্ষে কোনো কথাই আপনারা প্রকাশ করবেন না। তবুও আমি যে এ বিষয়ে দু-চার কথা বলছি, তার কারণ উক্ত প্রবন্ধ আমার আলোচ্য বিষয় নয়, শুধু আলোচনার উপলক্ষ্য মাত্র। কোনো সমালোচকের কোনো মতামতের প্রতিবাদ কিম্বা সমর্থন করবার দিন এখন চলে গিয়েছে। কেননা এ যুগে সাহিত্য সম্বন্ধে শুধু ব্যক্তিগত মতামতেরই অর্থ ও সার্থকতা আছে।

এ যুগে নিজের মন ছাড়া অপর কোনো রকম কষ্টিপাথর লোকের হাতে নেই, যার সাহায্যে সে সাহিত্যের দর করে দেবে। ইংরেজিতে যাকে বলে cannons of critricism এ যুগে সেসব বিলকুল বাতিল হয়ে গিয়েছে। অলঙ্কারশাস্ত্রের বিধি অনুসরণ করে কেউ কস্মিনকালেও কাব্যরচনা করতে পারেননি এবং সেকালেও কবিরা সে শাস্ত্রের নিষেধও পদে-পদে লঙ্ঘন করতে বাধ্য হয়েছেন। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে কাব্যদেহের দোষের একটা লম্বা ফর্দ আছে, অথচ আলঙ্কারিকরাই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে দোষ হয়ে গুণ হলো কবির বিদ্যায়। দৈব বিধান যে শাস্ত্রবিধানের চাইতে প্রবল, এ কথাও তাঁরা স্পষ্টাক্ষরে বলে গিয়েছেন।

এ যুগে আমরা এ ক্ষেত্রে কোনোরূপ শাস্ত্রবিধান গ্রাহ্য করতে পারিনে, ফলে উক্ত বিধান অনুসারে এ কাব্য, ও নয়, এমন কথাও বলতে অধিকারী নই। কারণ দেখতে পাওয়া যায় যে নিত্যনতুন সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে যা কোনো পুরোনো নিয়মের অধীন নয়। ফলে সাহিত্য-সমালোচনার জন্য সমালোচকেরা নিজের রুচির ওপরই নির্ভর করতে বাধ্য। এক হিসেবে এটি দুঃখের বিষয়, কারণ প্রতি ব্যক্তি যদি কেবলমাত্র নিজের রুচির ওপর নির্ভর করেন, তা হলে সামাজিক রুচি বলে কোনো জিনিস জন্মাতে পারে না—ফলে এ ক্ষেত্রে যা জন্মায়, তারা নাম critical anarchism। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ যুগে সমালোচকদের মেনে নিতে হবে যে সমালোচনা করার অর্থ হচ্ছে আত্মপ্রকাশ করা। এতে যিনি ভয় পান, তাঁর পক্ষে সমালোচনা ত্যাগ করাই কর্তব্য। লেখকদলকে লালন-পালন শাসন-সংরক্ষণ করবার দায়িত্ব এ যুগের সমালোচকদের নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত