‘আমার মানিকরে কই দাফন করছে জানি না, ফয়সালরে তুই কই গিয়া শুইয়্যা আছত’

কুমিল্লা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৪, ২১: ৩৭
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৪, ২৩: ৫৪

‘আমার ছেলের জীবনডারে কেউ ভিক্ষা দাও, আহারে আমার নিমাইরে এমনভাবে গুলি করছে যে মাথার মগজ ও খুলি উড়ে গেছে। কোন পাষণ্ড আমার ছেলেরে গুলি করছে, তার কি একটু বুক কাঁপল না। পোলারে কত জায়গায় খুঁজছি, কেউ বলতে পারেনি কই আছে, থানায় গেছি, এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ঘুরছি, কোথাও পাইনি। ১৩ দিন পর জানছি, আমার ছেলেরে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করছে, আমার মানিক চানরে কই দাফন করছে তাও জানি না, কবরে দাঁড়াইয়া যে ফয়সাল বইল্ল্যা ডাক দেমু, তাও পারমু না, আরে ফয়সালরে তুই কই গিয়া শুইয়্যা আছত।’ 

এভাবেই আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজধানীর আবদুল্লাহপুরে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফয়সাল সরকারের বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগম। 

ধবধবে একটি সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ নিহত ফয়সালের এমন একটি ছবি হাতে নিয়ে বুক চাপরে বিলাপ করছেন তিনি। তাঁর আর্তচিৎকারের আকাশ–বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। পাশে বসে কাঁদছেন ফয়সালের বাবাসহ তাঁর ছয় বোন ও আত্মীয়স্বজন। কাঁদছেন প্রতিবেশীরাও। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে এ পর্যন্ত দেবিদ্বারে পাঁচজন নিহতের খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। 

ফয়সালের মা হাজেরা বেগম বলেন, ‘ওরা গুলি করে আমার ফয়সালের মাথার খুলি উড়ায় দিছে। তোমরা আমার সোনা মানিকরে আইনে দাও। আমি তার লাশটি ছুঁয়ে দেখতে চাই। এখন আমার সংসার চালাবে কে।’ 

আজ শুক্রবার (২ আগস্ট) বেলা ১১টায় ফয়সালের বাড়িতে দেখা যায় এমন আহাজারি চিত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ফয়সাল সরকার। ঘটনাটি ঘটে ১৯ জুলাই শুক্রবার। ওই দিন বিকেলে বাসা থেকে বাইর হয়ে নিখোঁজ হয় ফয়সাল। পরে ২২ থেকে ২৫ জুলাইয়ের কোনো একসময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ফয়সালকে ঢাকায় গণকবর দেয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম ফাউন্ডেশন। সংস্থাটি থেকেই নিহতের পরিবার এই তথ্য জানতে পেরেছে বলে জানা গেছে। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ফয়সাল সরকারনিহত ফয়সাল সরকার কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর গ্রামের সরকার বাড়ির মো. সফিকুল ইসলাম সরকারের ছেলে। তিনি চলতি বছরে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। এরই মধ্যে আট বিষয়ে পরীক্ষা শেষ করেছে। পাশাপাশি সংসারের অভাব ঘুচাতে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজও করতেন। বাবা-মা, ভাইসহ পরিবার নিয়ে থাকতেন আবদুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। 

নিহত ফয়সালের ছোট ভাই ফাহাদ সরকার বলেন, ‘গত ১৯ জুলাই বিকেলে আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হয়। সন্ধ্যার পর ভাইয়ের নম্বরের ফোন করলে নম্বর বন্ধ পাই। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু করি। বাইরে তখনো গোলাগুলি চলছিল। কোথাও খোঁজ না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণ খান থানায় জিডি করি। গত ১২ দিন পর বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে তাঁরা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখালে সেখানে ফয়সাল ভাইয়ের মরদেহের ছবি দেখতে পাই। কোথায় দাফন করা হয়েছে জানতে চাইলে তাঁরা জানায়, ১০–১৫টি লাশ একবারে গণকবর দেওয়া হয়েছে, কাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে তাঁরা তা বলতে পারবেন না।’

ফয়সালের বড় বোন রোজিনা আক্তার ও নুরুননাহার আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের ছয় বোনের পর এই ভাই, আপনারা আমার ভাইকে এনে দেন, আমরা কোনো রাজনীতি করি না, আমাদের সংসার এখন কে চালাবে, আমাদের কী হবে। এই ভাই রোজগার করে বোনদের বিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা কানে শুনে না।’  

নিহত ফয়সালের বাবা বৃদ্ধ মো. সফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমার ছয় মেয়ের পর ফয়সাল হইছে। এই ফয়সাল লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী বাসে পার্টটাইম সুপারভাইজারের কাজ করে সংসার চালাত। এখন আমার পুরো সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। কারা আমার ছেলেকে হত্যা করল? কী দোষ ছিল আমার ছেলের, সে তো কোনো রাজনীতি করত না, পেটের দায়ে বাসে কাজ করত। তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? এই বিচার আমি কার কাছে দেব?’

দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ‘১৩ দিন পর ফয়সালের মৃত্যুর খবরটি জানতে পেরেছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এর আগেও ঢাকায় নিহত কয়েকজনের বাড়িতে আমি গিয়েছি, সহযোগিতা করেছি। ফয়সালের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে, সরকারিভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত