ভাইকে নিতে এসে পুলিশের গুলিতে ঢলে পড়লেন চিকিৎসক সজিব

হারুনূর রশিদ, রায়পুরা (নরসিংদী) 
আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১০: ১৩
Thumbnail image

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় (১৮ জুলাই) মাদ্রাসা পড়ুয়া ভাইকে আনতে গিয়ে ঢাকার আজমপুরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান চিকিৎসক সজিব সরকার (৩০)। ওই দিন রাতে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনরা লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঘটনার সপ্তাহ পেরোলেও থামেনি স্বজনদের আহাজারি। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সজিবের মৃত্যুতে শোকের সাগরে ভাসছে পুরো পরিবার। 

নিহত সজিব নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের মো. হালিম সরকারের ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের লেকচারার এবং বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিতেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি।

নরসিংদীর ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে মা ঝরনা বেগম (৫৬) এখন পাগলপ্রায়, অসুস্থ হয়ে অক্সিজেন নিচ্ছেন। ছেলের স্মৃতিচারণ করে বারবার মুরছা যান। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সজিব সব সময় আমাকে ছোট্ট সন্তানের মতো আগলে রাখত। আমিসহ সবার খরচ জোগাতো। ওই দিন ১১টায় বাসা থেকে ছোট ছেলেকে আনতে বের হন। বেলা সাড়ে ৪ থেকে ৫টার মধ্যে আজমপুর পৌঁছে ফোনে কথা হয়। রাত ১টা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলাম।’

 সজিব সরকার।তিনি বলেন, ‘আমাদের যা ছিল, সব ছেলেকে চিকিৎসক বানাতে ব্যয় হয়েছে। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। আমার ছেলে হত্যার বিচার কীভাবে পাব, সেটাই চাইব। সবাই যাতে জানে, সজিব ডাক্তার নির্দোষ হয়ে মারা গেছে। সজিব যেন আজীবন সবার মাঝে বেঁচে থাকে এমন কিছু একটার নামকরণ করা হোক।’ 

ছেলেকে হারিয়ে মা ঝরনা বেগম (৫৬) এখন পাগলপ্রায়বোন সুমাইয়া সরকার বলেন, ‘ভাই ১৮ জুলাই দুপুরে ঢাকার উত্তরা রাজলক্ষ্মী দারুল উলুম মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে আনতে বাসা থেকে বের হন। বিকেল ৫-৬ মধ্যে আজমপুরে বাস থেকে নেমে রাজলক্ষ্মী যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকেন। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন। সন্ধ্যা ৭টায় ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে খবর পেয়ে হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসি। জানতে পারি, বিকেলে আজমপুরের রাস্তা থেকে কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ ভাইকে হাসপাতালে আনে। পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন। এখন কী করে আমাদের চলবে সংসার?’ 
 
ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এর আগের সপ্তাহে ভাই মাদ্রাসায় আসে। ওই সময় তার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় এবং বলে ১৮ তারিখ (বৃহস্পতিবার) মাদ্রাসা ছুটি হলে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। ওই দিন বিকেলে তিন বার ভাইকে ফোন দিয়ে না পেয়ে ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। রাত ৯টায় হাসপাতালে এসে ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই। 

রাতেই উত্তরার একটি মসজিদে গোসল করাতে গিয়ে দেখি ভাইয়ের বুকের সামনে দিয়ে গুলি ঢুকে পেছন দিয়ে বের হয়েছে। কাপড় তুলে দেখি দুই দিক দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। ভাইয়ের উপার্জনে আমাদের পড়াশোনা এবং মায়ের অসুস্থতার খরচ চলতো। ভাই আমাদের প্রাণ ছিল। এখন কি করে চলবে?’ 

বাবা মো. হালিম সরকার (৫৮) বলেন, ‘ছেলেকে খুব কষ্ট করে ঢাকার উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত পড়াশোনা করাই। ২০২০ সালে টঙ্গীর বেসরকারি তাইরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক হয়ে বের হয়। তাকে চিকিৎসক বানাতে গিয়ে দিতে হয়েছে সর্বত্র, ঋণে জর্জরিত। পরে সে ঋণগ্রস্ত পরিবারের হাল ধরে।’ 

সজিব সরকারকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের সবাই তাকে ঘিরে কত-না স্বপ্ন বুনেছিলাম। তার কি অপরাধ ছিল যে, গুলিতে নিহত হলো। কার কাছে চাইব বিচার? কে করবে বিচার, কে দেবে ক্ষতিপূরণ? যা সহায়–সম্বল ছিল সবই ছেলেকে ডাক্তার বানাতে ব্যয় করেছি। ছেলে আমার ছায়া ছিল, এখন আমার সব শেষ। আমি আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। ছেলে খুব ধার্মিক ছিলেন। খুব কষ্ট করে ছেলেকে দেশের সেবক বানিয়েছি। রাষ্ট্র আমাকে দিল লাশ। ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না, রাষ্ট্র যদি তদন্ত করে ছেলে হত্যার বিচারটা করে, তাহলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাব।’ 

নজরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘সজিব সময় পেলেই এলাকায় এসে বিনা মূল্যে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতেন। তার মৃত্যু মেনে নেওয়ার নয়। খুব ভালো মনের পরহেজগার মানুষ ছিলেন।’ 

মির্জানগর ইউপি চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন রিপন বলেন, ‘ওই দিন জানতে পারি সে ঢাকায় নিহত হয়েছেন। তার মৃত্যুতে পরিবার ও এলাকার অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে।’ 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের সচিব আতিকুর রহমান বলেন, ‘উনি প্রায় এক বছর ধরে লেকচারার ছিলেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। শুনেছি সে মারা গেছেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত