৩৫ বছরের শিক্ষকতায় একদিনও অনুপস্থিত থাকেননি সত্যজিৎ বিশ্বাস 

আনোয়ার হোসেন (মনিরামপুর) ও রবিউল ইসলাম (অভয়নগর) 
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭: ১১

সত্যজিৎ বিশ্বাসের (৬০) বাড়ি মনিরাপুরের কুচলিয়া গ্রামে। শিক্ষকতা করেন অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পড়ান নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান এবং পদার্থ বিজ্ঞান। একজন সাধারণ শিক্ষক হয়েও কর্মগুণে অসাধারণ তিনি। ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একদিনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেননি তিনি। কোন ঝড়বৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা আটকাতে পারেনি তাঁর পথ। 

এমনকি নিজের বিয়ে কিংবা বাবার মৃত্যুও না। এই গুনের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে এক ডজনের বেশি পুরস্কার পেয়েছেন সত্যজিৎ। আলোচিত হয়েছেন দেশজুড়ে। শিক্ষণ দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর মন। গুণী এই মানুষটির কর্ম জীবনের সমাপ্তি ঘটছে আগামী মাসের ৯ তারিখ। তিনি বিদ্যালয়ে থাকছেন না এমনটি ভাবতেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অবসর কীভাবে কাটাবেন ভেবে পাচ্ছেন না নিজেও। 

জানা যায়, ১৯৮৪ সালে বিএসসি পাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন সত্যজিৎ বিশ্বাস। দুই বছর পর ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। জীবনের প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে এরপর থেকে একদিনও কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকেননি তিনি। 

১৯৯০ সালে এক শুক্রবার রাতে নড়াইলের পঁচিশা গ্রামের আরতী বিশ্বাসকে বিয়ে করেন সত্যজিৎ। বিয়ের অর্ধেক কাজ সেরে নববধূকে রেখে পরদিন শনিবার সকালে ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে সময়মতো স্কুলে আসেন তিনি। বিকেলে ছুটির পর আবার ২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিয়ের বাকি কাজ সম্পন্ন করেন। 

বিদ্যালয়ের বারান্দায় শিক্ষক সত্যজিৎ১৯৯৩ সালে কোন এক সোমবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয় আদর্শবান এই শিক্ষকের পিতা মাধব চন্দ্র বিশ্বাসের। তখন পাড়ার লোকজন ডেকে তিনি নিজের প্রতিজ্ঞার কথা বলেন। এরপর যোগ দেন ক্লাসে। বিকেলে ছুটি হলে বাবার সৎকার করেন তিনি। একই প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৫ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হন সত্যজিৎ। সহকারী প্রধান হয়েও নিয়মিত নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান পড়ান তিনি। 

আজ বুধবার সকালে সরেজমিন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তখন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজকের পত্রিকাকে এসব কথা বলেন তিনি। 

শুধু তাই নয়, কর্মক্ষেত্রে তিনি যেমন সফল তেমনি পরিবার প্রধান হিসেবেও। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক এই শিক্ষক। ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির অপেক্ষায় রয়েছেন। মেয়ে পশুপালনের ওপর ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। আর স্ত্রী আরতী বিশ্বাস গৃহিণী। 

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, কর্মজীবনে যোগ দেওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে কোনোদিন স্কুল ফাঁকি দেবো না। বিধাতা আমাকে এই কাজে সাহায্য করেছেন। কোনোদিন আমি অসুস্থও হইনি। সব সময় ঠিকমতো হাজির হয়েছি স্কুলে। চাকরিজীবনে দুই দিন স্কুলে পৌঁছানোর পর কিছুটা অসুস্থবোধ করি। একদিন ক্লাস শুরুর আগে সমাবেশ চলা অবস্থায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। সবাই মিলে আমাকে ধরে অফিসকক্ষে নিয়ে মাথায় পানি দেন। এরপরই আমি সুস্থ হয়ে যাই। 

স্ত্রী প্রথম দিকে একটু-আধটু রাগ করতেন। এরপর আমার দেশ সেরা শিক্ষক হওয়ার খবর জানলো। ২০১৯ সালে ডেইলি স্টার পত্রিকা থেকে আমাকে পুরস্কার দিল। স্বামী-স্ত্রী দুজনে বিমানে ঢাকায় গেলাম। তারপর থেকে তিনি নিজেও খুশি। 

সত্যজিৎ বিশ্বাস আরও বলেন, ছোটবেলা থেকে আমি এমন। গ্রামের দিগঙ্গা কুচলিয়া হরিদাসকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্কুল জীবনে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে কোনোদিন অনুপস্থিত থাকিনি। অসুস্থতার জন্য দশম শ্রেণিতে দুই দিন অনুপস্থিত ছিলাম। 

অবসরজীবন কীভাবে কাটাবেন এমন প্রশ্নে ওই শিক্ষক বলেন, তখন বাড়ি বসে কর্মজীবনের কথা ভাবা ছাড়া গতি নেই। আমার গ্রামের মানুষও ঠিকভাবে আমাকে চেনেন না। মনিরামপুর উপজেলায় বাড়ি হলেও আমার সব পরিচিতি স্কুলকে ঘিরে। 

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানরত শিক্ষক সত্যজিৎধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া খাতুন বলে, স্যার আমাদের গণিত পড়ান। কোনো সময় আমাদের ওপর রাগ করেন না। কোন কিছু না বুঝলে বারবার বুঝিয়ে দেন। স্যারকে পেয়ে আমরা গর্বিত। স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। 

মনিরাপুরের হরিদাসকাটি ইউনিয়নের কুচলিয়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্রণব বিশ্বাস বলেন, সত্যজিৎ সম্পর্কে আমার ভাই। শিক্ষকতা নিয়ে ভাবতে গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে মেশার সুযোগ পাইনি। শিক্ষক হিসেবে সত্যি তিনি একজন আদর্শবান মানুষ। 

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৯০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি এখানে যোগ করি। সেই থেকে সত্যজিৎ বিশ্বাস আমরা সহকর্মী। কোনোদিন দেখিনি ঝড়বৃষ্টি বা অসুস্থতার কথা বলে তাঁকে ছুটি নিতে। কোন বছর ঐচ্ছিক ছুটিও কাটাননি তিনি। ২০১৫ সালে সত্যজিৎ বিশ্বাসকে সহকারী প্রধান হিসেবে পেয়েছি। সার্বিক কাজে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেন। 

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, আগামী মাসের ৯ তারিখ সত্যজিৎ বিশ্বাসের কর্মজীবনের শেষদিন। তাঁকে ছাড়তে হবে এটা ভেবেই খারাপ লাগছে। তারপরও তাঁকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে চাই। আমি তাঁর অবসরজীবনের কল্যাণ কামনা করছি। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত