রাজধানীর ধানমন্ডি লেকের পাড় থেকে গত বছরের ২৩ অক্টোবর রাতে শাহাদত হোসেন মজুমদার (৫১) নামে এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় করা হত্যা মামলায় এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
এর সাত মাস আগে ২৪ মার্চ রাতে শাহজাহানপুরের রাস্তায় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও রিকশাযাত্রী কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি হত্যা মামলার তদন্তও শেষ হয়নি। রাজধানীতে ঘটা এমন আরও অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার ভাগ্যে এই অবস্থা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র থেকে জানা যায়, ঢাকায় ২০২১ সালে ১৫২ জন ও ২০২২ সালে ১৭৩ জন খুন হয়েছে। এই ৩২৫ মামলার মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের তদন্ত শেষ হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে খুন হয়েছে আরও ৫১টি। অন্যান্য গুরুতর অপরাধের অনেক মামলারও তদন্ত চলছে বছরের পর বছর।
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ১১ মে ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণ লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেছেন, খুন, ধর্ষণের মতো গুরুতর মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার না হলে অন্য অপরাধীদের কাছে কঠোর বার্তা যায় না।
জানা গেছে, ধানমন্ডিতে নিহত শাহাদত হোসেন মজুমদার বিদেশি জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। খুনের এক মাস আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসেছিলেন। সাত মাসেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় তাঁর পরিবার হতাশ। তাঁর ভাই মোতালেব হোসেন বলেন, ‘পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে, এটুকুই জানি।’
জানতে চাইলে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী বলেন, এক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তদন্ত চলছে।
মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী প্রীতি হত্যা মামলারও অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। এই মামলায় পুলিশ ও র্যাব ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে এঁদের তিনজন বর্তমানে জামিনে আছেন। আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৫ জুন দিন ধার্য করেছেন।
মামলার বাদী ও নিহত টিপুর স্ত্রী ডিএসসিসির সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি আজকের পত্রিকাকে বলেন, একজন আসামির জবানবন্দিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতার নাম আসায় তদন্ত এগোচ্ছে না। তদন্ত শেষ না হওয়ায় বিচারও শুরু হচ্ছে না। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন।
সূত্র বলেছে, গত পাঁচ বছরে হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের পর খুনের ২৫৮টি মামলা ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগে তদন্তাধীন। এগুলোর মধ্যে হত্যা মামলা ৬৮টি, ধর্ষণ ৭৭টি এবং অন্যগুলো ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মামলা। এ ছাড়া তদন্তাধীন পুরোনো মামলার সংখ্যা সহস্রাধিক। আদালতের নির্দেশে কিছু মামলার তদন্তভার সিআইডি, পিবিআইকে দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাদক ও চোরাচালানের মামলা ৪ হাজার ৭৫১টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৯ হাজার ১০০ জনকে। এর অর্ধেকের বেশি মাদকসেবী ও বিক্রেতা, প্রতারক, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। জানা গেছে, প্রতারণার অভিযোগে গত ২২ নভেম্বর উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ আরিয়ান আহম্মেদ (৩৭) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার দুই মামলার তদন্ত তিন মাসেই শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে থানা-পুলিশ। তবে গুরুতর অপরাধের মামলার তদন্ত এত দ্রুত এগোয় না।
ডিএমপির সদর দপ্তর বলেছে, সূত্র না পাওয়া, কিছুদিন পর বাদীর অসহযোগিতা, পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্ত পেতে বিলম্ব, আলামত নষ্ট হওয়া এবং অপরাধীরা কৌশলী হয়ে ওঠায় তদন্ত শেষ করতে দেরি হচ্ছে।
এদিকে ১১ মে ডিএমপি সদর দপ্তরে পুরোনো মামলা নিয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ার বিষয়ে প্রতিটি বিভাগের উপকমিশনার ও মামলার তদারক কর্মকর্তাদের লিখিত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন।
ডিএমপি কমিশনার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একেকটি মামলার তদন্ত একেক কারণে বিলম্ব হচ্ছে। কর্মকর্তাদের কাছে দেরির কারণ জানতে চেয়েছি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, সব ঘটনাই সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়।
আসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, পুলিশের সদিচ্ছার অভাবে তদন্তে দেরি হয়। কারণ, ওপরমহল থেকে নির্দেশ এলে তদন্ত ঠিকই দ্রুত হয়। পুলিশ যেমন প্রতারক, ছিঁচকে চোর গুরুত্ব দিয়ে ধরছে, অন্য অপরাধের ক্ষেত্রেও সেভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। হত্যাসহ সব অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে সব অপরাধই কমে আসবে। তদন্ত শেষ না হওয়ায় অপরাধীরা সুযোগ পেয়ে যায়।