রাজারবাগ পিরের মামলা সিন্ডিকেটে সরকারি আইন কর্মকর্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩: ২৪
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯: ১১

কথিত পির দিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও নানাজনকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করার প্রমাণ মিলেছে। ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা এক সরকারি আইন কর্মকর্তা। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) মো. ফেরদৌস। তিনি রাজারবাগ পিরের মুরিদ। মিথ্যা মামলার এই সিন্ডিকেটে তাঁর সহযোগী হিসেবে রয়েছে হামিদা বেগম, মিনু বেগম, সোনিয়া আক্তার, নাহিদা আক্তার রত্না ও লালন। 

সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পক্ষ থেকে আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে এই সিন্ডিকেটের বিষয়টি জানা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে অনুসন্ধান শেষে ওই প্রতিবেদন দাখিল করেন সিআইডি কর্মকর্তা জহিরুল হক কবির। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভুক্তভোগী বিভিন্ন ব্যক্তি, ঘটনা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে রাজারবাগ পির সিন্ডিকেটের মিথ্যা মামলার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া যায়। চক্রের সদস্যদের করা একাধিক মামলার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্তে জানা যায়, রাজারবাগ দরবার শরীফের পির দিল্লুর রহমান তাঁর মুরিদদের দিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এই সিন্ডিকেট সারা দেশে মিথ্যা মামলা দিয়ে লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি করে। পির দিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নেয়, তদবির করে ও সাক্ষ্য দেয় তাদেরই সিন্ডিকেট সদস্যরা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। এই সিন্ডিকেটের মূল লক্ষ্য—মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে ভূমি দখল ও অর্থ হাতানো। সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রথমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। পরে অর্থ বা জমির বিনিময়ে আপস করে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পির সিন্ডিকেটের মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ সময় কারাবরণ করেছেন এমন অন্তত পাঁচজনের ঘটনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এর মধ্যে সোহেল চৌধুরী মেরিন একাডেমির রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কমান্ড্যান্ট। দাম্পত্য কলহের জেরে স্ত্রীকে তালাক দেন। এরপর ওই সিন্ডিকেট বিভিন্ন জেলায় তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি মামলা করে। ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার হয়ে নয় মাস জেল খাটেন। শ্বশুর তাঁর বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ কয়েকটি মামলা করেন। আশুলিয়া থানায়ও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়। মামলাগুলোর বাদী সিন্ডিকেটে ছিলেন হামিদা বেগম। ঢাকায় তাঁর নামে মামলা করেন পির দিল্লু রহমান নিজে। 

সোহেল চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একটি চক্র সারা দেশে মিথ্যা মামলা দিয়ে লোকজনকে হয়রানি করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ চক্রের হোতা এপিপি ফেরদৌস ও তাঁর মুহুরি। টাকা দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব মামলায় আপস করলেও বর্তমানে ঢাকায় মানহানি ও নারী–শিশুর মামলা চলছে।’ 

আরেক ভুক্তভোগী মো. কমিন শাহ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনের কুলির সর্দার। তাঁর ছেলে বিয়ের পরপরই বৃত্তি পেয়ে কানাডায় পিএইচডি করতে যান। এরপর দুই মাস পর ছেলের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। আর এর সূত্র ধরেই এপিপি ফেরদৌসের সহযোগিতায় সারা দেশে ১১টি মামলা হয় কমিন শাহের বিরুদ্ধে। কমিন শাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকার কাফরুল থানার একটি হত্যা মামলায় সাজা হয়েছে ৩০ বছর। যেখানে আসামির নাম ইকবাল। আমি বারবার বলেছি আমার নাম কমিন শাহ, তারপরও সাজা দিয়েছে। টাকা দিয়ে মানবপাচারের তিন মামলায় আপস করেছি। যশোরের একটিতে খালাস পেয়েছি। এখনো সাতটি মামলা আছে বিস্ফোরক আইনের। সব মামলাই রাজারবাগ পিরের মুরিদেরা করেছে।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মামলার বিষয়টি আইনজীবী ফেরদৌস ও তাঁর মুহুরি সাহেদ দেখে বলে জানান তিনি। 

ভুক্তভোগী বদরুল ইসলাম শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। কলেজের জমি ক্রয় ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। পরে সহযোগী অধ্যাপক আবু নাঈম মো. রাফি তাঁর নিকটাত্মীয় শাহ আলমকে দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানব পাচার আইনে মামলা করান। শাহ আলম পির দিল্লুর রহমানের মুরিদ। মামলার বাদী কুলছুমা আক্তার। বদরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রসচিব, আইন সচিব, পুলিশের আইজি, ডিবি, সিআইডি, ডিজিএফআই, এনএসআই ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেন তিনি। 

পরবর্তীতে ডিবি বিষয়টি তদন্ত করে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাদী ও সাক্ষীদের ঠিকানার তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। একটি চক্র সত্য গোপন করে এই মামলা করেছে। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা বলে জরু মিয়া, শাহ আলম ও জামাল মিয়াকে দিয়ে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়েছে। 

বদরুল ইসলাম বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে আইনজীবী ফেরদৌস, তাঁর জামাতা অ্যাডভোকেট শরীফ ও মুহুরি সাহেদ। একটি মামলা হয়েছে। তবে আরও অনেক মামলা হতে পারে। 

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একরামুল আহসান কাঞ্চনের পৈতৃক ২৫ শতাংশ জমির দখল নিয়ে কথিত পির দিল্লুর রহমানের সঙ্গে বিরোধের সূচনা হয়। এরপর পির সিন্ডিকেট দেশের বিভিন্ন জেলায় তাঁর বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা করে। এর মধ্যে ৩৬টি মামলায় তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। কাঞ্চন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখনো মানব পাচার, ধর্ষণ, নাশকতা, হত্যা চেষ্টাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৩টি মামলা চলমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিন্ডিকেটের লালন যশোরে ও নাহিদা আক্তার রত্না খুলনায় মানব পাচার মামলা দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এপিপি ফেরদৌস ও তাঁর মুহুরি সাহেদের নির্দেশনায় এসব হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। 

ঢাকার আশুলিয়ার মাহবুবুর রহমান খোকনের চাচাতো বোন পির দিল্লুর রহমানের স্ত্রী। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে পির সিন্ডিকেট তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় চারটি মামলা করে। আর তার বড় ভাই সোহরাব হোসেন ও ভাইয়ের ছেলে হামীম সায়মনের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় পাঁচটি মামলা। এ ছাড়া খোকনের ফুপাতো ভাই হাবিবুল্লাহ, ভায়রা ওমর ফারুক ও ভাতিজা শাহ আলমের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা দেয় পির সিন্ডিকেট। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন এবং মানব পাচার আইনে মামলা করা হয় রোজিনা আক্তারকে দিয়ে। রোজিনা সিন্ডিকেট সদস্য মুহুরি সাহেদের ভাড়াটিয়া। 

এর আগে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। সেখানে বলা হয়, রাজারবাগ পির ও তাঁর অনুসারীরা জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। 

এ ছাড়া হাইকোর্টে সিআইডি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা অভিযোগে করা ৪৯ মামলার মূল হোতা রাজারবাগ পির দিল্লুর রহমান। সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পির এবং তার অনুসারীদের সঙ্গে একরামুলের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এর জেরেই মামলা। 

এসব অভিযোগ ও সিআইডির প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য চাইলে এপিপি ফেরদৌস আজকের পত্রিকার কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। সিআইডির প্রতিবেদন সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি। 

মাঝে মাঝে পিপির দায়িত্ব পালন করেন এপিপি আজাদ রকিব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এপিপি ফেরদৌস রাজারবাগ পিরের মুরিদ এটা সত্য। তবে তাঁর ভুয়া মামলা সিন্ডিকেটের বিষয়টি আমার জানা নেই। কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

এই সিন্ডিকেটে একজন সরকারি আইন কর্মকর্তা জড়িত থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি রিপোর্টটি দেখিনি, আগে দেখে নিই। অপরাধ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত