যেসব ভাষা রিলে আছে, রিয়েলে নেই

তামান্না-ই-জাহান
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩: ০০
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২১: ০১

বিভিন্ন দেশে মানুষের ব্যবহৃত অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি আছে ভাষাকে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার উদ্যোগও। এর মধ্যেই আবার আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে নতুন নতুন ভাষা। তবে এই ভাষা কৃত্রিম।

ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে কিংবা টেলিভিশন-সিনেমার পর্দায় গল্পের প্রয়োজনে প্রায়ই বিভিন্ন কৃত্রিম ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। এই ভাষার বেশির ভাগই অর্থহীন ধ্বনির প্রয়োগ ছাড়া কিছু নয়। তবে আক্ষরিক অর্থেই কয়েকটি কৃত্রিম ভাষা আবিষ্কৃত হয়েছে, যার বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলি মনুষ্য ভাষারই সদৃশ। এই কৃত্রিম ভাষা এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, অনেকে আগ্রহ নিয়ে এসব ভাষা শিখছেন। কোনো কোনো কৃত্রিম ভাষার আবার রীতিমতো বিশেষজ্ঞ-প্রশিক্ষকও আছেন। এমনই কিছু কৃত্রিম ভাষা সম্পর্কে জানা যাক। 

না’ভি: অ্যাভাটার
খ্যাতিমান নির্মাতা জেমস ক্যামেরনের সৃষ্টিশীলতার গল্প আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। টাইটানিকের পর অস্কারজয়ী এই চলচ্চিত্র পরিচালক ২০০৯ সালে অ্যাভাটার দিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন। সিনেমাটিতে ভিনগ্রহের জাতি না’ভিকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে একটা স্বতন্ত্র ভাষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এতে তাঁকে সাহায্য করেন ভাষাবিজ্ঞানী বন্ধু পল ফ্রমার। তিনি বিস্তৃত শব্দভান্ডার, আর ব্যাকরণের মধ্য দিয়ে জন্ম দিলেন নতুন এক প্রকাশভঙ্গির। আর দর্শকেরাও দ্রুত তা গ্রহণ করল। পল ফ্রমারের সহযোগিতাতেই ভাষাটির আরও অগ্রগতি সাধন করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়—‘Oel ngati kameie. ’—‘আমি তোমাকে দেখছি’

মূল লেখক মাত্র কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করলেও ‘গেম অব থ্রোনস’-এ ডেভিড পিটারসন ডথরাকি নামে একটি স্বতন্ত্র ভাষাই ব্যববহার করেনডথরাকি: গেম অব থ্রোনস
জর্জ আর আর মার্টিন তাঁর বেস্টসেলার উপন্যাস ‘আ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ারস’-এ অশ্বারোহী যাযাবর গোষ্ঠী ডথরাকির বিবরণ দেন। এতে অল্প কিছু কৃত্রিম শব্দ উল্লেখ করেন ডথরাকিদের ব্যবহৃত ভাষার। পরে টেলিভিশন সিরিজ ‘গেম অব থ্রোনস’-এ ডেভিড পিটারসন কয়েকটি শব্দ থেকে একটি স্বতন্ত্র ভাষাকে বের করে আনেন। সিরিজটিতে অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের উচ্চারণ ছিল প্রশংসনীয়। আর এ কারণেই দর্শক-ভক্তদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ভাষা। ‘গেম অব থ্রোনস’ ভক্তরা শিখে ফেলেন—‘YER SHEKH MA SHIERAKI ANNI’ বা ‘তুমি আমার সূর্য-তারা।’ কিংবা ‘YER JALAN ATTHIRARI ANNI’-‘তুমি আমার জীবনের চন্দ্র।’ 

জনপ্রিয় ফিকশনাল ভাষার মধ্যে অন্যতম ক্লিনগন, যা ব্যবহার হয়েছিল জনপ্রিয় টিভি সিরিজ স্টার ট্রেকেক্লিনগন: স্টার ট্রেক
জনপ্রিয় ফিকশনাল ভাষার মধ্যে অন্যতম ক্লিনগন। ভাষাবিজ্ঞানী মার্ক ওকরান্ড বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ স্টার ট্রেকে ক্লিনগন জাতির বিশেষ ধরনের ভাষাকে সামনে আনেন। ভক্তরা পরবর্তীতে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা এবং গান লেখাতে এই ভাষার ব্যবহার করতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, শেক্সপিয়ারের নাটক হ্যামলেট পর্যন্ত লিখিত হয় ক্লিনগন ভাষায়। প্রায়ই ভাষাটি ইংরেজিতে বর্ণান্তকরণ ও অনুবাদ করে লেখা হয়। যেমন: ‘bortaS bIr jablu'DI' reH QaQqu' nay. ’—‘প্রতিশোধ এমন একটি ডিশ, যা ঠান্ডা পরিবেশন উত্তম।’ 

স্টার ওয়ারস সাউন্ড ডিজাইনার বেন বার্ট ১৯৮৩ সালে ‘রিটার্ন অব দ্যা জেডি’-এর জন্য হাটিজ ভাষা তৈরি করেছিলেনহাটিজ: স্টার ওয়ারস
স্টার ওয়ারস সাউন্ড ডিজাইনার বেন বার্ট ১৯৮৩ সালে ‘রিটার্ন অব দ্যা জেডি’-এর জন্য হাটিজ ভাষা তৈরি করেছিলেন। বার্ট কুয়েচুয়া নামক একটি প্রাচীন উপভাষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাষাটি গ্রহণ করেন। এটি একটি কাল্পনিক ভাষা, যা মূলত ‘জাব্বা দ্য হাট’ ও তার প্রজাতি তাতুইনের ভাষা। তবে পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক চরিত্রকেও হাটিজ ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। এই ভাষা এতই জনপ্রিয়তা পায় যে, তা শেখার জন্য ইউটিউবে টিউটোরিয়াল পর্যন্ত রয়েছে। উদাহরণ: ‘Hi chuba na daga?’ —‘তুমি কী চাও?’ 

‘হবিট’ এবং ‘লর্ড অব দ্য রিংস’-এর জন্যই জন্ম দেওয়া হয়েছিল কৃত্রিম ভাষা এলভিশ-এরএলভিশ: ‘হবিট’ এবং ‘লর্ড অব দ্য রিংস’
জে আর আর টলকিন ছিলেন বিচক্ষণ ভাষাতাত্ত্বিক। কোনো বিখ্যাত লেখা শুরুর আগেই তিনি একটি ভাষা সৃষ্টির প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালান। ‘হবিট’ এবং ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ রচনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় নতুন এক ভাষা; পরিচিতি পায় এলভিশ নামে। এটি পরে পিটার জ্যাকসন পরিচালিত চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়। ভক্তদের কাছে এই ভাষা দুটি গঠনে গৃহীত হয়েছে। প্রথমত, কুয়েনইয়া বা উচ্চ এলভিশ, আর দ্বিতীয়ত সিনডারিন। উভয়েই গড়ে উঠেছে ফিনিশ এবং ওয়েলশের ওপর ভিত্তি করে। সেই সঙ্গে রয়েছে কিছুটা গ্রিক ও লাতিনেরও সংমিশ্রণ। উদাহরণ: ‘Êl síla erin lû e-govaned vîn. ’—‘একটি নক্ষত্র আলো দেয় আমাদের মিলন মুহূর্তে।’ 

অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘ডেসপিকেবল মি’-এর সহনির্মাতা পিয়েরে কফিন ছবির প্রয়োজনে মিনিয়নিজ ভাষা তৈরি করেনমিনিয়নিজ: ডেসপিকেবল মি
অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘ডেসপিকেবল মি’-এর সহনির্মাতা পিয়েরে কফিন ছবির প্রয়োজনে মিনিয়নিজ তৈরি করেন। যদিও ভাষাটির কোনো অর্থ নেই, শুনতে অনেকটা শিশুর কথা শেখার আগের শব্দগুলোর মতো। পিয়েরে কফিন স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জাপানিজ, কোরিয়ান, ইংরেজিসহ কয়েকটি ভাষা থেকে মিনিয়নিজ ধার নিয়েছেন। এসব ভাষার এমন সংমিশ্রণ পিয়েরে করেছেন, যা কোনো অর্থ প্রকাশ করে না। উদাহরণ: ‘Le jori e’ tu’—‘ভালো কিংবা খারাপের জন্য।’ 

সিনেমা কিংবা টেলিভিশন সিরিজে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে দর্শক আগ্রহ। শুধু তা-ই নয়, এগুলো অস্কারের মতো আসরও মাত করছে। ফলে ভবিষ্যতে এই ধরনের সিনেমা-সিরিজের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। যার অর্থ হলো, আমরা ভবিষ্যতে পর্দায় আরও অনেক নতুন নতুন কৃত্রিম ভাষার ব্যবহার হয়তো দেখব। এগুলো শেষ পর্যন্ত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে কি না, তার প্রভাব সমাজ ও মানুষের ওপর কেমন হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত