Ajker Patrika

কণ্ঠরাজের চলে যাওয়ার এক বছর

রিমন রহমান, রাজশাহী
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২১, ১৫: ১৭
কণ্ঠরাজের চলে যাওয়ার এক বছর

দেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর যখন বুঝতে পেরেছিলেন ‘দয়াল’ ডাক দিয়েছেন, তখন রাজশাহীতেই আসতে চেয়েছিলেন। রাজশাহী আসার পর জীবনের শেষ ১৫টা দিন বোনের বাড়িতেই ছিলেন। তারপর এক সন্ধ্যায় হাজারও ভক্ত-অনুরাগীকে কাঁদিয়ে পাড়ি দেন না ফেরার দেশে।

সেই দিনটির এক বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার (৬ জুলাই)। গেল বছরের এই দিনে সংগীতাঙ্গনে একরকম শূন্যতা দিয়ে চলে গেছেন এই শিল্পী। তবে তাঁর গেয়ে যাওয়া ১৫ হাজারেরও বেশি গান রয়েছে আগের মতোই জীবন্ত। যুগ যুগ ধরে জীবন্তই থাকবে তাঁর কণ্ঠ।

পদ্মাপাড়ের শহর রাজশাহীতেই ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর জন্ম নিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। মা মিনু বাড়ৈ ছিলেন সংগীত অনুরাগী। তাই সংগীতশিল্পী হয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। শুরুতে তালিম নেন ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। ’৭৭ সালে ‘মেইল ট্রেন’ দিয়ে সিনেমায় তাঁর গান শুরু।

তারপর তিন দশকেরও বেশি সময় একাই রাজত্ব করেছেন বাংলা সিনেমায়। তখন সিনেমার গানে পুরুষ কণ্ঠ মানেই এন্ড্রু কিশোর। কণ্ঠ দিয়ে তাঁর মতো দাপট দেখাতে পারেননি আর কোনো শিল্পী। তাই কেউ তাঁকে বলেন ‘প্লে ব্যাক সম্রাট’, কেউ বলেন ‘কণ্ঠরাজ’, আবার কেউ বলেন ‘সংগীতের বরপূত্র’।

এন্ড্রু কিশোর ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্রতিজ্ঞা’ চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গান দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রচারবিমুখ গুণী এই শিল্পী আটবার পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

এন্ড্রু কিশোর ১৯৮২ সালে প্রথম ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রের ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। এরপর ১৯৮৯ সালে একে একে ক্ষতিপূরণ চলচ্চিত্রে ‘আমি পথ চলি একা এই দুটি ছোট্ট হাতে’; ১৯৯১ সালে `পদ্মা মেঘনা যমুনা' চলচ্চিত্রে ‘দুঃখ বিনা হয় না সাধনা’; ১৯৯৬ সালে `কবুল' চলচ্চিত্রে ‘এসো একবার দুজনে আবার’; ২০০০ সালে `আজ গায়ে হলুদ' চলচ্চিত্রে ‘চোখ যে মনের কথা বলে’; ২০০৭ সালে `সাজঘর' চলচ্চিত্রে ‘সাজঘর’ এবং পরের বছর `কী জাদু করিলা' চলচ্চিত্রে ‘কী জাদু করিলা’ গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান।

এন্ড্রু কিশোরের জাদুকরি কণ্ঠের জনপ্রিয় অন্য গানগুলোর মধ্যে আছে—ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না; ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে; আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প; আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন; সবাই তো ভালোবাসা চায়; আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙ্গাল ইত্যাদি।

যে ওস্তাদের কাছে গান শিখেছিলেন, তাঁর নামে এন্ড্রু কিশোর রাজশাহীতে গড়ে তুলেছিলেন ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ স্মৃতি সংসদ’। নিজেই দায়িত্ব পালন করেছেন এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে। এন্ড্রু কিশোর ২০১১ সাল থেকে মাসে একবার হলেও রাজশাহী আসতেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। এর আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ডেকে চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা দেন। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর ১৮ সেপ্টেম্বর এন্ড্রু কিশোরের শরীরে ধরা পড়ে ক্যানসার। এরপর চিকিৎসাও চলছিল।

গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, এন্ড্রু কিশোর দেশে ফিরতে পারবেন। কিন্তু শারীরিক দুর্বলতার কারণে আরেক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায়, লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার, স্পাইনাল এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে গেছে। তাই সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা হাল ছেড়ে দেন। জানিয়ে দেন, এখন আর কিছুই করার নেই।

এন্ড্রু কিশোরের ইচ্ছাতেই তাঁকে রাজশাহী আনা হয়। ২০ জুলাই রাজশাহী নগরীর মহিষবাথানে বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায় নেওয়া হয় তাঁকে। ৬ জুলাই সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। এরপর ১৫ জুলাই রাজশাহী সার্কিট হাউস সংলগ্ন এলাকায় খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে। মৃত্যুর আগে এন্ড্রু কিশোর নিজেই তাঁর কবরের জায়গাটি পছন্দ করে গিয়েছিলেন।

এখন একটা পেয়ারা, একটা বাতাবি লেবু আর একটা ক্রিসমাস গাছের নিচে চিরঘুমে আছেন এন্ড্রু কিশোর। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ মঙ্গলবার বিকালে সেখানে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। এর আগে বিকাল ৪টায় রাজশাহী সিটি চার্চেও প্রার্থনা করা হবে। করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুবই স্বল্প পরিসরে এসব আয়োজন হবে। এতে এন্ড্রু কিশোরের পরিবারের সদস্য এবং হাতেগোনা কয়েকজন ঘনিষ্ঠজন অংশগ্রহণ করবেন।

এছাড়া এন্ড্রু কিশোর প্রতিষ্ঠিত ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ আজ সকালে অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করবে। রাতে ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে একটি স্মরণসভা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত