পিরিয়ডকালে শসা খেলে কি নারী বন্ধ্যা হয়

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬: ৫৩
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৯: ২৮

পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব নারীদেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে সময়ে ঋতুস্রাবে নারীর সুস্থতা ও সন্তানধারণের সক্ষমতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু ঋতুস্রাব নিয়ে আলোচনা সমাজে অনেকটা ট্যাবুর মতো হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা আছে। ইন্টারনেটের এই যুগে এসব ভ্রান্ত ধারণা জায়গা করে নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেমন, গত ১৮ নভেম্বর ফেসবুকে মেয়েদের রূপচর্চা  ও ঘরোয়া টিপস নামের ১৩ হাজার ফলোয়ারের এক পেজে ‘পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে নিচের চারটি কাজ অবশ্যই বর্জন করুন’ শীর্ষক একটি পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে দাবি করা হয়, পিরিয়ড চলাকালীন নারীদের চারটি বিষয় অবশ্যই বর্জন করতে হবে। যথা: 

১। পিরিয়ড চলাকালীন ঠান্ডা জল, কোমল পানীয় এবং নারিকেল খাবেন না।

২। এইসময় মাথায় শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন না। কারণ পিরিয়ডের সময় চুলের গোড়া আলগা হয়, ফলে লোমকূপ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। শ্যাম্পু ব্যবহার এ সময় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।

৩। এই সময় শসা খাবেন না। কারণ শসার মধ্যে থাকা রস পিরিয়ডের রক্তকে জরায়ু প্রাচীরে আটকে দিতে পারে। এর ফলে আপনার বন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

৪। পিরিয়ডের সময় যেন শরীরে শক্ত কিছুর আঘাত না লাগে, বিশেষত পেটে। পিরিয়ডের সময়টায় জরায়ু খুব নাজুক থাকে ফলে অল্প আঘাতেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার ফলে পরবর্তীতে জরায়ু ক্যানসার, জরায়ুতে ঘা কিংবা বন্ধ্যত্বের ঝুঁকি থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, চলাকালীন সময়ে ঠান্ডা জল পান করার ফলে পিরিয়ডের রক্ত বের না হয়ে জরায়ু প্রাচীরে জমাট বাঁধতে পারে, যা পরবর্তী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে জরায়ু টিউমার বা ক্যানসারের আকার ধারণ করতে পারে। তাই কুসুম কুসুম গরম জল খাবেন।

কেবল একটি পেজই নয়, বিগত সময়ে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ, গ্রুপে এ সংক্রান্ত শতাধিক পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। ফেসবুকের নিজস্ব মনিটরিং টুল ক্রাউডেঙ্গলের সূত্রে দেখা যায়, কেবল ২০২২ সালেই ফেসবুকে পোস্টটি ১২১ বার করা হয়েছে। ২০২৩ সালে আজ বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) পর্যন্ত এই পোস্টটি ২০২ বার করা হয়েছে। এসব পোস্টে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা কমেন্ট, রিয়েকশন, শেয়ারের মাধ্যমে ২৮ হাজারের বেশি মিথস্ক্রিয়া করেছে।   

পিরিয়ড চলাকালীন এই চার কাজ কি অবশ্যই বর্জন করতে হবে? ছবি: ফেসবুকফেসবুকে প্রচারিত এই চারটি দাবি ২০১৯ সালে ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় এএফপিসহ আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) স্বীকৃত একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান দাবিগুলো নিয়ে কাজ করে।  

এএফপি এই চারটি দাবির প্রথম তিনটিকেই ভুল হিসেবে ও চতুর্থটিকে অসম্পূর্ণ তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

১। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে ঠান্ডা জল, কোমল পানীয় এবং নারিকেল খাবেন না। 

পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে ঠান্ডা পানি, কোমল পানীয় এবং নারিকেল না খাওয়া প্রসঙ্গে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের বৈশ্বিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ডক্টরালিয়ার সদস্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আনাইস রেয়েস নাভারো এএফপিকে বলেন, ঠান্ডা পানি, কোমল পানীয় বা নারিকেল খাওয়া বা না খাওয়া হরমোন চক্রকে পরিবর্তন করে না। এসব খাবার নারীদের প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো  অসুস্থতা সৃষ্টির জন্যও দায়ী না। প্রজননস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কিয়োশি ম্যাকোটেলা নাকাগাকি একই প্রসঙ্গে সংবাদ সংস্থাটিকে বলেন, এ তথ্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নারিকেল খাওয়া, ঠান্ডা পানি পানের সঙ্গে বন্ধ্যত্ব বা ক্যানসারের কোনো সম্পর্ক নেই।

২। এই সময় মাথায় শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন না। কারণ পিরিয়ডের সময় চুলের গোড়া আলগা হয় ফলে লোমকূপ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। শ্যাম্পু ব্যবহার এ সময় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।  

পিরিয়ড চলাকালে মাথায় শ্যাম্পু ব্যবহার প্রসঙ্গে কিয়োশি ম্যাকোটেলা নাকাগাকি বলেন, এটি একটি হাস্যকর দাবি। এটিরও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। 

আনাইস রেয়েস নাভারো বলেন, পিরিয়ডের সময় নারীদেহে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। ফলে এ সময় নারী দেহে মাথা ব্যথার মতো বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। এটি খুবই সাধারণ ঘটনা, এর সঙ্গে শ্যাম্পু ব্যবহার করা না করার কোনো সম্পর্ক নেই। 

৩। এই সময় শসা খাবেন না। কারণ শসার মধ্যে থাকা রস পিরিয়ডের রক্তকে জরায়ু প্রাচীরে আটকে দিতে পারে। যার ফলে আপনার বন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে

পিরিয়ড চলাকালে শসা না খাওয়া এবং খেলে বন্ধ্যা হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে রেয়েস নাভারো বলেন, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই এবং এ বিষয়ে যথোপযুক্ত কোনো গবেষণাও নেই। 

ম্যাকোটেলা নাকাগাকি বলেন, অনেক কিছুই বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে।  কিন্তু বন্ধ্যত্বের সঙ্গে শসা খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। 

৪। পিরিয়ডের সময় যেন শরীরে শক্ত কিছুর আঘাত না লাগে, বিশেষত পেটে। পিরিয়ডের সময়টায় জরায়ু খুব নাজুক থাকে ফলে অল্প আঘাতেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার ফলে পরবর্তীতে জরায়ু ক্যানসার, জরায়ুতে ঘা কিংবা বন্ধ্যাত্যের ঝুঁকি থাকে।

ম্যাকোটেলা নাকাগাকি বলেন, জরায়ু পেটে নয় বরং শ্রোণী গহ্বরে (পেটের নিচে) থাকে। তাই এ ধারণাটিও ভুল। রেয়েস নাভারো বলেন, জরায়ু অন্ত্র, চর্বি, পেশি এবং ত্বক দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। তাই একমাত্র গভীর আঘাতের মাধ্যমেই জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

এ ছাড়া দুজনেই ফেসবুকে উল্লেখিত পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে ঠান্ডা জল পান করার ফলে পিরিয়ডের রক্ত বের না হয়ে জরায়ু প্রাচীরে জমাট বাঁধা এবং এর ফলে পরবর্তী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে জরায়ু টিউমার বা ক্যানসারের আকার ধারণ করার দাবিটিকেও অবৈজ্ঞানিক ও ভুল তথ্য হিসেবে মত দিয়েছেন।

আফ্রিকাভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান আফ্রিকা চেক এই চারটি দাবির প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব নাইজেরিয়ার সিনিয়র লেকচারার ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ড. কিংসলে একউয়াজির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি ফেসবুকে প্রচারিত এ চারটি দাবিকেই ভুল হিসেবে শনাক্ত করেছেন।  

একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি নাইজেরিয়ার লাগোসের প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালোসিয়াস ইনোফোমোহের সাক্ষাৎকার নেয়। তিনি আফ্রিকা চেককে বলেন, এই দাবিগুলোর কোনোটিই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত না। ঠান্ডা পানি বা কোমল পানীয় গ্রহণ ঋতুস্রাবের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না এবং জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকিও তৈরি করে না। 

তিনি আরও যোগ করেন, শসা এমন একটি সবজি, যা খাওয়ার সময় খাদ্যনালীর মধ্য দিয়ে যায়। এর সঙ্গে বন্ধ্যত্বের  সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া পেটে আঘাতের সঙ্গে জরায়ুতে প্রভাব পড়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। 

জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিসেফ কিশোরীদের স্বাস্থ্যকর পিরিয়ড সম্পর্কে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, পিরিয়ডের সময় ঠান্ডা পানি খাওয়া বা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করা পিরিয়ড চক্র বা স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা তৈরি করে না। এটি প্রচলিত ধারণা। পিরিয়ডকালে গোসল করা নিয়ে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা খুব জরুরি, বিশেষ করে পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে। এই সময়ে নিয়মিত গোসল করা, চুল ধোয়াতে কোনো সমস্যা নেই। 

পিরিয়ডের সময় ঠান্ডা পানি খাওয়া প্রসঙ্গে ইউনিসেফ জানায়, ঠান্ডা পানি পিরিয়ড চক্রের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। পিরিয়ড নারীর প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। অপরদিকে পানাহার সম্পর্কিত পরিপাকতন্ত্রের সঙ্গে। এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়া। ফলে কোনো বিশেষ খাদ্য বা ঠান্ডা পানি পান পিরিয়ডে কোনো ঝুঁকি তৈরি করে না। 

একইভাবে পিরিয়ড চলাকালে বিশ্রামে থাকা ও ভারী কাজ না করার সতর্কতাকেও নির্দেশনাটিতে প্রচলিত ধারণা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পিরিয়ডকালে একজন নারীর শরীর স্বাভাবিকের মতোই সক্রিয় থাকে, দুর্বল হয়ে পড়ে না। কেবলমাত্র রক্তশূন্যতায় ভুগলে তারা দুর্বলতা অনুভব করতে পারে।

সিদ্ধান্ত
পিরিয়ড নারীদেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক কারণে পিরিয়ড সমাজে একটি ট্যাবু। যার কারণে পিরিয়ড নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ভুল ধারণা। ইন্টারনেটের বর্তমান যুগে এসব ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আরও বেশি। এরই ধারাবাহিকতায় ফেসবুকে পিরিয়ড চলাকালীন চারটি কাজ বর্জন করার আহ্বান জানিয়ে একটি পোস্ট প্রচার হয়ে আসছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পোস্টটিতে উল্লেখিত চারটি দাবিই অবৈজ্ঞানিক এবং কোনো গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত