ফিরে দেখা ২০২৪ /সড়ক-রেলে অরাজকতা বছরজুড়ে

সৌগত বসু, ঢাকা
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮: ৪৬
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩: ০১
Thumbnail image
ফাইল ছবি

দেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার মিশেলে ভরা একটি বছর ২০২৪ সাল। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল এই বছরকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। নজিরবিহীন এই ঘটনায় ট্রাফিক ব্যবস্থার ভেঙে পড়ে। এর আগেই মেট্রোরেলে নাশকতার ঘটনা আতঙ্ক বাড়িয়ে দেয়। বছরজুড়েই ছিল সড়কে দুর্ঘটনায় দুঃসহ মৃত্যুর মিছিল। তবে বছরের শেষে রেলপথে নতুন সংযোগের উদ্যোগ কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে।

সড়কে মৃত্যুর মিছিল

দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হয়েছে, অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সড়কে ঘটে গেছে ৬ হাজার ৪৭৪টি দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৫৯৯ জন, আহত হয়েছেন ১১ হাজার ০৬১ জন। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ জন মানুষের প্রাণ ঝরেছে সড়কে।

নিহতের বড় অংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। একইসঙ্গে বাস-ট্রাক-প্রাইভেটকারের ত্রিমুখী সংঘর্ষ, অটোরিকশা ও ইজিবাইক দুর্ঘটনাও প্রতিদিন প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় চরম দুর্বলতা আর নানাবিধ ত্রুটি দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে সামনে এসেছে।

বছরের শেষ মাসেও সড়কে রক্ত ঝরেছে। ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোলপ্লাজায় টোল পরিশোধে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসকে একটি বেপরোয়া বাস ধাক্কা দেয়। এতে পাঁচজন নিহত এবং ১০ জন আহত হন। ২২ ডিসেম্বর ঘন কুয়াশার কারণে শ্রীনগরের শিংপাড়া এলাকায় সাতটি গাড়ির সংঘর্ষ ঘটে। এতে একজন নিহত এবং অন্তত ১০ জন আহত হন। ২৩ ডিসেম্বর একই এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোলপ্লাজার কাছে ঘন কুয়াশার মধ্যে প্রাইভেটকারের পেছনে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় এক নারী নিহত এবং পাঁচজন আহত হন। ২৬ ডিসেম্বর নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ সড়কে ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে স্বামী-স্ত্রীসহ চারজন নিহত হন।

ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, চালকদের অদক্ষতা, বেপরোয়া গতি, শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা এবং বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার পাশাপাশি মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল এবং ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতাই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

সরকার পতনের পর সড়কে বিশৃঙ্খলার রাজত্ব

২০২৪ সালে রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনা যেন নিয়ন্ত্রণহীন এক মহাযুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়।’ নগর পরিবহন’ সেবা শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। ই-টিকেটিং পদ্ধতির আশা ছিল বাস ভাড়া নৈরাজ্য কমাবে, কিন্তু বছরের শুরুতেই তা মিলিয়ে যায়।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঢাকার সড়ক যেন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারায়। রাজধানী দখল করে নেয় অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে ঢাকায় ঢুকে পড়ে হাজার হাজার অটোরিকশা, যা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে পঙ্গু করে দেয়। প্রশাসনের একাধিক নিষেধাজ্ঞা ও অভিযানের পরও এগুলো নির্বিঘ্নে ফ্লাইওভার ও ভিআইপি সড়কে চলাচল শুরু করে। এমনকি সরকারি উদ্যোগও অটোরিকশার অবৈধ দৌরাত্ম্য রুখতে ব্যর্থ হয়েছে।

সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এতটাই ভেঙে পড়ে যে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে হয়। রাজধানীর শাহবাগ, কাকরাইল, মহাখালী, বনানীসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে একের পর এক সড়ক অবরোধের ঘটনায় যানজট দুর্বিষহ দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়। আন্দোলনকারীদের অবরোধ আর ট্রাফিক পুলিশের ব্যর্থতায় ঢাকার সড়ক একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে। তবে বছরের শেষ দিকে আন্দোলন ও সড়ক অবরোধ কিছুটা কমায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সামান্য উন্নতির আভাস পাওয়া যায়।

মেট্রোরেল ও বিআরটিএ ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ

২০২৪ সালের জুলাই মাস ছিল ঢাকার ইতিহাসে এক ভয়াবহ অধ্যায়, যেখানে সড়ক ও রেলপথে সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিআরটিএ ভবন ও মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে তাণ্ডব চলে, পাশাপাশি পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হামলা হয়।

মেট্রোরেলে তাণ্ডব

১৮ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের পর সেখানকার পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মিরপুর-১০ ফুটওভার ব্রিজের ওপর মেট্রোরেল স্টেশনে। ১৯ জুলাই মেট্রোরেলের মিরপুর-১০, কাজীপাড়া এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর চালানো হয়। পুরো মেট্রোরেল সেবা বন্ধ হয়। সেবা বন্ধ থাকার পর প্রায় ৩৭ দিন ধরে ঢাকার মেট্রোযাত্রীদের স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে। রাজধানীজুড়ে যানজটের তীব্রতা বাড়ে, মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়ে।

বিআরটিএ ভবনে আগুন

১৯ জুলাই দুপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-এর (বিআরটিএ) বনানীতে প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। মিরপুরে বিআরটিএ ভবনের ভেতরে দুর্বৃত্তরা ভাঙচুর চালানোর পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করে। হামলার ফলে বিআরটিএর মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস সনদ ও মালিকানা পরিবর্তনসহ সব ধরনের সেবা প্রায় এক মাস বন্ধ থাকে।

সেতু ভবনে হামলা

১৮ ও ১৯ জুলাই বনানীর সেতু ভবনে হামলা চালিয়ে যানবাহনসহ ভবনের নিচতলায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলার তাণ্ডব শেষে ৫৫টি গাড়ি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়। ভবনের বঙ্গবন্ধু কর্নার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, মিলনায়তনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পুরো সেতু ভবনও পুড়ে যায়। এতে বিপুল ক্ষতি হয় প্রতিষ্ঠানটির।

জোড়াতালির বিআরটি চালু

কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই বছরের শেষ দিকে জোড়াতালি দিয়ে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের বাস পরিষেবা চালু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে নিজস্ব কোম্পানির বাস চলার কথা থাকলেও বিআরটিসির ১০টি এসি বাস চালানো হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের ২৫টি স্টেশনের কোনোটিরই কাজ এখনো শেষ হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসভিত্তিক দ্রুত গতির পরিবহন বিআরটি। এর জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু তার বদলে বিআরটিসি বাস নামানো এক ধরনের ‘তামাশা।’

মেট্রোরেলে টিকিট সংকট

বছরের শুরুতে ২০ জানুয়ারি মেট্রোরেল পুরোপুরি উত্তরা থেকে মতিঝিল চলাচল শুরু করে। রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন গতি আনা এই পরিবহন ব্যবস্থায় যাত্রীদের জন্য দুই ধরনের টিকিট রয়েছে। একটি হলো এমআরটি পাস বা র‍্যাপিড পাস, অন্যটি একক যাত্রার টিকিট। র‍্যাপিড পাস কেনা যাত্রীরা টাকা না ফুরানো পর্যন্ত যেকোনো সময় যাত্রা করতে পারেন। আর একক যাত্রা করা যাত্রীদের স্টেশন থেকে তাৎক্ষণিক টিকিট কিনে যাত্রা করতে হয়। তবে বছরের শেষ দিকে একক যাত্রার টিকিট সংকটে পড়ে মেট্রোরেল। এর জন্য সাময়িক বন্ধ রাখতে হয় স্টেশনগুলো।

গত অক্টোবরে ডিএমটিসিএল জানায়, ২ লাখ ৪০ হাজারের মতো একক যাত্রার টিকিট খোয়া গেছে বা নষ্ট হয়েছে। খোয়া যাওয়া টিকিটগুলো যাত্রীরা ফেরত না দিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেছেন।

বন্ধ ঢাকা-কলকাতা ট্রেন চলাচল

জুলাই মাসে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের জেরে সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চলাচলকারী মৈত্রী এক্সপ্রেস, বন্ধন এক্সপ্রেস এবং মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১ আগস্ট স্বল্প দূরত্বের ট্রেনগুলো চালু হয়, কিন্তু আন্দোলন তীব্র হওয়ায় ৩ আগস্ট ফের বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১২ আগস্ট মালবাহী ট্রেন আবার চালু হয়। ১২ আগস্ট থেকে মেইল, এক্সপ্রেস, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলাচল শুরু করে। আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস আবার চালু হয় ১৫ আগস্ট থেকে। বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রীসেবা ফের চালু করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করলেও ইন্ডিয়ান রেলওয়ে বোর্ড তাদের পক্ষ থেকে অনুমতি দেয়নি।

পদ্মা সেতু রেলসংযোগ পুরোপুরি চালু

ঢাকা-ভাঙ্গা অংশ উদ্বোধনের ১৪ মাস পর গত ২৪ ডিসেম্বর পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হয়। প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের নতুন এই রেলপথে ঢাকা থেকে খুলনা, যশোর ও বেনাপোল রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। যাত্রীসেবা বাড়াতে দুটি রুটে ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ এবং ‘রূপসী বাংলা’ নামের দুটি আন্তনগর ট্রেনও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু নাম ভিন্ন হলেও ইঞ্জিন-কোচের সংকটে ট্রেন দুটি চলবে একটি রেক দিয়ে। নতুন রেলপথে ঢাকা থেকে খুলনায় ট্রেনে যেতে লাগবে পৌনে চার ঘণ্টা, যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে এই যাত্রায় সময় লাগে সাড়ে ৯ ঘণ্টা। বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে বেনাপোলে যেতে ট্রেনে সময় লাগে সাড়ে সাত ঘণ্টা। নতুন রেলপথে যেতে লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা।

শ্বেতপত্রে উঠে আসে বেহিসাবি খরচ

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ— যোগাযোগ খাতের এই পাঁচ মেগা প্রকল্পে সব মিলে ব্যয় বেড়েছে ৫৬ হাজার ৬০৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের এসব প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রাথমিক খরচের চেয়ে অনেক বেশি। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা শ্বেতপত্রে মেগা প্রকল্পের খরচের এমন চিত্র উঠে এসেছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলেছে, কয়েকটি প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। ফলে খরচ আরও বাড়তে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত