Ajker Patrika

ছাই বেচে কিস্তির বোঝা টানছেন জেসমিন

আশিকুর রিমেল
ছাই বেচে কিস্তির বোঝা টানছেন জেসমিন

রাজধানী শহরের উত্তর অংশে অর্থাৎ রামপুরা, বনশ্রী, আফতাবনগর এলাকার অলিগলিতে সকাল সকালই দেখা মিলবে জেসমিন আক্তারের। মাথায় বস্তা নিয়ে ছাই-ছাই-ছা...বলে ডাকতে শোনা যাবে চল্লিশোর্ধ্ব এই নারীকে।

একযুগ ধরে একই এলাকায় ছাই বেচেন তিনি। বস্তুত তাঁর মাথায় যে ছাইয়ের বস্তাটি আমরা দেখব, সেটি কয়েক মাস ধরে মূলত ঋণের বোঝায় রূপ নিয়েছে। সে খোঁজ অবশ্য কারও রাখার কথা নয়!

গাইবান্ধা জেলা সদরের পূর্বপাড়া এলাকায় বাড়ি জেসমিন আক্তারের। বাড়ির লোকজন তাঁকে জেবু বলে ডাকতেন। মুয়াজ্জিন বাবার একার আয়ে চলত তাঁদের ৫ ভাই ৫ বোনের সংসার। সে সময় সংসারে আয়ের জোগান দিতে স্থানীয় একটি ইটভাটায় কাজ করতেন  দুই ভাই। শিশু বয়সেই নিজেও বুঝে ফেলেছিলেন ঘরে ‘ভাতের’ অভাব। ইট ভাটায় ভাইয়ের সঙ্গে মাটি টেনে দেওয়ার কাজ করতেন নিজেও। তাতে আলাদা মজুরি না পেলেও ভাইয়ের পারিশ্রমিকের সঙ্গে খানিকটা যোগ হতো জেবুর শ্রমের দাম।
    
নিজের ভাষায় জেবু বলছিলেন, ‘ভাইয়ের সাতে ইটভাটাত মাটি টানার কাম করছি। ছোটবেলা থাকি কষ্ট করি বড় হইছি ভাই। কাম করতে কোনো লজ্জা পাই না।’

জেসমিনের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। তখন তাঁর বয়স ১৫ কিংবা ১৬ বছর। বিয়ের পর স্বামীর কোনো ঘর পাননি। ভাসুরের দেওয়া ঘরেই আশ্রিত ছিলেন। স্বামী দিনমজুর, কোনো রকমে সংসার চলছিল। চার বছর যেতেই তিনটি নতুন মুখ যোগ হয় সংসারে। অভাব বাড়তে শুরু করলে ২০০০ সালে স্বামী-স্ত্রী চলে আসেন ঢাকায়। সেই থেকে জীবনযুদ্ধের ধরণ পাল্টে যায় জেসমিনের।

স্বামীকে নিয়ে রামপুরার মোল্লাপাড়ায় ৩ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি ঘরে থাকেন জেবু। প্রতিদিন সকালে বনশ্রী এলাকার তিতাস রোডে ছাইয়ের ট্রাক আসে। সেখান থেকে প্রতি বস্তা ২০০ টাকা দরে ছাই কেনেন। এরপর রামপুরা, বনশ্রী, আফতাবনগর এলাকার ঘুরে ঘুরে ওই ছাই বিক্রি করেন। এক কাপ ছাই বেচেন ৩ টাকা, ৪ টাকা অথবা ৫ টাকায় অর্থাৎ যে যেমন দাম দেন সেই দামেই বেচে দেন। দিন শেষে বস্তা খালি হলে থলিতে জমা হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। 

তবে ছাই বেচে সপ্তাহে বিক্রি যেমনই হোক, তাঁর প্রয়োজন ৩ হাজার টাকা। ৪ লাখ টাকা ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে হয় তাঁকে। আর সপ্তাহজুড়ে সেই ঋণের বোঝাই মাথায় নিয়ে ছাই...ছাই... হেঁকে চলেন শহরের অলিগলি।

জেসমিন আক্তার বলেন, ‘আমি কয় মাস আগে স্ট্রোক করছিলাম। সে চিকিৎসার পুরা ট্যাকা টা ধার করছে আমার স্বামী। বেটিটার বিয়া দিলাম, জামাইকে কিছু ট্যাকা দিয়া ব্যবসা ধরে দিছি। গেরামে দুই শতক জায়গা কিনছি। জমানি কিছু ট্যাকা আছিল, সাতে আরও ৪ লাখ ট্যাকা ঋণ করছি। সেই ট্যাকার কিস্তি দেই প্রতি সপ্তাহে ৩ হাজার ট্যাকা।’

ছোট ছেলেটাকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। আগামীবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে সে। এতোদিন গ্রামের বাড়িতেই ছিল, তবে এ বছরের শুরুতেই ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। মা-বাবার কাছে থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দেবে তাঁর ছেলে এমনই পণ করেছে।
অবশ্য জেবুর ছেলেটিও ঢাকায় আসার পর বসে নেই। কাজ নিয়েছে একটি সিরামিকসের দোকানে। কিছুদিন নামমাত্র বেতন পাবে কিন্তু তিন মাস পর বেতন হবে ১২ হাজার টাকা। ঠিক যেমনটা জেবু নিজেও চেষ্টা করেছিলেন বাবার বাড়িতে।

ছেলের কথা বলতে গিয়ে জেসমিন আক্তার বলেন, ‘ছেলেটা আমাক কয়, আম্মা আমি বেতন পাইলে তোমাক আর কাজ করতে দেব না। তুমি খালি শুয়ে বসি আরাম করবা।’

জেসমিন আক্তার জেবুর সম্পর্কে আরও কিছু কথা না বললেই নয়। অবাক হয়ে শুনছিলাম তাঁর কথাগুলো। তেজস্বীনি এক নারীর প্রতিমূর্তি ফুটে উঠেছিল।

‘ভাই, আমার ছেলেটা যে কথাগুলো বলে, মা হিসাবে সেইটাই আমার শান্তি। আমি চাই না আমার ছেলে আর ছেলের বউ আমার মতো জীবন পার করুক। এই ঋণটা শোধ হইলে যা আয় করমু, কোনোমতো দিন চালায়ে হইলেও ছেলেটার জন্যে একটি ভবিষ্যৎ গড়ি দিয়া যাব।’

জেবু নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল। তিনি বলছিলেন, ‘আগে কাম-কাজ আমাক ভয় পাইতো, স্ট্রোক করার পর আমিই কাম-কাজ ভয় করি। তবুও যতদিন কাম কাজ করার শক্তি থাকবে, ততদিন ঢাকাত থাইকবো। যখন আর পাবোনা তখন গ্রামে চলি যাব। ওই জমিটাত দুইটা ছাপড়া ঘর তুলি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পাইলব। আমরা চলি গেলে ওই বাড়ি আমার ছেলে মেয়েরই হইবে।’

জেসমিন তাঁর স্বামীর পরিচয়ে শুধু জানালেন, বনশ্রীতে গার্ডের চাকরি করেন। আর কিছুই বলতে রাজি হলেন না। তবে সময়ের সঙ্গে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন বোঝা গেল জেবুর একটি কথায়। ছয় বছর আগের তাঁর স্বামী ওই চাকরি শুরু করেছিলেন ১ হাজার ৬০০ টাকায় আর এখন তাঁর বেতন ৯ হাজার টাকা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত