Ajker Patrika

ওয়মিয়াকোন: পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল আবাস?

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ১৫
ওয়মিয়াকোন: পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল আবাস?

রাশিয়ার উত্তর-পুবের অঞ্চল ইয়াকুটিয়ার ছোট্ট এক গ্রাম ওয়মিয়াকোন। একে বিবেচনা করা হয় মানুষের বসতি আছে পৃথিবীর এমন সবচেয়ে শীতল জায়গা হিসেবে। শীতে এখানকার গড় তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকের আগ পর্যন্ত জায়গাটি ছিল বল্গা হরিণপালকদের মৌসুমি বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। তবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার যাযাবর মানুষকে নির্দিষ্ট জায়গায় থিতু করার উদ্দেশ্যে একে স্থায়ী বসতি হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন। এখন গ্রামটিতে মোটামুটি ৫০০ লোকের বাস। তুষারপাত শুরু হলেই যেখানে বিভিন্ন দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেখানে ওয়মিয়াকোনের একমাত্র বিদ্যালয়টির দুয়ার বন্ধ হয় কেবল হিমাঙ্কের নিচে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে।

ওয়মিয়াকোন শব্দের অর্থ অবশ্য বেশ মজার, বরফে জমে না এমন পানি। কাছেই সত্যি একটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে, যেখানকার পানি কখনো জমে না।

 ঘরে জমে থাকা বরফের পরতওয়মিয়াকোনের বেশির ভাগ ঘর উষ্ণ রাখার জন্য এখনো কয়লা ও কাঠ পোড়ানো হয়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার খুব বেশি এখানকার মানুষ উপভোগ করতে পারে না। প্রচণ্ড শীতের কারণে বেশি কিছু জন্মায় না এই এলাকায়। তাই ওয়মিয়াকোনের বাসিন্দাদের প্রধান খাবার বল্গা হরিণ ও ঘোড়ার মাংস। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ তাই বল্গা হরিণ পোষে। এ ছাড়া শিকার আর আইস-ফিশিং বা বরফে মাছ ধরে তারা। এই শীতল রাজ্যের বিশেষ একটি খাবার হলো স্ট্রোগানিনা। জমাটবাঁধা মাছকে ফালি করে কেটে ছেঁচে এটি বানানো হয়।

ওয়মিয়াকোনে কিন্তু গ্রীষ্মকালও আছে। ক্ষণস্থায়ী গ্রীষ্ম জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাস নিয়ে। এ সময় কিন্তু তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও পৌঁছে যায়। এ সময় সামান্য কিছু সবজি চাষ হয় এই এলাকায়।

 প্রচণ্ড শীতে চোখের পাতা যায় জমেসাগরসমতল থেকে ১ হাজার মিটার উচ্চতায় গ্রামটি। এর অবস্থান এমন জায়গায় যে চারপাশ থেকে শীতল হাওয়া এসে হামলে পড়ে গ্রামটির ওপর। কাজেই ওয়মিয়াকোনের জীবন মোটেই সহজ নয়। কলমের কালি জমে যায় প্রচণ্ড ঠান্ডায়। দ্রুত ব্যাটারির পাওয়ার শেষ হয়ে যায়। চামড়ার সঙ্গে আটকে যায় ধাতু, ছাড়ানো মুশকিল হয়ে পড়ে তখন। তেলের ট্যাংকের নিচে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালানো না হলে গাড়ি স্টার্ট নেয় না। স্থানীয় পাওয়ার স্টেশন বাড়িতে উষ্ণ পানি সরবরাহের জন্য কয়লা পোড়ায়। অবশ্য এখানকার পানির পাইপ জমে ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টয়লেট থাকে মূল ঘরের বাইরে। 

 উৎসব হয় শীতল রাজ্যেওপ্রচণ্ড শীতল আবহাওয়ায় মৃতদেহ সমাধিস্থ করাও বড় সমস্যা। বরফে জমে যাওয়া জমিতে একটা কবর খুঁড়তে লাগে দুই থেকে তিন দিন। প্রথমে ঘণ্টা দুয়েক আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় কয়লা কিংবা কাঠ। এতে বরফ কিছুটা গলে। এবার ইঞ্চি দুয়েক গভীর একটা গর্ত খোঁড়া হয়। এভাবে দুই দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত গর্তটি একটি কফিন ঢোকানোর মতো বড় না হয়।

ওয়মিয়াকোনের এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় হিমাঙ্কের নিচে ৭১.২ ডিগ্রি বা ৯৬.১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এটি ১৯২৪ সালের ঘটনা। ওই দিনটিতে স্মরণ করে এখানকার টাউন স্কয়ারে একটি স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। একসময় এটি ছিল মানুষের বসতি আছে এমন জায়গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড।

 বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টয়লেট থাকে মূল ঘরের বাইরেওয়মিয়াকোনে করার খুব বেশি কিছু নেই। তবে এটা ট্যুর অপারেটর কোম্পানিগুলোর শীতের মাঝামাঝি সময়ে গ্রামটিতে পর্যটক নিয়ে যাওয়ায় কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। মানুষ সেখানে যায় পৃথিবীর শীতল জায়গায় বাস করার অনুভূতি কেমন তা জানতে। আবার এখানে বরফে মাছ ধরার আনন্দ থেকেও নিজেকে বঞ্চিত করতে চান না পর্যটকেরা। তা ছাড়া হিমাঙ্কের নিচে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এখানকার উষ্ণ পস্রবণ শরীর ছেড়ে দেওয়ার মজাও আলাদা।

কখনো কখনো তাপমাত্রা এতটাই নেমে যায় যে বাইরে থাকলে আপনার চোখের পাতা আর নিচে ফেলা থুতু জমে যায়। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখের ওই পাতা তখন যেন সুঁই হয়ে খোঁচায়। অবশ্য এ ঘটনা ঘটে কালেভদ্রে আর ঠান্ডায় খোলা জায়গায় বেশি সময় থাকলে। 

 বরফের পরত সবকিছুতেপ্রতিটি অন্ধকার শীতকালের শেষে পালিত হয় কোল্ড পোল ফেস্টিভ্যাল। বল্গা হরিণ দৌড়, স্লেজ নিয়ে কুকুর দৌড়, বরফে মাছ ধরাসহ নানা খেলায় মেতে ওঠে স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন পর্যটকেরা। তবে কাছের বিমানবন্দর ইয়াকুতস্ক থেকে দুই দিনের যাত্রা, কেবল সাহসীরাই সেখানে যাওয়ার কথা ভাবেন। তবে সেখানে পৌঁছে গেলে আর ঠান্ডায় মানিয়ে নিতে পারলে যে কয়েকটা দিন ভারি আনন্দে কাটবে তাতে সন্দেহ নেই।

সূত্র: এমিউজিং প্ল্যানেট, পিকি আওয়ার ট্রেইল. কম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত