রাজিউল হাসান, ঢাকা

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:
রাজিউল হাসান, ঢাকা

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:

আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
১ দিন আগে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত বুধবার মার্কিন বাহিনী ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছাকাছি অভিযান চালিয়ে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করেছে। ট্যাংকারে ভেনেজুয়েলা ও ইরানের তেল বহন করা হচ্ছিল বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এই ঘটনার পর ভেনেজুয়েলার তেল বহনের অভিযোগের আরও ছয়টি জাহাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, প্রথম ট্যাংকারটির অবস্থান (লোকেশন) গোপন করার বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি নিশ্চিত করেছেন, জব্দ হওয়া জাহাজটির নাম ‘স্কিপার’। তাঁর দাবি, এটি ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞা ভুক্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহনে ব্যবহৃত ক্রুড অয়েল ট্যাংকার।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর। জব্দ হওয়ার আগে এটি গত ৭ নভেম্বর থেকে তার অবস্থান প্রকাশ করেনি।
মেরিন অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপ্লার (Kpler) জানিয়েছে, ‘স্কিপার’-এর অবস্থান গোপন করার (স্পুফিং) দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জানা যায়, ২০২২ সালে যখন জাহাজটি ‘আদিশা’ (Adisa) নামে চলছিল, তখন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এটিকে একটি ‘আন্তর্জাতিক তেল পাচার নেটওয়ার্কের’ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘স্কিপার’ ঘন ঘন ট্র্যাকারকে মিথ্যা তথ্য দিত। যেমন, এআইএস সিস্টেমে জাহাজটি ৭ ও ৮ জুলাই ইরাকের বসরা অয়েল টার্মিনালে অবস্থান দেখালেও, টার্মিনাল রিপোর্টে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। উল্টো কেপ্লার জানিয়েছে, সেই সময়েই ট্যাংকারটি ইরানের খার্গ দ্বীপ থেকে অপরিশোধিত তেল বোঝাই করছিল। এ ছাড়া, ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজটি এআইএস-এ সম্পূর্ণ ভুল সংকেত পাঠাচ্ছিল, যা এর আসল অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘স্কিপার’ সম্ভবত ‘ডার্ক ফ্লিট’ নামক বিশ্বব্যাপী তেলবাহী ট্যাংকারের একটি নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কটি মালিকানা, পরিচয় এবং ভ্রমণ ইতিহাস গোপন করে তেলের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কাজ করে।
যদিও ‘স্কিপার’ গায়ানার পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করছিল, কিন্তু গায়ানা সরকার দ্রুত বিবৃতি দিয়ে জানায় যে ২০ বছর বয়সী এই ট্যাংকারটি তাদের দেশে নিবন্ধিত নয় এবং এটি ‘অবৈধভাবে গায়ানার পতাকা ব্যবহার করছিল’। জাহাজটির নিবন্ধিত মালিক হিসেবে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ-ভিত্তিক ‘ট্রাইটন নেভিগেশন করপোরেশন’-এর নাম রয়েছে। তবে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, এই ট্রাইটন করপোরেশনকে একজন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রুশ জ্বালানি ধনকুবের ভিক্তর আর্তেমভ তাঁর বৈশ্বিক ‘তেল পাচার নেটওয়ার্ক’ পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতেন।
ভেনেজুয়েলার তেল মজুত বিশ্বের বৃহত্তম হলেও, মাদুরোর প্রশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকে দেশটির তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ‘স্কিপার’ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। কেপ্লার বিশ্লেষকেরা জানান, ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দর থেকে প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন (১১ লাখ) ব্যারেল মেরে ক্রুড তেল বোঝাই করেছিল এবং গন্তব্য হিসেবে কিউবার নাম উল্লেখ করেছিল।
১১ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এটি পূর্বে যাত্রা করে একটি ‘শিপ-টু-শিপ ট্রান্সফার’ সম্পন্ন করে। এটির কার্গো পরে চীনেও ‘ভুয়া ঘোষিত’ হয়েছিল। মার্কিন অভিযানের মাত্র কয়েক দিন আগে, ৭ ডিসেম্বরে এটি ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে স্থানান্তরে জড়িত ছিল বলে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়। বেলজিয়ামের নৌবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট ফ্রেডেরিক ভ্যান লোকারেন জানান, এই ধরনের স্থানান্তর আইনত অবৈধ না হলেও, তা ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ এবং সাধারণত নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্যই করা হয়।
‘স্কিপার’ সর্বশেষ ৭ নভেম্বর তার অবস্থান ঘোষণা করে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায়। মার্কিন অভিযানে ১০ ডিসেম্বর এর অবস্থান পুনরায় দৃশ্যমান হয়। এই অন্তর্বর্তী সময়ে, ১৮ নভেম্বর স্যাটেলাইট চিত্রগুলো নিশ্চিত করছে যে ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দরে ছিল।
তথ্যসূত্র: বিবিসি

নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত বুধবার মার্কিন বাহিনী ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছাকাছি অভিযান চালিয়ে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করেছে। ট্যাংকারে ভেনেজুয়েলা ও ইরানের তেল বহন করা হচ্ছিল বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এই ঘটনার পর ভেনেজুয়েলার তেল বহনের অভিযোগের আরও ছয়টি জাহাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, প্রথম ট্যাংকারটির অবস্থান (লোকেশন) গোপন করার বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি নিশ্চিত করেছেন, জব্দ হওয়া জাহাজটির নাম ‘স্কিপার’। তাঁর দাবি, এটি ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞা ভুক্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহনে ব্যবহৃত ক্রুড অয়েল ট্যাংকার।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর। জব্দ হওয়ার আগে এটি গত ৭ নভেম্বর থেকে তার অবস্থান প্রকাশ করেনি।
মেরিন অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপ্লার (Kpler) জানিয়েছে, ‘স্কিপার’-এর অবস্থান গোপন করার (স্পুফিং) দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জানা যায়, ২০২২ সালে যখন জাহাজটি ‘আদিশা’ (Adisa) নামে চলছিল, তখন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এটিকে একটি ‘আন্তর্জাতিক তেল পাচার নেটওয়ার্কের’ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘স্কিপার’ ঘন ঘন ট্র্যাকারকে মিথ্যা তথ্য দিত। যেমন, এআইএস সিস্টেমে জাহাজটি ৭ ও ৮ জুলাই ইরাকের বসরা অয়েল টার্মিনালে অবস্থান দেখালেও, টার্মিনাল রিপোর্টে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। উল্টো কেপ্লার জানিয়েছে, সেই সময়েই ট্যাংকারটি ইরানের খার্গ দ্বীপ থেকে অপরিশোধিত তেল বোঝাই করছিল। এ ছাড়া, ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজটি এআইএস-এ সম্পূর্ণ ভুল সংকেত পাঠাচ্ছিল, যা এর আসল অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘স্কিপার’ সম্ভবত ‘ডার্ক ফ্লিট’ নামক বিশ্বব্যাপী তেলবাহী ট্যাংকারের একটি নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কটি মালিকানা, পরিচয় এবং ভ্রমণ ইতিহাস গোপন করে তেলের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কাজ করে।
যদিও ‘স্কিপার’ গায়ানার পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করছিল, কিন্তু গায়ানা সরকার দ্রুত বিবৃতি দিয়ে জানায় যে ২০ বছর বয়সী এই ট্যাংকারটি তাদের দেশে নিবন্ধিত নয় এবং এটি ‘অবৈধভাবে গায়ানার পতাকা ব্যবহার করছিল’। জাহাজটির নিবন্ধিত মালিক হিসেবে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ-ভিত্তিক ‘ট্রাইটন নেভিগেশন করপোরেশন’-এর নাম রয়েছে। তবে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, এই ট্রাইটন করপোরেশনকে একজন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রুশ জ্বালানি ধনকুবের ভিক্তর আর্তেমভ তাঁর বৈশ্বিক ‘তেল পাচার নেটওয়ার্ক’ পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতেন।
ভেনেজুয়েলার তেল মজুত বিশ্বের বৃহত্তম হলেও, মাদুরোর প্রশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকে দেশটির তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ‘স্কিপার’ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। কেপ্লার বিশ্লেষকেরা জানান, ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দর থেকে প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন (১১ লাখ) ব্যারেল মেরে ক্রুড তেল বোঝাই করেছিল এবং গন্তব্য হিসেবে কিউবার নাম উল্লেখ করেছিল।
১১ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এটি পূর্বে যাত্রা করে একটি ‘শিপ-টু-শিপ ট্রান্সফার’ সম্পন্ন করে। এটির কার্গো পরে চীনেও ‘ভুয়া ঘোষিত’ হয়েছিল। মার্কিন অভিযানের মাত্র কয়েক দিন আগে, ৭ ডিসেম্বরে এটি ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে স্থানান্তরে জড়িত ছিল বলে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়। বেলজিয়ামের নৌবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট ফ্রেডেরিক ভ্যান লোকারেন জানান, এই ধরনের স্থানান্তর আইনত অবৈধ না হলেও, তা ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ এবং সাধারণত নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্যই করা হয়।
‘স্কিপার’ সর্বশেষ ৭ নভেম্বর তার অবস্থান ঘোষণা করে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায়। মার্কিন অভিযানে ১০ ডিসেম্বর এর অবস্থান পুনরায় দৃশ্যমান হয়। এই অন্তর্বর্তী সময়ে, ১৮ নভেম্বর স্যাটেলাইট চিত্রগুলো নিশ্চিত করছে যে ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দরে ছিল।
তথ্যসূত্র: বিবিসি

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন, তখন একই অফিসে বসে সৌম্যা বসরমালিংগম বিভিন্ন ভিডিওর ঘরানা, চরিত্রের মুড ও টোন বিশ্লেষণ করছেন। আসলে তাঁরা দুজনই এমন এক শিল্পের কর্মী, যে শিল্প বিশ্বজুড়ে এআই মডেল প্রশিক্ষণের জন্য বিপুল পরিমাণ তথ্য ছাঁকছে ও বিশ্লেষণ করছে।
এই কাজকে প্রযুক্তি জগতে বলা হয় ডেটা অ্যানোটেশন—যেখানে মানুষ ছবি, ভিডিও ও টেক্সট ডেটাকে ট্যাগ করে এআইয়ের শেখার উপযোগী করে তোলে। ভারত এখন এই শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। ২০২০ সালে যেখানে মাত্র ৭০ হাজার মানুষ এই খাতে কাজ করত, ২০৩০ সালের মধ্যে তা পৌঁছাতে পারে ১০ লাখে। একই সময়ে এই বাজারের মূল্য বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হতে পরে বলে জানিয়েছে ভারতের সফটওয়্যার শিল্প সংস্থা নাস্কম।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই ৭১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ হাজারের বেশি চাকরি হারানোর কারণ হিসেবে সরাসরি এআইকে দায়ী করা হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকায় এআই–সম্পর্কিত ছাঁটাইয়ের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি—মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন, মেটা—সবাই কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে এআইকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু একই এআই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাগুলোর আউটসোর্সিং বাড়িয়ে দিচ্ছে এশিয়ায়। এর ফলে পাকিস্তান, ভারত ও ফিলিপাইনে আউটসোর্সিং কর্মীসংখ্যা গত পাঁচ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন—দক্ষিণ এশিয়ার কম খরচের দক্ষ জনবলকে এআই সহজে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। স্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ নিল মাহোনি বলেন, ‘যে কাজ খুব সহজ এবং ব্যয়বহুল—সেই কাজই প্রথমে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। এশিয়ার শ্রমবাজার এখনো খুব সস্তা।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে এআই–চালিত ‘হিউম্যান ইন দ্য লুপ’ মডেল আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে—যেখানে মানুষ এআইয়ের ভুল সংশোধন করবে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের নেক্সটওয়েলথ কোম্পানির কাজ উল্লেখযোগ্য। তারা এমন দোকানে নজরদারি করে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ক্যাশিয়ার ছাড়াই কেনাকাটা করা যায়। কোনো ভুল হলে কয়েক সেকেন্ডেই মানুষ যাচাই করে তা সংশোধন করে।
এই সব কাজ ভারতের ছোট শহরের যুবকদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। কারুর শহরের সেই কর্মী ধারাণি চন্দ্রশেখর জানান, পারিবারিক কারণে তিনি কখনো বড় শহরে চাকরি খোঁজেননি, কিন্তু এখন তিনি প্রযুক্তি খাতে কাজ করতে পারছেন নিজের শহরেই। অন্যদিকে তাঁর সহকর্মী ধনাসীলন পলানিয়াপ্পান এই শিল্পে কাজ করে জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশযাত্রার সুযোগ পেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি চীনের কিংদাও শহরে গিয়েছিলেন ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে।
এআই যতই উন্নত হোক, শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেটা অ্যানোটেশনের প্রয়োজন কখনোই শেষ হবে না। কারণ বাস্তব জগতে কাজ করতে গেলে এআইকে সব সময় মানুষের সুপারভিশনের প্রয়োজন হবে। এমনকি মেটার মতো কোম্পানি যখন স্কেল এআই–এ ১৪.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তখন তা প্রমাণ করে এই ক্ষেত্রের গুরুত্ব কমছে না।
তবুও অনেক কর্মীর মনের ভেতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এআই কি একদিন আমাদের চাকরি খেয়ে ফেলবে? কারুরের তরুণ নবিন বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তির যুগের সবচেয়ে বড় ঢেউয়ের সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু মনে মনে একটা ভয় তো থেকেই যায়—এআই যেন আমাদের জায়গা দখল না করে।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন, তখন একই অফিসে বসে সৌম্যা বসরমালিংগম বিভিন্ন ভিডিওর ঘরানা, চরিত্রের মুড ও টোন বিশ্লেষণ করছেন। আসলে তাঁরা দুজনই এমন এক শিল্পের কর্মী, যে শিল্প বিশ্বজুড়ে এআই মডেল প্রশিক্ষণের জন্য বিপুল পরিমাণ তথ্য ছাঁকছে ও বিশ্লেষণ করছে।
এই কাজকে প্রযুক্তি জগতে বলা হয় ডেটা অ্যানোটেশন—যেখানে মানুষ ছবি, ভিডিও ও টেক্সট ডেটাকে ট্যাগ করে এআইয়ের শেখার উপযোগী করে তোলে। ভারত এখন এই শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। ২০২০ সালে যেখানে মাত্র ৭০ হাজার মানুষ এই খাতে কাজ করত, ২০৩০ সালের মধ্যে তা পৌঁছাতে পারে ১০ লাখে। একই সময়ে এই বাজারের মূল্য বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হতে পরে বলে জানিয়েছে ভারতের সফটওয়্যার শিল্প সংস্থা নাস্কম।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই ৭১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ হাজারের বেশি চাকরি হারানোর কারণ হিসেবে সরাসরি এআইকে দায়ী করা হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকায় এআই–সম্পর্কিত ছাঁটাইয়ের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি—মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন, মেটা—সবাই কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে এআইকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু একই এআই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাগুলোর আউটসোর্সিং বাড়িয়ে দিচ্ছে এশিয়ায়। এর ফলে পাকিস্তান, ভারত ও ফিলিপাইনে আউটসোর্সিং কর্মীসংখ্যা গত পাঁচ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন—দক্ষিণ এশিয়ার কম খরচের দক্ষ জনবলকে এআই সহজে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। স্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ নিল মাহোনি বলেন, ‘যে কাজ খুব সহজ এবং ব্যয়বহুল—সেই কাজই প্রথমে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। এশিয়ার শ্রমবাজার এখনো খুব সস্তা।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে এআই–চালিত ‘হিউম্যান ইন দ্য লুপ’ মডেল আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে—যেখানে মানুষ এআইয়ের ভুল সংশোধন করবে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের নেক্সটওয়েলথ কোম্পানির কাজ উল্লেখযোগ্য। তারা এমন দোকানে নজরদারি করে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ক্যাশিয়ার ছাড়াই কেনাকাটা করা যায়। কোনো ভুল হলে কয়েক সেকেন্ডেই মানুষ যাচাই করে তা সংশোধন করে।
এই সব কাজ ভারতের ছোট শহরের যুবকদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। কারুর শহরের সেই কর্মী ধারাণি চন্দ্রশেখর জানান, পারিবারিক কারণে তিনি কখনো বড় শহরে চাকরি খোঁজেননি, কিন্তু এখন তিনি প্রযুক্তি খাতে কাজ করতে পারছেন নিজের শহরেই। অন্যদিকে তাঁর সহকর্মী ধনাসীলন পলানিয়াপ্পান এই শিল্পে কাজ করে জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশযাত্রার সুযোগ পেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি চীনের কিংদাও শহরে গিয়েছিলেন ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে।
এআই যতই উন্নত হোক, শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেটা অ্যানোটেশনের প্রয়োজন কখনোই শেষ হবে না। কারণ বাস্তব জগতে কাজ করতে গেলে এআইকে সব সময় মানুষের সুপারভিশনের প্রয়োজন হবে। এমনকি মেটার মতো কোম্পানি যখন স্কেল এআই–এ ১৪.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তখন তা প্রমাণ করে এই ক্ষেত্রের গুরুত্ব কমছে না।
তবুও অনেক কর্মীর মনের ভেতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এআই কি একদিন আমাদের চাকরি খেয়ে ফেলবে? কারুরের তরুণ নবিন বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তির যুগের সবচেয়ে বড় ঢেউয়ের সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু মনে মনে একটা ভয় তো থেকেই যায়—এআই যেন আমাদের জায়গা দখল না করে।’

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
১ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ওয়াশিংটনে যখনই কোনো নতুন প্রশাসন আসে, সঙ্গে করে তারা নিজস্ব মতাদর্শগত অবস্থানও নিয়ে আসে। আর সঙ্গে অনিবার্যভাবে তারা এমন এক দলিল প্রকাশ করে, যেখানে তাদের জাতীয় নিরাপত্তানীতির ধারণাগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএস) সর্বশেষ সংস্করণটিও সেই চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। তবে এর তাৎপর্য আরও গভীরে—আগের কৌশলগত দলিলগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী যুগের বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতির ঐকমত্যের সামান্য হেরফেরকে প্রতিফলিত করে থাকলেও এই দলিল সেই ঐকমত্য থেকে এক নাটকীয় বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে।
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে এবং আমেরিকার পরিবর্তিত মানসিকতাও তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।
এশিয়ার জন্য এই দলিল এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে, যেখান থেকে বোঝা যায়—দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে দেখছে, কীভাবে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচার করছে ও চীনকে মূল্যায়ন করছে এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এই যুগে আমেরিকার নেতৃত্বকে কীভাবে কল্পনা করছে।
একদিকে এনএসএসে মাগা জাতীয়তাবাদের সেই পরিচিত ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে—যা সংযম, জাতীয়তাবাদ ও সর্বজনীন লক্ষ্যযুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করার এক মিশ্রণ। দলিলটি এমন একটি কৌশলের ডাক দিয়েছে, যা ঐতিহ্যগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়। তার বদলে এটি সবার ওপরে আমেরিকার জন্য যা কাজ করে বা সহজ কথায়, আমেরিকা ফার্স্ট—তা দিয়েই অনুপ্রাণিত।
নতুন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যের বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে আঞ্চলিক স্বার্থের পুনর্নবীকরণের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থের এক সংকীর্ণ সংজ্ঞার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। যেসব দেশ বহুদিন ধরে ওয়াশিংটনের উপদেশ দেওয়ার ধরনে ক্ষুব্ধ ছিল, তাদের জন্য এই পরিবর্তন একটি ‘স্বাগত জানানো’ আদর্শিক পুনর্বিন্যাস।
নতুন মার্কিন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য একই সঙ্গে সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ—দুটোই নিয়ে এসেছে। প্রথম ইতিবাচক দিকটি হলো—এই দলিলে এশিয়া বা আধুনিক কৌশলগত ভাষায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল পশ্চিমা গোলার্ধের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একেবারে শীর্ষে স্থান পেয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধ ট্রাম্পের কৌশলের মূল কেন্দ্রে রয়েছে। এশিয়ার ওপর এই মনোযোগ ওবামা প্রশাসনের ‘এশিয়া পিভট’, ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ এবং বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে। চীনের উত্থান ও এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে এই মনোযোগ অনিবার্য ছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো একক শক্তি যদি এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তার বিরোধিতা করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলের দীর্ঘকালীন মূল প্রতিপাদ্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এ বিষয়ের পুনরাবৃত্তি চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন এশিয়ার রাজধানীগুলোতে স্বাগত জানানো হবে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই কৌশল এশিয়াকে সেই চরম কঠোর সমালোচনা থেকে রেহাই দিয়েছে, যা তিনি ইউরোপের ওপর বর্ষণ করেছেন। এই নথিতে ইউরোপকে অবক্ষয়, নির্ভরশীলতা ও উদারনৈতিক বাড়াবাড়ির জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু এশিয়াকে স্পষ্ট কৌশলগত সম্মান দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে। ইউরোপকে ‘পশ্চিমা সভ্যতাকে রক্ষা’ করার জন্য সামরিক সক্রিয়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিপরীতে ইন্দো-প্যাসিফিক ও মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ও বাছাই করা হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। এর কারণ এই নয় যে, ট্রাম্প ইউরোপের চেয়ে এশিয়াকে বেশি পছন্দ করেন। বরং, মাগার আদর্শিক যুদ্ধ মূলত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও উদারনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার অভ্যন্তরের একটি গৃহযুদ্ধ। এশিয়া আপাতত এই বিবাদের বাইরে রয়েছে।
তৃতীয়ত, এশিয়া আন্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপর আমেরিকান সমালোচনার শিকার কম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমলাতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা মাগার ক্রোধের জন্ম দেয়; কিন্তু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাটতি থাকা এশিয়া এখন ট্রাম্পীয় বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও লেনদেনভিত্তিক সহযোগিতার ওপর কেন্দ্রীভূত। মানবাধিকার ও সামাজিক মানদণ্ডের ওপর উদার ও আন্তর্জাতিকতাবাদী জোর সব সময়ই অধিকাংশ এশীয় সরকারের কাছে নেতিবাচকভাবে গৃহীত হয়েছে। কেবল চীনই নয়, এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক অথচ গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী সমাজগুলোতেও একইভাবে মূল্যায়িত হয়েছে এই মার্কিন অবস্থান। তাদের কাছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর জোর এবং বিশ্বকে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর এক সম্প্রদায় হিসেবে দেখার ধারণাটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত।
চতুর্থত, বেইজিংসহ কিছু এশীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার বাগাড়ম্বরকে অবিশ্বাস করেছে। এই কথা পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে সান্ত্বনাদায়ক শোনালেও এশিয়ার কিছু অংশে এটি জবরদস্তিমূলক বা ভন্ডামি বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে, ওয়াশিংটন সব সময় তাদের উচ্চারিত নিয়মগুলো মেনে চলত না। ট্রাম্পের বাস্তববাদ ও স্বার্থের ওপর জোর এবং কূটনীতিকে বাণিজ্যনীতি হিসেবে দেখা ব্যাপকভাবে বিশ্বজুড়েই অনুরণিত হচ্ছে। আদর্শের ওপর উদারনৈতিক বাগাড়ম্বরে সন্দিহান এশীয় সরকারগুলো লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতায় স্বচ্ছন্দ। এই গত শরৎকালেও ট্রাম্পের এশিয়া ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করার জন্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। লেনদেনভিত্তিক একটি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝা, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং দর-কষাকষি করা তুলনামূলকভাবে সহজ।
পঞ্চমত, চীনকে প্রায় সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি ‘পারস্পরিক সুবিধাজনক অর্থনৈতিক সম্পর্কের’ আহ্বানকে স্বাগত জানাচ্ছে অনেক এশীয় রাষ্ট্র। ১৯৮০-এর দশক থেকে সিনো–মার্কিন ‘ঐক্য’ থেকে এশিয়ার একটি বৃহৎ অংশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে এবং তারা একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে অস্বস্তিতে আছে। ওয়াশিংটন বা বেইজিংয়ের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে না চাওয়ার যে ব্যাপক অনুভূতি, তা চীনকে প্রায় সমকক্ষ হিসেবে পুনরায় যুক্ত করার ট্রাম্পের আপাত ইচ্ছার মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়। ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বেশি দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের আহ্বান তাদের নিজস্ব কৌশলগত পরিচিতি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।
তবে এই সুসংবাদের আড়ালে কিছু উদ্বেগজনক দিকও রয়েছে, আছে ঝুঁকিও। প্রথমত, যদিও ট্রাম্পের সার্বভৌমত্ব ও হস্তক্ষেপ না করার ওপর জোর দেওয়াকে স্বাগত জানানো হচ্ছে, তবু এশিয়া খুব ভালোভাবেই ওয়াশিংটনের অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর কাঠামোগত প্রলোভন সম্পর্কে সচেতন। এটি নীতি থেকে নয়, বরং ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত। বৃহৎ শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করে, কারণ, তারা তা করতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই এটির দাবি করে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকি আমেরিকানদের শাস্তি দেওয়া ও জবরদস্তি করার স্থায়ী প্রবৃত্তিকেই তুলে ধরে। সংযমের ঘোষণা সেই প্রবৃত্তিকে দূর করবে না।
দ্বিতীয়ত, যদিও ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি এশিয়ায় অনুরণিত হয়, কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প সাধারণ লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে তাঁর বিশাল নতুন বিনিয়োগের দাবিগুলো এমন শর্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, যা কেবল চাঁদাবাজির মতো বলেই মনে করা যেতে পারে। একই রকম উদ্বেগজনক ছিল সাম্প্রতিক আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে চাপানো শর্তাবলি। এই ব্যবস্থাগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানানোর সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক আছে। বরং এগুলো ক্ষমতাগত অসামঞ্জস্যতা ও চাপকেই প্রতিফলিত করে। এশীয় রাষ্ট্রগুলো লেনদেনভিত্তিক নীতিকে স্বাগত জানাতে পারে, কিন্তু তারা জবরদস্তিমূলক ‘বাণিজ্যবাদে’ ক্ষুব্ধ।
তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনের নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা বর্জন এশীয় দেশগুলোর বাস্তববাদীদের খুশি করতে পারে। তবে এই বিসর্জনেরও মূল্য আছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকার করে, তবে এশিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর করুণার পাত্র হয়ে উঠবে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়ার বিষয়টি চীনা সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিষয়ে অবিলম্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ছোট এশীয় রাষ্ট্রগুলো বিস্তৃত, অনুমানযোগ্য নিয়ম চায়—তারা উদার আদর্শবাদী বলে নয়, বরং নিয়মগুলো দুর্বলকে শক্তিশালী থেকে রক্ষা করে বলে এটা চায়। এর পাশাপাশি, উদার মূল্যবোধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজ আন্দোলনগুলোকে হতাশ করবে, যারা দমন-পীড়নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকত।
চতুর্থত, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার ওপর ট্রাম্পের জোর বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির মধ্যে সম্ভাব্য আপস নিয়ে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করে, কিন্তু অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা ও সামরিক প্রতিযোগিতার মধ্যকার টানাপোড়েন বাস্তব এবং ক্রমবর্ধমান। চীনের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
নয়া নিরাপত্তা কৌশল: চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর যুক্তরাষ্ট্রেরওয়াশিংটন ও তার আঞ্চলিক অংশীদারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চীনা সক্ষমতা বাড়বে। মিত্রদের কাছে ট্রাম্পের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দাবি কিছু দেশকে চরম সমাধানের দিকে ঠেলে দিতে পারে—যার মধ্যে পারমাণবিক বিকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করাও অন্তর্ভুক্ত। চীন যে ক্রমশ তাঁর পক্ষে সামরিক ভারসাম্যকে স্থানান্তরিত করছে, এই উপলব্ধিতে এই অঞ্চলের উদ্বেগ আরও তীব্র হচ্ছে।
পঞ্চমত, তাইওয়ান নিয়ে এনএসএসের ভাষার তীব্র আলোচনা এশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূরাজনৈতিক ফাটলকে তুলে ধরে। তবু কেবল আভিধানিক বিতর্ক থেকে বোঝা যায় না যে, কোনো প্রকৃত সংকটে ট্রাম্প বা অন্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কীভাবে আচরণ করবেন। এ সময়ে আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও আমেরিকান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে। চীনা আক্রমণকে জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানাই তাকাইচির মন্তব্যের পর ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে যে পাল্টা চাপ দেওয়া হয়েছিল, তা একটি সতর্কসংকেত। এমনকি ট্রাম্প যখন এশীয় মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র এর বিনিময়ে কী সরবরাহ করবে, সে বিষয়ে তিনি কম স্পষ্টতা দিচ্ছেন। তাই এই কৌশলগত অস্পষ্টতা এখন প্রতিশ্রুতির বদলে অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে এশিয়া—ইউরোপের মতো নয়—যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি সময় ও সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেশি গুরুতর। রাশিয়ার বিপরীতে—যার শক্তিমত্তা ইউরোপের তুলনায় সীমিত—সেখানে চীন এশিয়ার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ওয়াশিংটন কীভাবে বেইজিংয়ের সঙ্গে তার জটিল সম্পর্ককে পরিচালিত করবে—যে সম্পর্ক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা দ্বারা চিহ্নিত। চীনের প্রতি মার্কিন নীতির দ্বিধাদ্বন্দ্ব ইন্দো-প্যাসিফিকজুড়ে মারাত্মক পরিণতি আনতে পারে।
এশিয়াকে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা ট্রাম্পবাদের কৌশলগত বিবর্তনের গতিপথকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা এশিয়ার নেই বললেই চলে। ইউরোপীয়রা হয়তো উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং আটলান্টিকতাবাদের পুনরুদ্ধারের আশা করতে পারেন, এশিয়ার সেই বিলাসিতা নেই। চীন যখন বিশাল আকার ধারণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক অভিমুখ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করছে, তখন এশিয়াকে স্বনির্ভরতার কৌশল অবলম্বন করতে হবে—জাতীয় সক্ষমতা জোরদার করা, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অংশীদারত্ব প্রসারিত করা এবং নমনীয় জোট গঠন করা।
একই সময়ে, এই কৌশলপত্র ওয়াশিংটন–সমর্থিত একটি ‘দায়িত্ব বণ্টন নেটওয়ার্ক’-এর প্রস্তাব করেছে। যেসব দেশ তাদের নিজেদের আশপাশে নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছায় আরও বেশি দায়িত্ব নেবে—তাদের বাণিজ্যিক বিষয়ে আরও অনুকূল আচরণ, প্রযুক্তি ভাগাভাগি ও প্রতিরক্ষা সংগ্রহের মাধ্যমে—যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকবে।’ এশিয়ার এই প্রস্তাবের সুযোগগুলো কাজে লাগানো উচিত।
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

ওয়াশিংটনে যখনই কোনো নতুন প্রশাসন আসে, সঙ্গে করে তারা নিজস্ব মতাদর্শগত অবস্থানও নিয়ে আসে। আর সঙ্গে অনিবার্যভাবে তারা এমন এক দলিল প্রকাশ করে, যেখানে তাদের জাতীয় নিরাপত্তানীতির ধারণাগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএস) সর্বশেষ সংস্করণটিও সেই চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। তবে এর তাৎপর্য আরও গভীরে—আগের কৌশলগত দলিলগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী যুগের বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতির ঐকমত্যের সামান্য হেরফেরকে প্রতিফলিত করে থাকলেও এই দলিল সেই ঐকমত্য থেকে এক নাটকীয় বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে।
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে এবং আমেরিকার পরিবর্তিত মানসিকতাও তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।
এশিয়ার জন্য এই দলিল এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে, যেখান থেকে বোঝা যায়—দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে দেখছে, কীভাবে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচার করছে ও চীনকে মূল্যায়ন করছে এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এই যুগে আমেরিকার নেতৃত্বকে কীভাবে কল্পনা করছে।
একদিকে এনএসএসে মাগা জাতীয়তাবাদের সেই পরিচিত ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে—যা সংযম, জাতীয়তাবাদ ও সর্বজনীন লক্ষ্যযুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করার এক মিশ্রণ। দলিলটি এমন একটি কৌশলের ডাক দিয়েছে, যা ঐতিহ্যগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়। তার বদলে এটি সবার ওপরে আমেরিকার জন্য যা কাজ করে বা সহজ কথায়, আমেরিকা ফার্স্ট—তা দিয়েই অনুপ্রাণিত।
নতুন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যের বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে আঞ্চলিক স্বার্থের পুনর্নবীকরণের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থের এক সংকীর্ণ সংজ্ঞার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। যেসব দেশ বহুদিন ধরে ওয়াশিংটনের উপদেশ দেওয়ার ধরনে ক্ষুব্ধ ছিল, তাদের জন্য এই পরিবর্তন একটি ‘স্বাগত জানানো’ আদর্শিক পুনর্বিন্যাস।
নতুন মার্কিন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য একই সঙ্গে সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ—দুটোই নিয়ে এসেছে। প্রথম ইতিবাচক দিকটি হলো—এই দলিলে এশিয়া বা আধুনিক কৌশলগত ভাষায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল পশ্চিমা গোলার্ধের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একেবারে শীর্ষে স্থান পেয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধ ট্রাম্পের কৌশলের মূল কেন্দ্রে রয়েছে। এশিয়ার ওপর এই মনোযোগ ওবামা প্রশাসনের ‘এশিয়া পিভট’, ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ এবং বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে। চীনের উত্থান ও এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে এই মনোযোগ অনিবার্য ছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো একক শক্তি যদি এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তার বিরোধিতা করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলের দীর্ঘকালীন মূল প্রতিপাদ্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এ বিষয়ের পুনরাবৃত্তি চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন এশিয়ার রাজধানীগুলোতে স্বাগত জানানো হবে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই কৌশল এশিয়াকে সেই চরম কঠোর সমালোচনা থেকে রেহাই দিয়েছে, যা তিনি ইউরোপের ওপর বর্ষণ করেছেন। এই নথিতে ইউরোপকে অবক্ষয়, নির্ভরশীলতা ও উদারনৈতিক বাড়াবাড়ির জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু এশিয়াকে স্পষ্ট কৌশলগত সম্মান দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে। ইউরোপকে ‘পশ্চিমা সভ্যতাকে রক্ষা’ করার জন্য সামরিক সক্রিয়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিপরীতে ইন্দো-প্যাসিফিক ও মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ও বাছাই করা হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। এর কারণ এই নয় যে, ট্রাম্প ইউরোপের চেয়ে এশিয়াকে বেশি পছন্দ করেন। বরং, মাগার আদর্শিক যুদ্ধ মূলত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও উদারনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার অভ্যন্তরের একটি গৃহযুদ্ধ। এশিয়া আপাতত এই বিবাদের বাইরে রয়েছে।
তৃতীয়ত, এশিয়া আন্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপর আমেরিকান সমালোচনার শিকার কম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমলাতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা মাগার ক্রোধের জন্ম দেয়; কিন্তু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাটতি থাকা এশিয়া এখন ট্রাম্পীয় বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও লেনদেনভিত্তিক সহযোগিতার ওপর কেন্দ্রীভূত। মানবাধিকার ও সামাজিক মানদণ্ডের ওপর উদার ও আন্তর্জাতিকতাবাদী জোর সব সময়ই অধিকাংশ এশীয় সরকারের কাছে নেতিবাচকভাবে গৃহীত হয়েছে। কেবল চীনই নয়, এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক অথচ গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী সমাজগুলোতেও একইভাবে মূল্যায়িত হয়েছে এই মার্কিন অবস্থান। তাদের কাছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর জোর এবং বিশ্বকে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর এক সম্প্রদায় হিসেবে দেখার ধারণাটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত।
চতুর্থত, বেইজিংসহ কিছু এশীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার বাগাড়ম্বরকে অবিশ্বাস করেছে। এই কথা পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে সান্ত্বনাদায়ক শোনালেও এশিয়ার কিছু অংশে এটি জবরদস্তিমূলক বা ভন্ডামি বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে, ওয়াশিংটন সব সময় তাদের উচ্চারিত নিয়মগুলো মেনে চলত না। ট্রাম্পের বাস্তববাদ ও স্বার্থের ওপর জোর এবং কূটনীতিকে বাণিজ্যনীতি হিসেবে দেখা ব্যাপকভাবে বিশ্বজুড়েই অনুরণিত হচ্ছে। আদর্শের ওপর উদারনৈতিক বাগাড়ম্বরে সন্দিহান এশীয় সরকারগুলো লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতায় স্বচ্ছন্দ। এই গত শরৎকালেও ট্রাম্পের এশিয়া ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করার জন্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। লেনদেনভিত্তিক একটি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝা, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং দর-কষাকষি করা তুলনামূলকভাবে সহজ।
পঞ্চমত, চীনকে প্রায় সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি ‘পারস্পরিক সুবিধাজনক অর্থনৈতিক সম্পর্কের’ আহ্বানকে স্বাগত জানাচ্ছে অনেক এশীয় রাষ্ট্র। ১৯৮০-এর দশক থেকে সিনো–মার্কিন ‘ঐক্য’ থেকে এশিয়ার একটি বৃহৎ অংশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে এবং তারা একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে অস্বস্তিতে আছে। ওয়াশিংটন বা বেইজিংয়ের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে না চাওয়ার যে ব্যাপক অনুভূতি, তা চীনকে প্রায় সমকক্ষ হিসেবে পুনরায় যুক্ত করার ট্রাম্পের আপাত ইচ্ছার মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়। ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বেশি দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের আহ্বান তাদের নিজস্ব কৌশলগত পরিচিতি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।
তবে এই সুসংবাদের আড়ালে কিছু উদ্বেগজনক দিকও রয়েছে, আছে ঝুঁকিও। প্রথমত, যদিও ট্রাম্পের সার্বভৌমত্ব ও হস্তক্ষেপ না করার ওপর জোর দেওয়াকে স্বাগত জানানো হচ্ছে, তবু এশিয়া খুব ভালোভাবেই ওয়াশিংটনের অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর কাঠামোগত প্রলোভন সম্পর্কে সচেতন। এটি নীতি থেকে নয়, বরং ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত। বৃহৎ শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করে, কারণ, তারা তা করতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই এটির দাবি করে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকি আমেরিকানদের শাস্তি দেওয়া ও জবরদস্তি করার স্থায়ী প্রবৃত্তিকেই তুলে ধরে। সংযমের ঘোষণা সেই প্রবৃত্তিকে দূর করবে না।
দ্বিতীয়ত, যদিও ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি এশিয়ায় অনুরণিত হয়, কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প সাধারণ লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে তাঁর বিশাল নতুন বিনিয়োগের দাবিগুলো এমন শর্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, যা কেবল চাঁদাবাজির মতো বলেই মনে করা যেতে পারে। একই রকম উদ্বেগজনক ছিল সাম্প্রতিক আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে চাপানো শর্তাবলি। এই ব্যবস্থাগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানানোর সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক আছে। বরং এগুলো ক্ষমতাগত অসামঞ্জস্যতা ও চাপকেই প্রতিফলিত করে। এশীয় রাষ্ট্রগুলো লেনদেনভিত্তিক নীতিকে স্বাগত জানাতে পারে, কিন্তু তারা জবরদস্তিমূলক ‘বাণিজ্যবাদে’ ক্ষুব্ধ।
তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনের নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা বর্জন এশীয় দেশগুলোর বাস্তববাদীদের খুশি করতে পারে। তবে এই বিসর্জনেরও মূল্য আছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকার করে, তবে এশিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর করুণার পাত্র হয়ে উঠবে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়ার বিষয়টি চীনা সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিষয়ে অবিলম্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ছোট এশীয় রাষ্ট্রগুলো বিস্তৃত, অনুমানযোগ্য নিয়ম চায়—তারা উদার আদর্শবাদী বলে নয়, বরং নিয়মগুলো দুর্বলকে শক্তিশালী থেকে রক্ষা করে বলে এটা চায়। এর পাশাপাশি, উদার মূল্যবোধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজ আন্দোলনগুলোকে হতাশ করবে, যারা দমন-পীড়নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকত।
চতুর্থত, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার ওপর ট্রাম্পের জোর বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির মধ্যে সম্ভাব্য আপস নিয়ে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করে, কিন্তু অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা ও সামরিক প্রতিযোগিতার মধ্যকার টানাপোড়েন বাস্তব এবং ক্রমবর্ধমান। চীনের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
নয়া নিরাপত্তা কৌশল: চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর যুক্তরাষ্ট্রেরওয়াশিংটন ও তার আঞ্চলিক অংশীদারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চীনা সক্ষমতা বাড়বে। মিত্রদের কাছে ট্রাম্পের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দাবি কিছু দেশকে চরম সমাধানের দিকে ঠেলে দিতে পারে—যার মধ্যে পারমাণবিক বিকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করাও অন্তর্ভুক্ত। চীন যে ক্রমশ তাঁর পক্ষে সামরিক ভারসাম্যকে স্থানান্তরিত করছে, এই উপলব্ধিতে এই অঞ্চলের উদ্বেগ আরও তীব্র হচ্ছে।
পঞ্চমত, তাইওয়ান নিয়ে এনএসএসের ভাষার তীব্র আলোচনা এশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূরাজনৈতিক ফাটলকে তুলে ধরে। তবু কেবল আভিধানিক বিতর্ক থেকে বোঝা যায় না যে, কোনো প্রকৃত সংকটে ট্রাম্প বা অন্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কীভাবে আচরণ করবেন। এ সময়ে আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও আমেরিকান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে। চীনা আক্রমণকে জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানাই তাকাইচির মন্তব্যের পর ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে যে পাল্টা চাপ দেওয়া হয়েছিল, তা একটি সতর্কসংকেত। এমনকি ট্রাম্প যখন এশীয় মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র এর বিনিময়ে কী সরবরাহ করবে, সে বিষয়ে তিনি কম স্পষ্টতা দিচ্ছেন। তাই এই কৌশলগত অস্পষ্টতা এখন প্রতিশ্রুতির বদলে অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে এশিয়া—ইউরোপের মতো নয়—যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি সময় ও সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেশি গুরুতর। রাশিয়ার বিপরীতে—যার শক্তিমত্তা ইউরোপের তুলনায় সীমিত—সেখানে চীন এশিয়ার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ওয়াশিংটন কীভাবে বেইজিংয়ের সঙ্গে তার জটিল সম্পর্ককে পরিচালিত করবে—যে সম্পর্ক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা দ্বারা চিহ্নিত। চীনের প্রতি মার্কিন নীতির দ্বিধাদ্বন্দ্ব ইন্দো-প্যাসিফিকজুড়ে মারাত্মক পরিণতি আনতে পারে।
এশিয়াকে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা ট্রাম্পবাদের কৌশলগত বিবর্তনের গতিপথকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা এশিয়ার নেই বললেই চলে। ইউরোপীয়রা হয়তো উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং আটলান্টিকতাবাদের পুনরুদ্ধারের আশা করতে পারেন, এশিয়ার সেই বিলাসিতা নেই। চীন যখন বিশাল আকার ধারণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক অভিমুখ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করছে, তখন এশিয়াকে স্বনির্ভরতার কৌশল অবলম্বন করতে হবে—জাতীয় সক্ষমতা জোরদার করা, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অংশীদারত্ব প্রসারিত করা এবং নমনীয় জোট গঠন করা।
একই সময়ে, এই কৌশলপত্র ওয়াশিংটন–সমর্থিত একটি ‘দায়িত্ব বণ্টন নেটওয়ার্ক’-এর প্রস্তাব করেছে। যেসব দেশ তাদের নিজেদের আশপাশে নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছায় আরও বেশি দায়িত্ব নেবে—তাদের বাণিজ্যিক বিষয়ে আরও অনুকূল আচরণ, প্রযুক্তি ভাগাভাগি ও প্রতিরক্ষা সংগ্রহের মাধ্যমে—যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকবে।’ এশিয়ার এই প্রস্তাবের সুযোগগুলো কাজে লাগানো উচিত।
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
১ দিন আগে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’।
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’। বহু চীনা নাগরিকের কাছেও অপরিচিত এই শব্দটির অর্থ হলো—সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোনো বার্তা বা আদেশ পৌঁছে দেওয়া। এবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই শব্দটির ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল শীর্ষ নির্দেশেই—অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আদেশে।
তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সি চিনপিং সরাসরি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার ফোনালাপে সি অর্ধেক সময় ব্যয় করেন তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থান বুঝিয়ে বলতে। ট্রাম্প পরে মন্তব্য করেন—সির উপস্থিতিতে পাশে থাকা কর্মকর্তারা ভয়ে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সির এই ক্ষোভের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ডাইতো বুনকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকাশি সুজুকির বক্তব্য অনুযায়ী, সি চিনপিং বিশ্বাস করেন তাইওয়ান ইস্যুর মূল উৎস ১৮৯৪-৯৫ সালের প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে অনেক শক্তিশালী কুইং সাম্রাজ্য সহজেই পরাজিত হয় উদীয়মান জাপানের কাছে এবং সেই পরাজয়ের পরই তাইওয়ান চলে যায় জাপানের অধীনে।
২০১৮ সালে সির লিউগং দ্বীপ সফরও এই ঐতিহাসিক ক্ষতের স্মরণ। এ দ্বীপেই অবস্থান করত বেইয়াং নৌবহর, যেটিকে একসময় এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ১৮৯৫ সালে জাপানের হামলায় তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। সির সফর ছিল ওই পরাজয় মনে রাখার বার্তা, যেন আবারও চীন দুর্বলতা প্রদর্শন করে একই পরিণতির শিকার না হয়।
বর্তমানে পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীর বিমানের দিকে চীনা যুদ্ধবিমান রাডার লক্ষ্য করে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। চীন অভিযোগ করছে, তাকাইচির মন্তব্য দিয়ে জাপান তাইওয়ান প্রশ্নে সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে জাপানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—এমন ব্যাখ্যা অতিরঞ্জিত; তাদের না ইচ্ছা আছে, না সক্ষমতা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অচলাবস্থা কাটাতে সবচেয়ে জরুরি হলো সংলাপের সুযোগ তৈরি করা। অবিশ্বাস দূর করে আলোচনার টেবিলে ফিরে এলে তবেই উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সি চিনপিংয়ের রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি অচলাবস্থাতেই থাকতে পারে।

চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’। বহু চীনা নাগরিকের কাছেও অপরিচিত এই শব্দটির অর্থ হলো—সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোনো বার্তা বা আদেশ পৌঁছে দেওয়া। এবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই শব্দটির ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল শীর্ষ নির্দেশেই—অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আদেশে।
তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সি চিনপিং সরাসরি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার ফোনালাপে সি অর্ধেক সময় ব্যয় করেন তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থান বুঝিয়ে বলতে। ট্রাম্প পরে মন্তব্য করেন—সির উপস্থিতিতে পাশে থাকা কর্মকর্তারা ভয়ে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সির এই ক্ষোভের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ডাইতো বুনকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকাশি সুজুকির বক্তব্য অনুযায়ী, সি চিনপিং বিশ্বাস করেন তাইওয়ান ইস্যুর মূল উৎস ১৮৯৪-৯৫ সালের প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে অনেক শক্তিশালী কুইং সাম্রাজ্য সহজেই পরাজিত হয় উদীয়মান জাপানের কাছে এবং সেই পরাজয়ের পরই তাইওয়ান চলে যায় জাপানের অধীনে।
২০১৮ সালে সির লিউগং দ্বীপ সফরও এই ঐতিহাসিক ক্ষতের স্মরণ। এ দ্বীপেই অবস্থান করত বেইয়াং নৌবহর, যেটিকে একসময় এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ১৮৯৫ সালে জাপানের হামলায় তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। সির সফর ছিল ওই পরাজয় মনে রাখার বার্তা, যেন আবারও চীন দুর্বলতা প্রদর্শন করে একই পরিণতির শিকার না হয়।
বর্তমানে পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীর বিমানের দিকে চীনা যুদ্ধবিমান রাডার লক্ষ্য করে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। চীন অভিযোগ করছে, তাকাইচির মন্তব্য দিয়ে জাপান তাইওয়ান প্রশ্নে সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে জাপানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—এমন ব্যাখ্যা অতিরঞ্জিত; তাদের না ইচ্ছা আছে, না সক্ষমতা।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অচলাবস্থা কাটাতে সবচেয়ে জরুরি হলো সংলাপের সুযোগ তৈরি করা। অবিশ্বাস দূর করে আলোচনার টেবিলে ফিরে এলে তবেই উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সি চিনপিংয়ের রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি অচলাবস্থাতেই থাকতে পারে।

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর।
১ দিন আগে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন...
২ দিন আগে
এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃ
৩ দিন আগে