Ajker Patrika

বড় হচ্ছে গুপ্তহত্যার ক্লাব, নতুন সদস্য ভারত

আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০: ৪৮
বড় হচ্ছে গুপ্তহত্যার ক্লাব, নতুন সদস্য ভারত

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।

নিহত ওই ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার। কানাডা পুলিশ বলছে, নিখিলের বেশ কয়েকজন টার্গেটের মধ্যে হরদীপ একজন। কারণ নিখিল তাঁর সেই পরিচিতজনকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে।’ 

মার্কিন কৌঁসুলিদের মতে, নিখিল নিউইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী এবং শিখস ফর জাস্টিস সংগঠনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, শিখস ফর জাস্টিসের দুই নেতা পান্নুন এবং নিজ্জার স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন। এ কারণেই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই গণভোটের মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করা। 

কানাডা এখনো নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নিখিলকে গত জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে দাখিল করা একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, নিখিল পান্নুনকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চালচক্রে ভাড়াটে খুনি খুঁজতে গিয়ে মার্কিন পুলিশেরই এক সোর্সকে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন তিনি।

এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ভারত এমন একটি ক্লাবের সদস্য হয়ে উঠবে যারা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুপ্তহত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে ফের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত মিলছে, যে চর্চাটি দীর্ঘকাল ধরে শুধু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই ছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিরোধীদের গুপ্তহত্যার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে ভারত সরকারের গুপ্তহত্যার লক্ষ্য পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার ঘটনার পর ভারতের বিরুদ্ধে সেই সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে। 

বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের। হামাসের সিনিয়র নেতাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দেশটি গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যেই হামাসের অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতাকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। 

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলে, কোনো নিন্দা না হলে, বিচার না হলে এটি বাড়বে। এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও স্থায়ীকরণের উপাদান।’ 

সৌদি আরবের গুপ্তহত্যার তদন্তকারী কমিটির নেতৃত্বদানকারী ক্যালামার্ড বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আমাদের আরও খারাপ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ 

আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা নিঃসন্দেহে বেআইনি। আর কূটনৈতিক কনভেনশন অনুযায়ী এটি আরও বড় অপরাধ, যা যুদ্ধের সমতুল্য। 

এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে ভয় এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ–সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় বেশির ভাগ দেশ গুপ্তহত্যা থেকে বিরত ছিল। এরপরও যেসব দেশ জড়িয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ আইন মেনে কাকে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে তা নির্ধারণ করেছে। 

গুপ্তহত্যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তি গুপ্তহত্যায় জড়িয়েছিল, যদিও খুবই ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯৬৪ সালের সিআইএ মেমো রিপোর্ট বলছে, সোভিয়েতরা গুপ্তহত্যার টার্গেট করত কেবল সেই ব্যক্তিদের যারা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক এবং যাদের কোনোভাবেই অপহরণ করা যায় না। 

সাধারণভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তহত্যা নিজ দেশের সেসব নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যারা বিদেশ থেকে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করছিল। ১৯৪০ সালে মেক্সিকো সিটির একটি বাড়িতে লিওন ট্রটস্কিকে বরফ ভাঙার সুচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে ক্রেমলিনের শত্রুদের দেশে এবং বিদেশের মাটিতে অপহরণ বা হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমও করেছে: জার্মান আইনজীবী ওয়াল্টার লিন্সকে মার্কিন–অধিকৃত বার্লিন থেকে অপহরণ এবং ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়েছিল। 

আমেরিকার বিশ্ব নেতাদের খুনের তালিকায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ২০০৭ সালে সিআইএর কুখ্যাত গুপ্তহত্যার তথ্য ফাঁস হয়, এই নথি ‘ফ্যামিলি জুয়েলস’ নামে বিখ্যাত। সেখানে দেখা যায়, বিদেশি কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে সিআইএ। এর মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার অসংখ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া সিআইএর হত্যার তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনগো দিন দিম এবং কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। তবে সিআইএ তাঁদের হত্যা করার আগেই মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানে তাঁরা নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ পেলে মার্কিন সিনেটে ‘চার্চ কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।

তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, যুদ্ধের অংশ হিসেবে হলেও ‘গুপ্তহত্যা’ আমেরিকান নীতি, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার এটি হতে পারে না, একে প্রত্যাখ্যান করা উচিত। 

এরপর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হন এবং আইন পাস করেন। 

গুপ্তহত্যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া 
গুপ্তহত্যার বেশির ভাগই করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। ব্যতিক্রম হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিদেশের মাটিতে প্রায় দুই ডজন গুপ্তহত্যার পেছনে ইরানকে দায়ী করা হয়। এসবের কিছু ফলও ভোগ করতে হয়েছে তেহরানকে। 

 ১৯৮০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ইরানের একটি হিট স্কোয়াডকে ক্ষমা করে দেয় ফ্রান্স। ইরান এক দশক পরে প্যারিসে বখতিয়ারকে শেষমেশ হত্যা করেই ছাড়ে। 

নিউইয়র্ক সিটিতে নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী মাসিহ আলিনেজাদ অন্তত দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানের ভাড়াটে বন্দুকধারীরা ২০২১ সালে তাঁকে আটক করে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তা ব্যর্থ করে দেয়। ২০২২ সালে এই লেখককে হত্যার উদ্দেশ্যে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারও তারা পুলিশের হাতে আটক হয়।

গত বছরের হ্যালিফ্যাক্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ফোরামে আলিনেজাদ বলেন, যে লোকটিকে আসলে ব্রুকলিনে আমার বাড়ির সামনে থেকে একে–৪৭ বন্দুকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি আগে ইউরোপের একটি অপরাধী চক্রের অংশ ছিলেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো—স্বৈরাচারীরা কেবল নিজ দেশের লোকদেরই নয়, সীমানার বাইরের লোকদেরও নিপীড়ন করতে তারা একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন করছে।

উত্তর কোরিয়া গুপ্তহত্যায় উচ্চাভিলাষী হলেও ততটা চতুর নয়। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং–হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ব্লু হাউসে’ ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৭ সালে কিম জং ইলের ভাতিজা ই হান–ইয়ংকে হত্যার পেছনেও পিয়ংইয়ংকে দায়ী করা হয়। 

২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মারাত্মক স্নায়ুগ্যাসে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, পিয়ংইয়ং এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। 

৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার নতুন যুগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীতে সিআইএ এখন আর গুপ্তহত্যার অভিযানকে অগ্রাধিকার দেয় না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখন গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি আর নেই বলেই মনে হচ্ছে। 

এখন স্নায়ুযুদ্ধ না থাকলেও অনেক কিছুই বদলেছে। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং ৯/১১ হামলা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা করেছে। 

নাইন–ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শক্তি’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে একটি তালিকা অনুমোদন করে। এরপর ২০১১ সালের অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২০ সালে ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।

গুপ্তহত্যা এখন চলছে আকাশপথে, ফলে খুনিদের ঝুঁকি কমেছে। আইনে এখনো এসব হত্যাকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন ড্রোন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল হেল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে এসব নথি দেন। নথিতে দেখা যায়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে কমপক্ষে নয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করেছে। 

সামরিক অভিযানের আওতায় একই ধরনের ড্রোন কর্মসূচি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, এসব আক্রমণ হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সামরিক শক্তির বৈধ ব্যবহার, যা ২০০১ সালের কংগ্রেসে অনুমোদিত। 

সবাইকে ছাড়িয়ে ইসরায়েল
তবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নেতা এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মাটিতে এসব করে না। তবে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ গেমসের সময় ইসরায়েলি অলিম্পিক দলের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। 

এরপরে একটি ইসরায়েলি গোষ্ঠী মিউনিখ হামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই ডজন ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। ইউরোপের মাটিতে খুন না করার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইসরায়েল ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশে এসব হত্যাকাণ্ড চালায়। 

ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গোয়েন্দা ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’—এর লেখক রনেন বার্গম্যানকে বলেন, এসব খুনের ঘটনাগুলো ধোঁয়াশাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুপ্তহত্যা চালানো আসলেই ভয় উদ্রেককারী। ইসরায়েল এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, এটি সত্য যে, একজন ইসরায়েলিই সেই বন্দুকের ট্রিগার চেপেছে।

ইসরায়েলের নতুন গুপ্তহত্যা অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের নেতারা। ২০০৪ সালে দেশটি হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যার জন্য একটি হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠায় ইসরায়েল। এই অভিযানে নয়জন পথচারী নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়। 

অতি সম্প্রতি, দখলদার দেশটি ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নির্মূল করার জন্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনাকে প্রসারিত করেছে, এমনকি যারা তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না তাঁদেরও হত্যা করেছে। 

তবে ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’ বইটিতে বার্গম্যান ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং প্রোগ্রাম এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে একটি ফারাক দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখন যেসব কমান্ড–অ্যান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম, যুদ্ধকক্ষ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন আমেরিকা এবং মিত্রদের সেবা দেয়; সবই ইসরায়েলে বিকশিত হয়েছে।’ 

বার্গম্যান অনুমান করেন, ২০০০–এর আগের দশকগুলোতে ইসরায়েল প্রায় ৫০০টি গুপ্তহত্যা করেছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় নিয়ে বার্গম্যান লিখেছেন, এই সময় সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৮০০টি অপারেশন হয়েছিল। সেই হাজার হাজার গুপ্তহত্যার অভিযানে টার্গেট ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে। 

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ইসরায়েল আবারও এসব গুপ্তহত্যা কর্মসূচি বাড়াতে চায়। গাজার বাইরে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে—সম্ভবত কাতার বা অন্য কোথাও। 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছি। এটিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আংশিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করা যায় না।’ 

গত ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুত শহরতলিতে একটি হামাসের অফিসে ড্রোন হামলায় গোষ্ঠীটির সিনিয়র নেতা সালেহ আল–আরৌরি নিহত হন। ওই হামলায় হামাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। 

গুপ্তহত্যার বিশ্বমঞ্চে পুতিন
বিশ্ব রাজনীতিতে আরেক যুগের সূচনা হয় ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে মস্কো বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সোভিয়েত রীতি বজায় রেখেছে। তবে মস্কো যেসব অঞ্চলকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে মনে করে, এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদেরও টার্গেট করছে। 

ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের কৌশলগুলো ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে দলত্যাগী আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো এবং সাবেক ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। 

কিন্তু রাশিয়া এটাও প্রমাণ করেছে যে, খুনের কালিমা থেকে রেহাই পাওয়া কতটা সহজ! স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টার ঘটনায় বেশ কিছু নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও ২০১৭ সালে বাজফিড নিউজের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে বিশ্বাস করেছিল, রাশিয়া অগণিত গুপ্তহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যেসবের জন্য মস্কোকে সরাসরি অভিযুক্ত ও তিরস্কার করা হয়নি।

উন্নত গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার তেমন নেই। সন্দেহ রয়েছে, এই দেশগুলো পশ্চিমা তদন্তকারীদের এড়াতে কৌশল এবং তথ্য বিনিময় করছে। 

গুপ্তহত্যায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান
এমনকি যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি রক্ষা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ব্লগার জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে রিয়াদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

সিআইএ ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ১৫ জনের হিট স্কোয়াডকে দায়ী করেছে। এরপরেও এখনো ট্রাম্প নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘হয়তো তিনি করেছেন, হয়তো করেননি।’ 

বিচারবহির্ভূত বা নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ র‍্যাপোর্টার ক্যালামার্ড সৌদি আরবকে জবাবদিহি করতে বিশ্বের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর ও রিপোর্টের চার বছর পর ক্যালামার্ড বলেন, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এবং তবে বিচারের পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধই রয়েছে।

পাকিস্তানও এই কাণ্ডে সমানভাবে দায়ী হতে পারে। দরিদ্র পাকিস্তানি প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী কারিমা বালুচকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টরন্টোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কানাডার পুলিশ বলেছে, পাকিস্তানের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাঁর পরিবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনজীবীরা কয়েক মাস আগে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি সাজিদ হোসেনের মৃত্যুর সঙ্গে আগের ঘটনার মিল আছে বলে দাবি করেছেন। 

গুপ্তহত্যা ক্লাবের নতুন মুখ ভারত
বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার হর্তাকর্তারা বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিতে গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকারী দেশগুলোর ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে। সেই ক্লাবে ভারতকে নতুন সদস্য বলে মনে হচ্ছে। কানাডায় নিজ্জার হত্যা এবং নিউইয়র্কে পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ইন্টারসেপ্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারত অন্তত দুই পাকিস্তানি বাসিন্দাকে টার্গেট করেছে। একটি পৃথক ভারতীয় মেমো বলছে, কথিত রয়েছে, পশ্চিমে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এই ‘অত্যাধুনিক ক্র্যাকডাউন স্কিম’ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। 

এদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে দেশটির সমালোচকদের ওপর নজরদারি ও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়িয়েছে। 

সমাধান মিলবে কি?
ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা এমন একটি আন্তর্জাতিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি; যেখানে কোনো দেশ বা সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই সরকারগুলো তার প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।’ 

ক্যালামার্ড নিজের প্রতিবেদনে জাতিসংঘকে ‘টার্গেটেড কিলিংয়ের’ সমীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল করার আহ্বান জানিয়েছেন, যারা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের খুঁটিনাটি তদন্ত করবে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা এখনো এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত নই এবং কারা এসব করে তার সম্পূর্ণ সন্দেহভাজন তালিকাও আমাদের কাছে নেই।’ 

ক্যালামার্ড মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কমিটি থাকা উচিত, যারা এসব মামলার তদন্ত করবে। এটি গঠিত হলে খুব শক্তিশালী বার্তা যাবে যে, এসব আর সহ্য করা হবে না।’

ক্যালামার্ড ফরেন পলিসিকে আরও বলেন, ‘আমি তখন যে পয়েন্টটি তৈরি করছিলাম এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছি তা হলো—নির্দিষ্ট ঘটনা তদন্তের জন্য আমাদের ক্ষমতার প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খ করা। যা এসব ঘটনা রোধ করবে এবং আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।’ 

তবে এসব সুপারিশ এখনো উপেক্ষিত। আশ্চর্যের কিছু নেই, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্তত দুটি রাষ্ট্র তাঁদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত গুপ্তহত্যা করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখনো দায়সারাভাবেই গুপ্তহত্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। অনেক সময় ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হলেও মূল হোতা দেশ বা সংস্থা দায় এড়ায়। 

ক্যালামার্ড বলেন, দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক স্তরে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইন পরিচালনার কোনো উপায় নয়। বিশ্ব গুপ্তহত্যা ঠেকানো থেকে আরও দূরে চলে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে সীমাহীন যুদ্ধের এক স্বাভাবিকতা এনে দিয়েছে। 

হিট স্কোয়াড, বিষযুক্ত টুথপেস্ট বা সশস্ত্র ড্রোন যাই হোক না কেন, বিদেশের মাটিতে হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তা নীতি, ভূ–রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক এবং উদ্বাস্তুরা এই বাস্তবতার শিকার সবচেয়ে বেশি—সম্ভবত জঙ্গি ও রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও। 

ক্যালামার্ড যুক্তি দেন, এই ধরনের হত্যা বিশ্বকে নিরাপদ করা তো দূরের কথা, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা তৈরি ছাড়া আর কিছুই করে না। আর এমন পরিস্থিতি তৈরিতে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো। 

ক্যালামার্ড বলেন, ‘গত ২০ বছরে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা যে “ন্যায্যতা” এনেছে তা সত্যিই নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়, দৃঢ় কণ্ঠে এসব ঘটনার নিন্দা করার ক্ষমতাকেও ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।’

ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি

জামায়াতে যোগ দিলেন বিএনপি থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত আখতারুজ্জামান

ব্রিটেনে নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে কোটি মুসলিম, বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের

মা-বাবাকে নির্যাতন, ছেলেকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখল প্রতিবেশীরা

আজকের রাশিফল: চায়ের বিল না দেওয়া বন্ধুদের সাহায্য করুন, সন্ধ্যার দিকে ভালো খবর

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত বুধবার মার্কিন বাহিনী ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছাকাছি অভিযান চালিয়ে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করেছে। ট্যাংকারে ভেনেজুয়েলা ও ইরানের তেল বহন করা হচ্ছিল বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এই ঘটনার পর ভেনেজুয়েলার তেল বহনের অভিযোগের আরও ছয়টি জাহাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, প্রথম ট্যাংকারটির অবস্থান (লোকেশন) গোপন করার বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি নিশ্চিত করেছেন, জব্দ হওয়া জাহাজটির নাম ‘স্কিপার’। তাঁর দাবি, এটি ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞা ভুক্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহনে ব্যবহৃত ক্রুড অয়েল ট্যাংকার।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর। জব্দ হওয়ার আগে এটি গত ৭ নভেম্বর থেকে তার অবস্থান প্রকাশ করেনি।

মেরিন অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপ্লার (Kpler) জানিয়েছে, ‘স্কিপার’-এর অবস্থান গোপন করার (স্পুফিং) দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জানা যায়, ২০২২ সালে যখন জাহাজটি ‘আদিশা’ (Adisa) নামে চলছিল, তখন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এটিকে একটি ‘আন্তর্জাতিক তেল পাচার নেটওয়ার্কের’ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘স্কিপার’ ঘন ঘন ট্র্যাকারকে মিথ্যা তথ্য দিত। যেমন, এআইএস সিস্টেমে জাহাজটি ৭ ও ৮ জুলাই ইরাকের বসরা অয়েল টার্মিনালে অবস্থান দেখালেও, টার্মিনাল রিপোর্টে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। উল্টো কেপ্লার জানিয়েছে, সেই সময়েই ট্যাংকারটি ইরানের খার্গ দ্বীপ থেকে অপরিশোধিত তেল বোঝাই করছিল। এ ছাড়া, ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজটি এআইএস-এ সম্পূর্ণ ভুল সংকেত পাঠাচ্ছিল, যা এর আসল অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘স্কিপার’ সম্ভবত ‘ডার্ক ফ্লিট’ নামক বিশ্বব্যাপী তেলবাহী ট্যাংকারের একটি নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কটি মালিকানা, পরিচয় এবং ভ্রমণ ইতিহাস গোপন করে তেলের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কাজ করে।

যদিও ‘স্কিপার’ গায়ানার পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করছিল, কিন্তু গায়ানা সরকার দ্রুত বিবৃতি দিয়ে জানায় যে ২০ বছর বয়সী এই ট্যাংকারটি তাদের দেশে নিবন্ধিত নয় এবং এটি ‘অবৈধভাবে গায়ানার পতাকা ব্যবহার করছিল’। জাহাজটির নিবন্ধিত মালিক হিসেবে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ-ভিত্তিক ‘ট্রাইটন নেভিগেশন করপোরেশন’-এর নাম রয়েছে। তবে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, এই ট্রাইটন করপোরেশনকে একজন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রুশ জ্বালানি ধনকুবের ভিক্তর আর্তেমভ তাঁর বৈশ্বিক ‘তেল পাচার নেটওয়ার্ক’ পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতেন।

ভেনেজুয়েলার তেল মজুত বিশ্বের বৃহত্তম হলেও, মাদুরোর প্রশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকে দেশটির তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ‘স্কিপার’ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। কেপ্লার বিশ্লেষকেরা জানান, ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দর থেকে প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন (১১ লাখ) ব্যারেল মেরে ক্রুড তেল বোঝাই করেছিল এবং গন্তব্য হিসেবে কিউবার নাম উল্লেখ করেছিল।

১১ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এটি পূর্বে যাত্রা করে একটি ‘শিপ-টু-শিপ ট্রান্সফার’ সম্পন্ন করে। এটির কার্গো পরে চীনেও ‘ভুয়া ঘোষিত’ হয়েছিল। মার্কিন অভিযানের মাত্র কয়েক দিন আগে, ৭ ডিসেম্বরে এটি ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে স্থানান্তরে জড়িত ছিল বলে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়। বেলজিয়ামের নৌবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট ফ্রেডেরিক ভ্যান লোকারেন জানান, এই ধরনের স্থানান্তর আইনত অবৈধ না হলেও, তা ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ এবং সাধারণত নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্যই করা হয়।

‘স্কিপার’ সর্বশেষ ৭ নভেম্বর তার অবস্থান ঘোষণা করে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায়। মার্কিন অভিযানে ১০ ডিসেম্বর এর অবস্থান পুনরায় দৃশ্যমান হয়। এই অন্তর্বর্তী সময়ে, ১৮ নভেম্বর স্যাটেলাইট চিত্রগুলো নিশ্চিত করছে যে ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দরে ছিল।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি

জামায়াতে যোগ দিলেন বিএনপি থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত আখতারুজ্জামান

ব্রিটেনে নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে কোটি মুসলিম, বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের

মা-বাবাকে নির্যাতন, ছেলেকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখল প্রতিবেশীরা

আজকের রাশিফল: চায়ের বিল না দেওয়া বন্ধুদের সাহায্য করুন, সন্ধ্যার দিকে ভালো খবর

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
তামিল নাড়ুর কারুর শহরে একটি ডেটা অ্যানোটেশন সেন্টারে কাজ করছেন কর্মীরা। ছবি: নিক্কেই এশিয়া
তামিল নাড়ুর কারুর শহরে একটি ডেটা অ্যানোটেশন সেন্টারে কাজ করছেন কর্মীরা। ছবি: নিক্কেই এশিয়া

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যখন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি সংকট সৃষ্টি করছে, ঠিক তখনই ভারতের ছোট ছোট শহরে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। এই বিষয়ে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ ভারতের কারুর শহরের একটি অফিসে বসে ধারাণি চন্দ্রশেখর যখন কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবি শনাক্ত করছেন, তখন একই অফিসে বসে সৌম্যা বসরমালিংগম বিভিন্ন ভিডিওর ঘরানা, চরিত্রের মুড ও টোন বিশ্লেষণ করছেন। আসলে তাঁরা দুজনই এমন এক শিল্পের কর্মী, যে শিল্প বিশ্বজুড়ে এআই মডেল প্রশিক্ষণের জন্য বিপুল পরিমাণ তথ্য ছাঁকছে ও বিশ্লেষণ করছে।

এই কাজকে প্রযুক্তি জগতে বলা হয় ডেটা অ্যানোটেশন—যেখানে মানুষ ছবি, ভিডিও ও টেক্সট ডেটাকে ট্যাগ করে এআইয়ের শেখার উপযোগী করে তোলে। ভারত এখন এই শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। ২০২০ সালে যেখানে মাত্র ৭০ হাজার মানুষ এই খাতে কাজ করত, ২০৩০ সালের মধ্যে তা পৌঁছাতে পারে ১০ লাখে। একই সময়ে এই বাজারের মূল্য বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হতে পরে বলে জানিয়েছে ভারতের সফটওয়্যার শিল্প সংস্থা নাস্কম।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই ৭১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ হাজারের বেশি চাকরি হারানোর কারণ হিসেবে সরাসরি এআইকে দায়ী করা হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকায় এআই–সম্পর্কিত ছাঁটাইয়ের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি—মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন, মেটা—সবাই কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে এআইকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

কিন্তু একই এআই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাগুলোর আউটসোর্সিং বাড়িয়ে দিচ্ছে এশিয়ায়। এর ফলে পাকিস্তান, ভারত ও ফিলিপাইনে আউটসোর্সিং কর্মীসংখ্যা গত পাঁচ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন—দক্ষিণ এশিয়ার কম খরচের দক্ষ জনবলকে এআই সহজে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। স্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ নিল মাহোনি বলেন, ‘যে কাজ খুব সহজ এবং ব্যয়বহুল—সেই কাজই প্রথমে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। এশিয়ার শ্রমবাজার এখনো খুব সস্তা।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে এআই–চালিত ‘হিউম্যান ইন দ্য লুপ’ মডেল আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে—যেখানে মানুষ এআইয়ের ভুল সংশোধন করবে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের নেক্সটওয়েলথ কোম্পানির কাজ উল্লেখযোগ্য। তারা এমন দোকানে নজরদারি করে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ক্যাশিয়ার ছাড়াই কেনাকাটা করা যায়। কোনো ভুল হলে কয়েক সেকেন্ডেই মানুষ যাচাই করে তা সংশোধন করে।

এই সব কাজ ভারতের ছোট শহরের যুবকদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। কারুর শহরের সেই কর্মী ধারাণি চন্দ্রশেখর জানান, পারিবারিক কারণে তিনি কখনো বড় শহরে চাকরি খোঁজেননি, কিন্তু এখন তিনি প্রযুক্তি খাতে কাজ করতে পারছেন নিজের শহরেই। অন্যদিকে তাঁর সহকর্মী ধনাসীলন পলানিয়াপ্পান এই শিল্পে কাজ করে জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশযাত্রার সুযোগ পেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি চীনের কিংদাও শহরে গিয়েছিলেন ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে।

এআই যতই উন্নত হোক, শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেটা অ্যানোটেশনের প্রয়োজন কখনোই শেষ হবে না। কারণ বাস্তব জগতে কাজ করতে গেলে এআইকে সব সময় মানুষের সুপারভিশনের প্রয়োজন হবে। এমনকি মেটার মতো কোম্পানি যখন স্কেল এআই–এ ১৪.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তখন তা প্রমাণ করে এই ক্ষেত্রের গুরুত্ব কমছে না।

তবুও অনেক কর্মীর মনের ভেতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এআই কি একদিন আমাদের চাকরি খেয়ে ফেলবে? কারুরের তরুণ নবিন বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তির যুগের সবচেয়ে বড় ঢেউয়ের সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু মনে মনে একটা ভয় তো থেকেই যায়—এআই যেন আমাদের জায়গা দখল না করে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি

জামায়াতে যোগ দিলেন বিএনপি থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত আখতারুজ্জামান

ব্রিটেনে নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে কোটি মুসলিম, বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের

মা-বাবাকে নির্যাতন, ছেলেকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখল প্রতিবেশীরা

আজকের রাশিফল: চায়ের বিল না দেওয়া বন্ধুদের সাহায্য করুন, সন্ধ্যার দিকে ভালো খবর

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ২৭
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ওয়াশিংটনে যখনই কোনো নতুন প্রশাসন আসে, সঙ্গে করে তারা নিজস্ব মতাদর্শগত অবস্থানও নিয়ে আসে। আর সঙ্গে অনিবার্যভাবে তারা এমন এক দলিল প্রকাশ করে, যেখানে তাদের জাতীয় নিরাপত্তানীতির ধারণাগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএস) সর্বশেষ সংস্করণটিও সেই চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। তবে এর তাৎপর্য আরও গভীরে—আগের কৌশলগত দলিলগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী যুগের বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতির ঐকমত্যের সামান্য হেরফেরকে প্রতিফলিত করে থাকলেও এই দলিল সেই ঐকমত্য থেকে এক নাটকীয় বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে।

এই দলিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য নির্দেশক হবে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটি যে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিবর্তনে এক অনিবার্য মাইলফলক, তাতে সন্দেহ নেই। এই দলিলে মাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে এবং আমেরিকার পরিবর্তিত মানসিকতাও তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।

এশিয়ার জন্য এই দলিল এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে, যেখান থেকে বোঝা যায়—দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে দেখছে, কীভাবে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচার করছে ও চীনকে মূল্যায়ন করছে এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এই যুগে আমেরিকার নেতৃত্বকে কীভাবে কল্পনা করছে।

একদিকে এনএসএসে মাগা জাতীয়তাবাদের সেই পরিচিত ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে—যা সংযম, জাতীয়তাবাদ ও সর্বজনীন লক্ষ্যযুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করার এক মিশ্রণ। দলিলটি এমন একটি কৌশলের ডাক দিয়েছে, যা ঐতিহ্যগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়। তার বদলে এটি সবার ওপরে আমেরিকার জন্য যা কাজ করে বা সহজ কথায়, আমেরিকা ফার্স্ট—তা দিয়েই অনুপ্রাণিত।

নতুন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যের বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে আঞ্চলিক স্বার্থের পুনর্নবীকরণের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থের এক সংকীর্ণ সংজ্ঞার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। যেসব দেশ বহুদিন ধরে ওয়াশিংটনের উপদেশ দেওয়ার ধরনে ক্ষুব্ধ ছিল, তাদের জন্য এই পরিবর্তন একটি ‘স্বাগত জানানো’ আদর্শিক পুনর্বিন্যাস।

নতুন মার্কিন এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য একই সঙ্গে সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ—দুটোই নিয়ে এসেছে। প্রথম ইতিবাচক দিকটি হলো—এই দলিলে এশিয়া বা আধুনিক কৌশলগত ভাষায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল পশ্চিমা গোলার্ধের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একেবারে শীর্ষে স্থান পেয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধ ট্রাম্পের কৌশলের মূল কেন্দ্রে রয়েছে। এশিয়ার ওপর এই মনোযোগ ওবামা প্রশাসনের ‘এশিয়া পিভট’, ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ এবং বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে। চীনের উত্থান ও এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে এই মনোযোগ অনিবার্য ছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো একক শক্তি যদি এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তার বিরোধিতা করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলের দীর্ঘকালীন মূল প্রতিপাদ্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এ বিষয়ের পুনরাবৃত্তি চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন এশিয়ার রাজধানীগুলোতে স্বাগত জানানো হবে।

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই কৌশল এশিয়াকে সেই চরম কঠোর সমালোচনা থেকে রেহাই দিয়েছে, যা তিনি ইউরোপের ওপর বর্ষণ করেছেন। এই নথিতে ইউরোপকে অবক্ষয়, নির্ভরশীলতা ও উদারনৈতিক বাড়াবাড়ির জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু এশিয়াকে স্পষ্ট কৌশলগত সম্মান দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে। ইউরোপকে ‘পশ্চিমা সভ্যতাকে রক্ষা’ করার জন্য সামরিক সক্রিয়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিপরীতে ইন্দো-প্যাসিফিক ও মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ও বাছাই করা হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। এর কারণ এই নয় যে, ট্রাম্প ইউরোপের চেয়ে এশিয়াকে বেশি পছন্দ করেন। বরং, মাগার আদর্শিক যুদ্ধ মূলত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও উদারনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার অভ্যন্তরের একটি গৃহযুদ্ধ। এশিয়া আপাতত এই বিবাদের বাইরে রয়েছে।

তৃতীয়ত, এশিয়া আন্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপর আমেরিকান সমালোচনার শিকার কম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমলাতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা মাগার ক্রোধের জন্ম দেয়; কিন্তু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাটতি থাকা এশিয়া এখন ট্রাম্পীয় বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও লেনদেনভিত্তিক সহযোগিতার ওপর কেন্দ্রীভূত। মানবাধিকার ও সামাজিক মানদণ্ডের ওপর উদার ও আন্তর্জাতিকতাবাদী জোর সব সময়ই অধিকাংশ এশীয় সরকারের কাছে নেতিবাচকভাবে গৃহীত হয়েছে। কেবল চীনই নয়, এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক অথচ গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী সমাজগুলোতেও একইভাবে মূল্যায়িত হয়েছে এই মার্কিন অবস্থান। তাদের কাছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর জোর এবং বিশ্বকে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর এক সম্প্রদায় হিসেবে দেখার ধারণাটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত।

চতুর্থত, বেইজিংসহ কিছু এশীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার বাগাড়ম্বরকে অবিশ্বাস করেছে। এই কথা পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে সান্ত্বনাদায়ক শোনালেও এশিয়ার কিছু অংশে এটি জবরদস্তিমূলক বা ভন্ডামি বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে, ওয়াশিংটন সব সময় তাদের উচ্চারিত নিয়মগুলো মেনে চলত না। ট্রাম্পের বাস্তববাদ ও স্বার্থের ওপর জোর এবং কূটনীতিকে বাণিজ্যনীতি হিসেবে দেখা ব্যাপকভাবে বিশ্বজুড়েই অনুরণিত হচ্ছে। আদর্শের ওপর উদারনৈতিক বাগাড়ম্বরে সন্দিহান এশীয় সরকারগুলো লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতায় স্বচ্ছন্দ। এই গত শরৎকালেও ট্রাম্পের এশিয়া ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করার জন্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। লেনদেনভিত্তিক একটি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝা, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং দর-কষাকষি করা তুলনামূলকভাবে সহজ।

পঞ্চমত, চীনকে প্রায় সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি ‘পারস্পরিক সুবিধাজনক অর্থনৈতিক সম্পর্কের’ আহ্বানকে স্বাগত জানাচ্ছে অনেক এশীয় রাষ্ট্র। ১৯৮০-এর দশক থেকে সিনো–মার্কিন ‘ঐক্য’ থেকে এশিয়ার একটি বৃহৎ অংশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে এবং তারা একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে অস্বস্তিতে আছে। ওয়াশিংটন বা বেইজিংয়ের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে না চাওয়ার যে ব্যাপক অনুভূতি, তা চীনকে প্রায় সমকক্ষ হিসেবে পুনরায় যুক্ত করার ট্রাম্পের আপাত ইচ্ছার মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়। ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বেশি দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের আহ্বান তাদের নিজস্ব কৌশলগত পরিচিতি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।

তবে এই সুসংবাদের আড়ালে কিছু উদ্বেগজনক দিকও রয়েছে, আছে ঝুঁকিও। প্রথমত, যদিও ট্রাম্পের সার্বভৌমত্ব ও হস্তক্ষেপ না করার ওপর জোর দেওয়াকে স্বাগত জানানো হচ্ছে, তবু এশিয়া খুব ভালোভাবেই ওয়াশিংটনের অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর কাঠামোগত প্রলোভন সম্পর্কে সচেতন। এটি নীতি থেকে নয়, বরং ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত। বৃহৎ শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করে, কারণ, তারা তা করতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই এটির দাবি করে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকি আমেরিকানদের শাস্তি দেওয়া ও জবরদস্তি করার স্থায়ী প্রবৃত্তিকেই তুলে ধরে। সংযমের ঘোষণা সেই প্রবৃত্তিকে দূর করবে না।

দ্বিতীয়ত, যদিও ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি এশিয়ায় অনুরণিত হয়, কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প সাধারণ লেনদেনভিত্তিক বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে তাঁর বিশাল নতুন বিনিয়োগের দাবিগুলো এমন শর্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, যা কেবল চাঁদাবাজির মতো বলেই মনে করা যেতে পারে। একই রকম উদ্বেগজনক ছিল সাম্প্রতিক আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে চাপানো শর্তাবলি। এই ব্যবস্থাগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানানোর সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক আছে। বরং এগুলো ক্ষমতাগত অসামঞ্জস্যতা ও চাপকেই প্রতিফলিত করে। এশীয় রাষ্ট্রগুলো লেনদেনভিত্তিক নীতিকে স্বাগত জানাতে পারে, কিন্তু তারা জবরদস্তিমূলক ‘বাণিজ্যবাদে’ ক্ষুব্ধ।

তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনের নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা বর্জন এশীয় দেশগুলোর বাস্তববাদীদের খুশি করতে পারে। তবে এই বিসর্জনেরও মূল্য আছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকার করে, তবে এশিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর করুণার পাত্র হয়ে উঠবে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়ার বিষয়টি চীনা সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিষয়ে অবিলম্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ছোট এশীয় রাষ্ট্রগুলো বিস্তৃত, অনুমানযোগ্য নিয়ম চায়—তারা উদার আদর্শবাদী বলে নয়, বরং নিয়মগুলো দুর্বলকে শক্তিশালী থেকে রক্ষা করে বলে এটা চায়। এর পাশাপাশি, উদার মূল্যবোধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজ আন্দোলনগুলোকে হতাশ করবে, যারা দমন-পীড়নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকত।

চতুর্থত, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার ওপর ট্রাম্পের জোর বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির মধ্যে সম্ভাব্য আপস নিয়ে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করে, কিন্তু অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা ও সামরিক প্রতিযোগিতার মধ্যকার টানাপোড়েন বাস্তব এবং ক্রমবর্ধমান। চীনের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

ওয়াশিংটন ও তার আঞ্চলিক অংশীদারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চীনা সক্ষমতা বাড়বে। মিত্রদের কাছে ট্রাম্পের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দাবি কিছু দেশকে চরম সমাধানের দিকে ঠেলে দিতে পারে—যার মধ্যে পারমাণবিক বিকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করাও অন্তর্ভুক্ত। চীন যে ক্রমশ তাঁর পক্ষে সামরিক ভারসাম্যকে স্থানান্তরিত করছে, এই উপলব্ধিতে এই অঞ্চলের উদ্বেগ আরও তীব্র হচ্ছে।

পঞ্চমত, তাইওয়ান নিয়ে এনএসএসের ভাষার তীব্র আলোচনা এশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূরাজনৈতিক ফাটলকে তুলে ধরে। তবু কেবল আভিধানিক বিতর্ক থেকে বোঝা যায় না যে, কোনো প্রকৃত সংকটে ট্রাম্প বা অন্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কীভাবে আচরণ করবেন। এ সময়ে আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও আমেরিকান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে। চীনা আক্রমণকে জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানাই তাকাইচির মন্তব্যের পর ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে যে পাল্টা চাপ দেওয়া হয়েছিল, তা একটি সতর্কসংকেত। এমনকি ট্রাম্প যখন এশীয় মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র এর বিনিময়ে কী সরবরাহ করবে, সে বিষয়ে তিনি কম স্পষ্টতা দিচ্ছেন। তাই এই কৌশলগত অস্পষ্টতা এখন প্রতিশ্রুতির বদলে অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে।

সব মিলিয়ে এশিয়া—ইউরোপের মতো নয়—যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি সময় ও সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেশি গুরুতর। রাশিয়ার বিপরীতে—যার শক্তিমত্তা ইউরোপের তুলনায় সীমিত—সেখানে চীন এশিয়ার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ওয়াশিংটন কীভাবে বেইজিংয়ের সঙ্গে তার জটিল সম্পর্ককে পরিচালিত করবে—যে সম্পর্ক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা দ্বারা চিহ্নিত। চীনের প্রতি মার্কিন নীতির দ্বিধাদ্বন্দ্ব ইন্দো-প্যাসিফিকজুড়ে মারাত্মক পরিণতি আনতে পারে।

এশিয়াকে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা ট্রাম্পবাদের কৌশলগত বিবর্তনের গতিপথকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা এশিয়ার নেই বললেই চলে। ইউরোপীয়রা হয়তো উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং আটলান্টিকতাবাদের পুনরুদ্ধারের আশা করতে পারেন, এশিয়ার সেই বিলাসিতা নেই। চীন যখন বিশাল আকার ধারণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক অভিমুখ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করছে, তখন এশিয়াকে স্বনির্ভরতার কৌশল অবলম্বন করতে হবে—জাতীয় সক্ষমতা জোরদার করা, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অংশীদারত্ব প্রসারিত করা এবং নমনীয় জোট গঠন করা।

একই সময়ে, এই কৌশলপত্র ওয়াশিংটন–সমর্থিত একটি ‘দায়িত্ব বণ্টন নেটওয়ার্ক’-এর প্রস্তাব করেছে। যেসব দেশ তাদের নিজেদের আশপাশে নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছায় আরও বেশি দায়িত্ব নেবে—তাদের বাণিজ্যিক বিষয়ে আরও অনুকূল আচরণ, প্রযুক্তি ভাগাভাগি ও প্রতিরক্ষা সংগ্রহের মাধ্যমে—যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকবে।’ এশিয়ার এই প্রস্তাবের সুযোগগুলো কাজে লাগানো উচিত।

ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি

জামায়াতে যোগ দিলেন বিএনপি থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত আখতারুজ্জামান

ব্রিটেনে নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে কোটি মুসলিম, বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের

মা-বাবাকে নির্যাতন, ছেলেকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখল প্রতিবেশীরা

আজকের রাশিফল: চায়ের বিল না দেওয়া বন্ধুদের সাহায্য করুন, সন্ধ্যার দিকে ভালো খবর

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। ছবি: নিক্কেই এশিয়া
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। ছবি: নিক্কেই এশিয়া

চীন ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উত্তেজনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে চীনের একটি পুরোনো শব্দ, ‘ফেংশি’। বহু চীনা নাগরিকের কাছেও অপরিচিত এই শব্দটির অর্থ হলো—সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোনো বার্তা বা আদেশ পৌঁছে দেওয়া। এবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই শব্দটির ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল শীর্ষ নির্দেশেই—অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আদেশে।

তাকাইচির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সি চিনপিং সরাসরি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার ফোনালাপে সি অর্ধেক সময় ব্যয় করেন তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থান বুঝিয়ে বলতে। ট্রাম্প পরে মন্তব্য করেন—সির উপস্থিতিতে পাশে থাকা কর্মকর্তারা ভয়ে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বিশ্লেষকদের মতে, সির এই ক্ষোভের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ডাইতো বুনকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকাশি সুজুকির বক্তব্য অনুযায়ী, সি চিনপিং বিশ্বাস করেন তাইওয়ান ইস্যুর মূল উৎস ১৮৯৪-৯৫ সালের প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে অনেক শক্তিশালী কুইং সাম্রাজ্য সহজেই পরাজিত হয় উদীয়মান জাপানের কাছে এবং সেই পরাজয়ের পরই তাইওয়ান চলে যায় জাপানের অধীনে।

২০১৮ সালে সির লিউগং দ্বীপ সফরও এই ঐতিহাসিক ক্ষতের স্মরণ। এ দ্বীপেই অবস্থান করত বেইয়াং নৌবহর, যেটিকে একসময় এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ১৮৯৫ সালে জাপানের হামলায় তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। সির সফর ছিল ওই পরাজয় মনে রাখার বার্তা, যেন আবারও চীন দুর্বলতা প্রদর্শন করে একই পরিণতির শিকার না হয়।

বর্তমানে পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীর বিমানের দিকে চীনা যুদ্ধবিমান রাডার লক্ষ্য করে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। চীন অভিযোগ করছে, তাকাইচির মন্তব্য দিয়ে জাপান তাইওয়ান প্রশ্নে সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে জাপানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—এমন ব্যাখ্যা অতিরঞ্জিত; তাদের না ইচ্ছা আছে, না সক্ষমতা।

বিশ্লেষকদের মতে, এই অচলাবস্থা কাটাতে সবচেয়ে জরুরি হলো সংলাপের সুযোগ তৈরি করা। অবিশ্বাস দূর করে আলোচনার টেবিলে ফিরে এলে তবেই উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সি চিনপিংয়ের রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি অচলাবস্থাতেই থাকতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি

জামায়াতে যোগ দিলেন বিএনপি থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত আখতারুজ্জামান

ব্রিটেনে নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে কোটি মুসলিম, বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের

মা-বাবাকে নির্যাতন, ছেলেকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখল প্রতিবেশীরা

আজকের রাশিফল: চায়ের বিল না দেওয়া বন্ধুদের সাহায্য করুন, সন্ধ্যার দিকে ভালো খবর

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত