প্রভাব হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, পাপেট থেকে প্লেয়ারের ভূমিকায় সৌদি-ইউএই

ইয়াসিন আরাফাত 
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২২, ২১: ২৭

ইউক্রেনে রুশ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার উপসাগরীয় মিত্রগুলোর মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। বিশেষ করে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএনই) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ এখন তুঙ্গে। অথচ একটা সময় এমন পরিস্থিতি ছিল অকল্পনীয়।

ধনী উপসাগরীয় দেশগুলো কয়েক দশক ধরে ওয়াশিংটনের পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে থেকেছে। তবে ইউক্রেন সংকট সেসব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিচ্ছে। মস্কোর লাগাম টেনে ধরার ব্যাপারে তারা জো বাইডেন প্রশাসনকে সমর্থন করছে না। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ইরানের দিক থেকে আসা হুমকির বিপরীতে উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য দীর্ঘ সময় রক্ষকের ভূমিকায় ছিল, উপসাগরীয় অঞ্চল এখন সেই ‘কৃতজ্ঞতার’ সৌজন্যটুকুও আর দেখানোর প্রয়োজন মনে করছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডই এই বিরোধের মূলে। 

ফরাসি থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট মন্টেইনের উপসাগরীয় অঞ্চল বিশেষজ্ঞ অ্যান গদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, সব কিছু বদলে না গেলেও এই মুহূর্তটি উপসাগরীয়-মার্কিন সম্পর্কে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন দেখে একটি ভিন্ন মধ্যপ্রাচ্য তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে উপসাগরীয় দেশগুলো। 
 
১৯৪৫ সালে মার্কিন-সৌদি সুসম্পর্কের শুরু হয়বর্তমানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। গত মাসে ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্রান্ত একটি মার্কিন-আলবেনীয় নিন্দাপ্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে দেশটি। 

ইউক্রেন যুদ্ধের দুই সপ্তাহ পার হয়েছে, বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম হু হু করে বাড়ছে। লাগাম টানতে তেলের উৎপাদন বাড়াতে পশ্চিমা চাপ এ পর্যন্ত উপেক্ষা করেছে উপসাগরীয় দেশগুলো। এ সময় ওপেক প্লাস জোটের প্রতি তাদের অঙ্গীকার রক্ষার ওপর জোর দিয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। যে ওপেক প্লাসের নেতৃত্বে রয়েছে রিয়াদ ও মস্কো। গত মঙ্গলবার রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তা সত্ত্বেও জোটের প্রতি আনুগত্যের কথাই জানিয়েছে এই দুই দেশ। বৃহস্পতিবারও সংযুক্ত আরব আমিরাত সে অঙ্গীকারের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছে। এর আগের দিন ওয়াশিংটনে দেশটির রাষ্ট্রদূত বলেন, তাঁর দেশ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনে ওপেককে উৎসাহিত করবে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত মঙ্গলবার মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানায়, সৌদি বাদশাহ সালমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান সম্প্রতি বাইডেনের টেলিফোনে সাড়া দেননি। 

এ নিয়ে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র এমিলি হর্ন বলেন, এই রিপোর্টে বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় না। তিনি জানান, গত মাসেই সৌদি বাদশাহ সালমান বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সেই কথোপকথনের পর আর কোনো অনুরোধ করা হয়নি। 

কিন্তু বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তাঁর সঙ্গে কোনো কথা বলেননি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। যেখানে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর খাশোগি হত্যাকাণ্ডে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রতিবেদনে সৌদি রাজপরিবারকে দায়ী করা হয়েছে। 

২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় আরব থেকে সিরিয়া ও মিশর কর্তৃত্ব সরে যায়সম্প্রতি মার্কিন ‘দ্য আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, বাইডেন আমাকে ভুল বুঝলেও কিছু করার নেই। 

 ১৯৪৫ সালে ওয়াশিংটন-রিয়াদ সুসম্পর্কের শুরু। ওই বছর একটি রণতরীতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট এবং সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজ বিন সৌদ প্রথমবারের মতো বৈঠকে মিলিত হন। 

আরব বিশ্বের ছয়টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে। এত দিন এই দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুলের মতো ব্যবহৃত হয়েছে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় আরব থেকে সিরিয়া ও মিসরের কর্তৃত্ব সরে যাওয়ার পর সেখানে উপসাগরীয় দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আবির্ভুত হয়। এই পরিবর্তনের মধ্যে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত দুটি বৃহত্তম আরব অর্থনীতির দেশ স্পষ্ট করেছে যে, তারা জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি চায়। উপসাগরীয় মিত্ররা এখন ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করছে। এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইরানের শত্রু দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে।

এ নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল খালেক আব্দুল্লাহ মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে চলতি মাসে বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আর যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল গণ্য করা উচিত হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এতোই ভালো যে, আমরা ওয়াশিংটন থেকে কোনো নির্দেশ নিই না। আমাদের নিজস্ব কৌশল এবং অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজগুলো আমাদের করতে হবে।’

বিশ্লেষকদের মতে, পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইরানের সঙ্গে বাইডেনের ব্যস্ততা, ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে ওয়াশিংটনের অস্বীকৃতি এবং খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন তদন্ত উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটাচ্ছে। তবে এই অবনতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ২০১৯ সালে সৌদি আরামকোর স্থাপনায় হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো প্রতিক্রিয়ার ঘাটতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের সামরিক প্রতিশ্রুতি কমানোর ইচ্ছা।

২০১৯ সালে সৌদির আরামকো তেল স্থাপনায় হামলাযুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক হুসেইন ইবিশ বলেন, ‘সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় দেশগুলো নিরাপত্তার জন্য আর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে চায় না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর একটি প্রাথমিক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে রয়ে গেছে। একটি বহু মেরু বিশিষ্ট বিশ্বের উত্থান, যেখানে মূলত চীন ও রাশিয়ার আরও বেশি বৈশ্বিক প্রভাব-প্রতিপত্তি আমরা দেখবো—এটা অনিবার্য।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত