Ajker Patrika

পুতিনের মদদদাতারা এখন কোন দিকে যাবেন

মারুফ ইসলাম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭: ৫৯
পুতিনের মদদদাতারা এখন কোন দিকে যাবেন

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের এক বছর পূর্তি হয়েছে। পুতিন কি এখন আগের চেয়ে আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছেন? বিশ্লেষকেরা বলছেন, সম্ভবত। তাঁরা নিশ্চিত করে না বললেও এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পুতিনের বিপজ্জনক হয়ে ওঠার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। 

একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ২ লাখ সৈন্য হতাহত হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। এই যুদ্ধে যদি রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে বসে, তাহলে হতাহতের সংখ্যা কত হবে, তা কল্পনা করাও কঠিন। 

পরমাণু অস্ত্রের প্রসঙ্গটি এ কারণে আসছে যে ২১ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি থেকে সরে যাবেন। এর পেছনে তিনি অবশ্য ইউক্রেন ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করেছেন। 

গত মঙ্গলবার পুতিনের প্রায় ১০০ মিনিটের দীর্ঘ ভাষণ থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন অন্যকে দোষারোপ করা, নিজের স্বার্থানুযায়ী মিথ্যা বলা, শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করা ও ঘৃণা ছড়ানো। 

পুতিন যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁকে খুব দৃঢ়চেতা মনে হচ্ছিল। রুশ জনগণও তাঁকে সমর্থন করে উল্লাস করেছে। মনে রাখা দরকার, বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণু অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ যদি পুতিনের হাতে থাকে, তবে তা আখেরে হয়তো দুঃখজনক পরিণতিই ডেকে আনবে। 

যাহোক, ‘নিউ স্টার্ট’ নামের পারমাণু চুক্তিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করেছেন পুতিন। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া—উভয়ের পারমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমানোর বিষয়টির উল্লেখ ছিল। একই সঙ্গে উভয় দেশকে একে অপরের পারমাণবিক সাইটগুলো পরিদর্শনের অধিকারের বিষয়টি ছিল। 

সন্দেহ নেই, এই চুক্তি স্থগিত হওয়ার ফলে পৃথিবী একটি বিপজ্জনক পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ‘পুতিনের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত পৃথিবীর জন্য ভীষণ দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে।’ 

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরাও এ ঘটনাকে ‘ভীষণ দুঃখজনক ও বিপজ্জনক’ বলে মত দিয়েছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংকের কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের গবেষক আন্দ্রেই কোলেসনিকভ বিবিসিকে বলেছেন, ‘পুতিন ভবিষ্যতে কী করবেন, তাঁর মনে কী আছে, তা বলা মুশকিল। তাঁর ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। তবে ধারণা করা যায়, তিনি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যতটা সম্ভব ব্ল্যাকমেল করবেনই।’ 

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছে বহু আগে (১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর)। তবে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে, তা সেই পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অনেককে। ফলে স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আবার নতুন করে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়েছেন। তাঁদের উদ্বেগের কারণ, পুতিনের পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের মুহুর্মুহু হুমকি। 

‘নিউ স্টার্ট’ নামের পারমাণবিক চুক্তিটি স্থগিত করেছেন পুতিনতবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতিতে পুতিনকে ‘অতটা শক্তিশালী নয়’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। কিছুদিন আগেই (২০ ফেব্রুয়ারি) কিয়েভ সফরের পর পোল্যান্ড গিয়ে এক বক্তৃতায় পুতিনকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘বৈশ্বিক গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে। আর স্বৈরাচারীরা দুর্বল হয়েছে।’ 

অনেকেই মনে করেন, স্বৈরাচারের সঙ্গে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক রয়েছে। তবে রুশ স্বৈরাচারের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, স্বৈরাচারী আমলে রাশিয়া দ্বিধাহীনভাবে ধর্মহীন ছিল। চীনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানেও ধর্মের খুব একটা গুরুত্ব নেই। 

কিন্তু এখন বিশ্বের প্রায় সকল স্বৈরাচারী নেতার মধ্যেই এক নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাঁরা মুখে ঐতিহ্য ও জাতীয়তাবাদে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী নিউ ইয়র্কারের সাংবাদিক ইভান অসনোস বলেছেন, ‘সি চিন পিং চীনকে আবার মহান করার চেষ্টা করছেন। পুতিন রাশিয়াকে আবার মহান করার চেষ্টা করছেন।’ এই ‘মহান’ করার অর্থ হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবাদে ফিরে যাওয়া। 

সংগত কারণে পুতিন তাঁর বক্তৃতায় বারবার বলেন, তাঁর যুদ্ধ মূলত পশ্চিমা উদারতাবাদ ও রুশ ঐতিহ্যবাদের মধ্যে যুদ্ধ। কিন্তু বাইডেন বলেছেন, যুদ্ধটা স্বাধীনতা ও স্বৈরাচারের মধ্যে। খলনায়ক এখানে পুতিন, রুশ জনগণ নয়। 

দুই নেতার বক্তব্য থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের বিভাজনটা স্পষ্ট বোঝা যায়। পশ্চিম চায় বহুত্ববাদী উদার গণতন্ত্র, ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। অন্যদিকে পূর্ব চায়, স্বৈরাচারিতা, রক্ষণশীলতা, ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ইত্যাদি। 

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুতিনকে পছন্দ করতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে পুতিনের প্রশংসাও করেছেন। ট্রাম্প ছিলেন ন্যাটোবিরোধী। তাঁর সময়ে বিশ্বের স্বৈরশাসকেরা শক্তিশালী হয়েছে। আশ্চর্যজনক শোনালেও সত্য, মাত্র এক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানরা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়ে পুতিনকে বেশি পছন্দ করতেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর নবনির্বাচিত সিনেটর সেন জেডি ভ্যান্স বলেছেন, ‘ইউক্রেন নিয়ে আমি ভাবি না। সেখানে কী ঘটবে, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’ 

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুতিনকে পছন্দ করতেনট্রাম্পের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পিটার নাভারো বলেছেন, ‘ইউক্রেন কোনো দেশ নয়।’ 

ট্রাম্প আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পুতিনের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর (পুতিনের) প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা রয়েছে।’

জর্জিয়ার রিপ্রেজেনটেটিভ মার্জরি টেলর গ্রিন বলেছেন, ‘ন্যাটো ইউক্রেনের নব্য নাৎসিদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনে আর এক পয়সাও যাবে না।’ 

শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী নেতা নিক ফুয়েন্তেস আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘পুতিন যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতেন, কতই না ভালো হতো!’ 

এসব বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বহু রাজনৈতিক নেতা, বিশেষ করে রিপাবলিকান নেতারা পুতিনের পক্ষে রয়েছেন। 

লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা ও অধঃপতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পুতিন তাঁর রাশিয়াকে বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদীদের কাছে সেরা হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশের জাতীয়তাবাদী নেতারা পুতিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। 

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ২ লাখ সৈন্য হতাহত হয়েছেইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পর এসে তাহলে কী দেখা যাচ্ছে? পুতিন তাঁর ক্ষমতা ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে মজবুত করতে জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিনরা কী করবেন? পুতিনের মতো একজন স্বৈরাচারী শাসকের পাশে দাঁড়াবেন? তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মানে হচ্ছে, স্বৈরাচার ও উগ্র জাতীয়তাবাদের পাশে দাঁড়ানো। নাকি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবেন? 

সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। 

সূত্র: সিএনএন, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস ও সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আমিনুল ইসলাম নন, শিক্ষা উপদেষ্টা হচ্ছেন অধ্যাপক আবরার

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোঁড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

উপদেষ্টা হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

বসুন্ধরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ বিদেশি নাগরিককে মারধর

বিএনপির দুই পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত