দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে ড. ইউনূসের ‘মেগাফোন কূটনীতি’, বিরক্ত ভারত

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ৪৫
Thumbnail image

আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান ভারতে। তার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়া যেমন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অস্বস্তিকর, তেমনি এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বিস্মিত হয়েছে ভারত।

শেখ হাসিনাকে ভারতপন্থী হিসেবেই দেখা হয় এবং তাঁর ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশ ঘনিষ্ঠ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উপভোগ করেছে। তাঁর ক্ষমতায় থাকার সময়টি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও বেশ সুবিধাজনক ছিল। কারণ, তিনি বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত কিছু ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী দমন করেছিলেন এবং সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেছিলেন। কিন্তু ভারতে তাঁর উপস্থিতি, তিনি কত দিন সেখানে থাকবেন সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা না থাকায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে। গত সপ্তাহে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, দিল্লি যদি শেখ হাসিনাকে ভারতে রাখতে চায়, তবে তাঁকে যেন রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখে। ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘যদি বাংলাদেশ (সরকার) তাঁকে (শেখ হাসিনা) ফেরত না নেওয়া পর্যন্ত ভারত তাঁকে রাখতে চায়, তবে শর্ত হলো—তাঁকে চুপ থাকতে হবে।’ 

সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তলানিতে আছে উল্লেখ করে বলেছিলেন, উভয় দেশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা বিশেষ করে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করেনি। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে কর্মকর্তারা ‘বিচলিত’ বলে জানা গেছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ‘ভারত এখন অপেক্ষা করছে এবং বাংলাদেশের কী ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিবৃতিগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখছে—যা মূলত সরকারি মতামত এবং নাগরিক সমাজে প্রতিনিধিরা বলছেন।’ 

ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বলেছেন, ‘আমরা বিস্মিত যে বাংলাদেশ গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিতর্কিত দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছে। ড. ইউনূস এই বিষয়টিকে “মেগাফোন কূটনীতি” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।’ 

বীণা সিক্রি বলেন, ‘ভারত (বাংলাদেশের) অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কথা বলার জন্য এবং বাংলাদেশ ও ভারতের সব উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করার জন্য তার প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছে।’ সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, সমস্যাগুলো দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ কিসের ভিত্তিতে (ড. ইউনূস) দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘তলানিতে’ বলে উল্লেখ করেছেন তা স্পষ্ট নয়। 

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিবিসিকে বলেছেন, ‘ভারতীয় নেতারা কি কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন না? ড. ইউনূসকে যদি নির্দিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি অবশ্যই তাঁর মতামত প্রকাশ করতে পারেন। আপনি যদি সমালোচনা করতে চান, তবে যেকোনো বিষয়েই সমালোচনা করতে পারেন।’ 

শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অন্য মাত্রায় পৌঁছেছিল বলে দাবি ভারতীয় বিশ্লেষকদের। ছবি: এএফপিকয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ড. ইউনূস টেলিফোনে কথা বললেও এখন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের কোনো বৈঠক হয়নি। তবে ভারতে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে যতক্ষণ না অন্য দেশ তাঁকে যাওয়ার অনুমতি দেয়, ততক্ষণ শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করতে পারবেন। 

তবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচার করার জন্য তাঁরা শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু তাঁকে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান আসামি করা হয়েছে, আমরা তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য আইনগতভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।’ 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করলেও হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা কম। এ বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, ‘তিনি এখানে ভারতের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন। আমরা যদি আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুর প্রতি মৌলিক সৌজন্য প্রকাশ না করি, তাহলে ভবিষ্যতে কেন কেউ আমাদের বন্ধু হিসেবে গুরুত্ব সহকারে নেবে?’ 

বাংলাদেশে কেবল আওয়ামী লীগকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য বিরোধী দলগুলোকে আমলে না নেওয়ায় ভারতের সমালোচনা করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, কেবল শেখ হাসিনার নেতৃত্বই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে—নয়াদিল্লিকে এই ন্যারেটিভ বাদ দিতে হবে। 

ড. ইউনূস বলেন, ‘আগামীর পথ হলো ভারতের এই ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে আসা। ন্যারেটিভটি হলো—সবাই ইসলামপন্থী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থী এবং বাকি সবাই ইসলামপন্থী এবং এই দেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে। আর শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশ নিরাপদ। ভারত এই আখ্যানে বিমোহিত। ভারতকে এই আখ্যান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আরেকটি প্রতিবেশী—এটিও ভারতকে মনে রাখতে হবে।’ 

তবে ভারতীয় বিশ্লেষকেরা ড. ইউনূসের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। যেমন বীণা সিক্রি বলেন, ‘আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে একেবারেই একমত নই। বাংলাদেশে আমাদের হাইকমিশনাররা কোনো ধরনের বৈষম্য না করেই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেন।’ 

২০০১—২০০৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বিএনপির জোট সরকারের সময় ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বিশেষ করে, দিল্লি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ঢাকাকে অভিযুক্ত করে। কিন্তু বিএনপি তা বরাবরই অস্বীকার করেছে। 

তবে বাংলাদেশের অনেকেই উল্লেখ করেছেন, ভারতের উচিত বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করা। কারণ, দলটি যখনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক না কেন—জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘৫ আগস্টের (হাসিনার সরকার পতনের) পর থেকে কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। কেন করেননি, তার কারণ আমি জানি না।’ পক্ষান্তরে, বিএনপির সঙ্গে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা নিয়মিত বৈঠক করছেন। 

হাসিনার পতনের পরের দিনগুলোতে বাংলাদেশে নিরাপত্তার অভাব ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুদের ওপর হামলার খবরে ভারত বেশ কয়েকবার উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি মাজারও কট্টর ইসলামপন্থীরা ভাঙচুর করেছে। সিরাজগঞ্জের আলী খাজা আলী পাগলা পীরের মাজারের তত্ত্বাবধায়কের স্ত্রী তামান্না আক্তার বলেন, ‘কয়েক দিন আগে একদল লোক এসে আমার শ্বশুরের সমাধি ভাঙচুর করে এবং কোনো অনৈসলামিক অনুষ্ঠান না করার জন্য আমাদের সতর্ক করে।’ 

অন্তর্বর্তী সরকারে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসাইন বলেছেন, যারা ধর্মীয় স্থাপনাকে টার্গেট করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কট্টর ইসলামপন্থীরা যদি একটি দৃঢ় উপস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশে—তা আকারে যত ছোটই হোক না কেন—তা দিল্লির জন্য বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে। 

গত কয়েক সপ্তাহে একজন দণ্ডিত জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। নয়জন সন্দেহভাজন কট্টরপন্থী গত মাসে জেলে আগুনের ঘটনার সময় পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তাদের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের—যেটিকে ২০১৬ সালে হাসিনার সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল—প্রধান জসিমুদ্দিন রহমানীও গত মাসে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ২০১৫ সালে এক ব্লগার হত্যার অভিযোগে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য বিচারাধীন মামলার কারণে কারাবন্দিত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তিনি কারাগারে ছিলেন। 

এ বিষয়ে রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, ‘গত মাসে বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে মুক্ত দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভারতের কাছে পরিচিত।’ সাবেক কূটনীতিক এটিকে একটি ‘গুরুতর বিষয়’ বলে অভিহিত করেন।

অনুবাদ করেছেন: আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত