মন্টি বৈষ্ণব
প্রতিটি মানুষই আলাদা। একজন থেকে অন্যজনের সংকট ও সম্ভাবনার ধরনও আলাদা। বিশেষ করে নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠনগত জায়গা থেকে তাদের যন্ত্রণার বিষয় পুরোপুরিই আলাদা। প্রতি মাসে কোনো এক সময় নারীকে তীব্র যন্ত্রণা পোহাতে হয়। অনেকে এ সময় যন্ত্রণায় বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না। এই যন্ত্রণা শুধু তার পক্ষেই বোঝা সম্ভব। এই ব্যথার বন্ধু একমাত্র নিজেই।
সচেতন পাঠকমাত্রই বোঝার কথা যে, নারীর ঋতুকালীন সংকটের কথা বলা হচ্ছে। প্রতি মাসে বেশির ভাগ নারী ঋতুকালীন ব্যথায় কাতরান। এই ব্যথা কারও হয়তো কম, আবার কারও বেশি। এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সংকটে ভোগেন কর্মজীবী নারীরা। এই ব্যথা নিয়েই তাঁদের অফিস-কাছারি করতে হয়। যন্ত্রণা বেশি হলে কেউ কেউ হয়তো ছুটির আবেদন করেন। কিন্তু এমনটা ঘন ঘন হলেই পুরুষ সহকর্মীদের বাঁকা চোখ সহ্য করতে হয়। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ঋতুকালীন ছুটির ব্যবস্থা আছে। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে স্পেন। সেই আলাপ পরে। আগে জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের অবস্থা কী?
প্রতি মাসে ঋতুকালে অসহ্য যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করে এ নিয়ে নিজের বিড়ম্বনার কথা জানালেন ডেইজি (ছদ্মনাম)। নামী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এই গণমাধ্যমকর্মী জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঋতুকালীন শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। কতটা জানাতে গিয়ে বললেন, ‘সেদিন (ঋতুকালে) সকাল থেকে অল্প ব্যথা ছিল। যেহেতু ঋতুকালে বাসায় থেকে অফিস করার সুযোগ নেই, তাই সকালে বাসে চড়ে অফিসে যাই। অফিসে পৌঁছানোর পর তলপেটের ব্যথা বাড়তে থাকে। সহ্য করতে না পেরে ব্যথার ওষুধ খেলাম।
একপর্যায়ে কেমন যেন সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছিল। হাত-পায়েও ব্যথা বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়তে থাকে কোমরের যন্ত্রণা। শরীরের অবস্থা বেশি খারাপ হলে সহকর্মীরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা শরবত, সেদ্ধ ডিম খাওয়ান আমাকে। শরীর বেশি খারাপ বলে শেষে অফিসের এক কোণে গিয়ে বিশ্রাম নিই। পরে বিকেলের দিকে ব্যথা কমলে বাসায় ফিরি। সেদিন বাসায় বিশ্রাম নিলে বা বাসা থেকে অফিস করতে পারলে হয়তো এমন অসুস্থ হয়ে পড়তাম না। এতে দিন শেষে অফিসের কাজেরই ক্ষতি হলো।’
ছুটি না নেওয়ার কারণ হিসেবে ডেইজি বলেন, ‘আমার কাছে প্রতি মাসে পিরিয়ডের জন্য ছুটি নেওয়া ঝামেলার মনে হয়। এমন অসুস্থতায় পরেরবার আমি অসুস্থতাজনিত ছুটির আবেদন করি, কিন্তু মেডিকেল রিপোর্ট না থাকায় মানবসম্পদ বিভাগ থেকে সেই ছুটি মঞ্জুর করেনি। ঋতুকালে ব্যথার জন্য মেডিকেলের কী কাগজপত্র দেখাব? ওই ছুটি আমার ঐচ্ছিক ছুটি থেকে কেটে রাখা হয়।’
ডেইজির মতো সংকটে পড়েন প্রায় সব কর্মজীবী নারী। ছুটি নিতে গেলে কারণ দর্শাতে গিয়ে দমে যেতে হয়। সংকোচের কারণে পিরিয়ডের কথা বলতে পারেন না। তেমন পরিবেশ দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই। সহকর্মীদের দিক থেকেও নানা সংকট থাকে। পুরুষ সহকর্মীরা অনেক সময়ই বিষয়টি বুঝতে পারেন না। আবার এই যন্ত্রণার মাত্রা যেহেতু সবার ক্ষেত্রে এক নয়, নারী সহকর্মীদের কাছ থেকেও শুনতে হয় নানা কথা। আবার প্রতি মাসে ঐচ্ছিক ছুটি নেওয়া নিয়েও সংকোচে ভোগেন অনেকে। ডেইজিই যেমন বললেন, ‘আমার মতো যাঁদের ঋতুকালীন সময়ে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, তাদের এই সময়ে ছুটি প্রয়োজন। এই ছুটি কেটে নেওয়া উচিত অসুস্থতাজনিত ছুটি থেকে। কারণ প্রতি মাসে ঐচ্ছিক ছুটি থেকে ছুটি নিলে অন্য কোনো সময়ে প্রয়োজনীয় ছুটি নেওয়া যায় না। ছুটির সংখ্যা তো নির্ধারিত।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত মেঘনার (ছদ্মনাম) অভিজ্ঞতা আরও বাজে। জানালেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকরির ন্যূনতম যোগ্যতা অনার্স। তাই সবাই শিক্ষিত বলা যায়। কিন্তু অফিসের নানা নিয়ম ও ব্যবস্থাপনা সেই ইঙ্গিত দেয় না। মেঘনা বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে নেই জরুরি প্রয়োজনে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা। অসুস্থতার কারণে বিশ্রামের জন্য নেই বিশ্রামকক্ষ। এ ছাড়া ন্যাপকিন পরিবর্তন করারও কোনো সুব্যবস্থা নেই।’
এ নিয়ে সবচেয়ে সংকটে ভোগেন কারখানা শ্রমিকেরা। এমনিতেই বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় শ্রম পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে নারী কর্মীদের বিশেষ প্রয়োজনে এসব কারখানা কর্তৃপক্ষের সংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন করাটা অবান্তর। এ নিয়ে কথা হয় গার্মেন্টস শ্রমিক শেফালির (ছদ্মনাম) সঙ্গে। গার্মেন্টসে এমন ক্ষেত্রে আচরণ কেমন জানতে চাইলে শেফালি বলেন, ‘আমার ডিউটি ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা। অনেক বেশি কাজ থাকলে খাইতে যাওয়ারও সময় পাই না। বাথরুমে যামু কখন? ফলে মাসিকের সময় অনেক কষ্ট হয়। একটানা বসে ৬-৭ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় কাজ করা লাগে। পেটে ব্যথা বা শরীর খারাপ লাগলেও কাজ চালু রাখা লাগে। শরীর খারাপ লাগতাছে বললে মাসিকের সময়ও কাজ কমায় না। আর স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের টাকা থাকে না। তাই কাপড় ব্যবহার করি। একটানা অনেকক্ষণ এক কাপড় ব্যবহার করা লাগে। কারণ অফিসের বাথরুমের অবস্থাও ভালো না। আবার মেয়ে মানুষের এই অসুখের কথা সহজে কাউরে বলাও যায় না। পুরুষ সুপারভাইজারদের কাছে মাসিকের কথা বলতে লজ্জা লাগে। তাই কষ্ট সহ্য করে কাজ করি।’
তবে সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন নয়। কেউ কেউ মাথার ওপরে সংবেদনশীল ঊর্ধ্বতনের ছায়া পান। এমনই একজন গণমাধ্যমে কর্মরত ফারহানা (ছদ্মনাম)। তিনি ঋতুকালে অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহযোগিতা পান। এ ছাড়া ফারহানার অফিসে মানবসম্পদ বিভাগে জমা থাকে গরম পানির ব্যাগ, ব্যথার ওষুধ, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র। তিনি বলেন, ‘আমার কর্মস্থলের রিপোর্টিং বস পুরুষ হলেও কখনো জিজ্ঞেস করেন না আমার কী অসুবিধা হচ্ছে। শুধু তাঁকে জানালেই হয় আমার শরীর খারাপ লাগছে। সেদিনের বাকি কাজে তিনিই আমাকে সাহায্য করেন অথবা ছুটি নিতে বলেন।’
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঋতুকালে নারীর বিশ্রামের প্রসঙ্গটিই ঘুরেফিরে সামনে আসে। এ নিয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, ‘ঋতুচক্র নারীদের খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। প্রতি মাসে এটি সম্পন্ন হয়। এই দিনগুলোতে মাসের অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু আরামে থাকতে পারলে সবার ভালো লাগে। অনেকে ঋতুকালে প্রচণ্ড ব্যথায় ভোগেন। এ সময় শরীর চায় একটু বিশ্রাম। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হয় বলে ব্যথার যন্ত্রণায় ভুগতে হয়। তবে, ঋতুকালে বেশি ব্যথা অনুভব করলে উচিত প্রতিষ্ঠানের বিশ্রামের রুম বা বাসা থেকে অফিসের কাজ সমাপ্ত করা।’
এমন প্রয়োজনের বিষয়টি কিন্তু একটু দেরিতে হলেও অনেক দেশ আমলে নিতে শুরু করেছে। স্পেন সরকার যেমন সে দেশের নারীদের জন্য ঋতুকালীন ছুটি মঞ্জুর করেছে। গত ১৭ মে ইউরোনিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে স্পেন ঋতুকালে নারীদের জন্য ছুটির আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তিন দিন বা তার বেশি ছুটির বিধান রেখে একটি খসড়া আইনে সরকার প্রাথমিক অনুমোদনও দিয়েছে। তবে এটি পূর্ণাঙ্গ আইনে রূপান্তরিত হতে দেশটির আইনসভা থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এ জন্য কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
দ্য স্প্যানিশ গাইনোকলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স সোসাইটির সূত্র থেকে জানা যায়, ঋতুকালে এক-তৃতীয়াংশ নারী তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। এ ধরনের ব্যথাকে বলা হয় ডিসমেনোরিয়া। ঋতুকালে পেটব্যথা, পেটে খারাপ, বমি, জ্বর, মাথাব্যথাসহ শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতার বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ রেখে স্পেন সরকার এই ছুটির কথা ভেবেছে। এ ছাড়া দেশটির প্রত্যেক স্কুলে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার ব্যবস্থাও করেছে স্পেন সরকার।
প্রসঙ্গত, নারী কর্মীদের জন্য বর্তমানে অল্প কিছু দেশে ঋতুকালীন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে জাপান, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাম্বিয়ার নাম উল্লেখ করা যায়। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ইতালি ২০১৬ সালে এ ধরনের একটি আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপ পায়নি। তারা নারী কর্মীদের তিন দিনের পূর্ণাঙ্গ সবেতন ছুটি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। বর্তমানে স্পেনও একই পথে হাঁটছে। দেশটি শেষ পর্যন্ত সফল হলে তা নিশ্চিতভাবে ইউরোপকে পথ দেখাবে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে?
বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও কিছু প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই কিছু ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এর সংখ্যা হাতে গোনা।
নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের জন্য ঋতুকালে বাসায় থেকে কাজ করার সুযোগ আছে বলে জানালেন অ্যাকশন-এইড বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক আকলিমা আক্তার মিলি। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘অ্যাকশন-এইডে বাসা থেকে কাজ করার সুবিধা রয়েছে। যে কেউ চাইলে এই সময়ে বাসায় থেকে কাজ করতে পারেন। হোম অফিসের বিষয়টি শুধু ঋতুকালের জন্যই নয়, অফিসের কোনো নারী অসুস্থ বোধ করলে বাসা থেকে কাজ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা এক দিনের বেশিও ছুটি নিতে পারেন। প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মীদের জন্য রয়েছে বিশ্রামকক্ষ। সেখানে গরম পানিরও ব্যবস্থা আছে। যে কেউ চাইলে এই রুম থেকেও অফিসের কাজে যুক্ত থাকতে পারেন।’
একইভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে নারীবান্ধব বলে জানালেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই প্রতিষ্ঠান নারীবান্ধব। এখানে খুব সহজে পিরিয়ডের কথা বলতে পারা যায়। যাঁদের ছুটি দরকার, তাঁরা ছুটি নিতে পারেন। আবার বাসা থেকে অফিস করারও ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া নারীদের জন্য বিশ্রামের রুম এবং অফিসের ওয়াশরুমে স্যানিটারি ন্যাপকিনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এতে নারী সহকর্মীরা ঋতুকালে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন না।’
এমন দু-একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও একে এখনো ব্যতিক্রমই বলতে হবে। বৃহৎ পরিসরে এ নিয়ে তেমন আলোচনাও হয় না। কিন্তু হওয়া প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে এমন সংবেদনশীল পদক্ষেপ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোই পথ দেখাতে পারে।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পড়ুন:
প্রতিটি মানুষই আলাদা। একজন থেকে অন্যজনের সংকট ও সম্ভাবনার ধরনও আলাদা। বিশেষ করে নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠনগত জায়গা থেকে তাদের যন্ত্রণার বিষয় পুরোপুরিই আলাদা। প্রতি মাসে কোনো এক সময় নারীকে তীব্র যন্ত্রণা পোহাতে হয়। অনেকে এ সময় যন্ত্রণায় বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না। এই যন্ত্রণা শুধু তার পক্ষেই বোঝা সম্ভব। এই ব্যথার বন্ধু একমাত্র নিজেই।
সচেতন পাঠকমাত্রই বোঝার কথা যে, নারীর ঋতুকালীন সংকটের কথা বলা হচ্ছে। প্রতি মাসে বেশির ভাগ নারী ঋতুকালীন ব্যথায় কাতরান। এই ব্যথা কারও হয়তো কম, আবার কারও বেশি। এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সংকটে ভোগেন কর্মজীবী নারীরা। এই ব্যথা নিয়েই তাঁদের অফিস-কাছারি করতে হয়। যন্ত্রণা বেশি হলে কেউ কেউ হয়তো ছুটির আবেদন করেন। কিন্তু এমনটা ঘন ঘন হলেই পুরুষ সহকর্মীদের বাঁকা চোখ সহ্য করতে হয়। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ঋতুকালীন ছুটির ব্যবস্থা আছে। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে স্পেন। সেই আলাপ পরে। আগে জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের অবস্থা কী?
প্রতি মাসে ঋতুকালে অসহ্য যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করে এ নিয়ে নিজের বিড়ম্বনার কথা জানালেন ডেইজি (ছদ্মনাম)। নামী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এই গণমাধ্যমকর্মী জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঋতুকালীন শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। কতটা জানাতে গিয়ে বললেন, ‘সেদিন (ঋতুকালে) সকাল থেকে অল্প ব্যথা ছিল। যেহেতু ঋতুকালে বাসায় থেকে অফিস করার সুযোগ নেই, তাই সকালে বাসে চড়ে অফিসে যাই। অফিসে পৌঁছানোর পর তলপেটের ব্যথা বাড়তে থাকে। সহ্য করতে না পেরে ব্যথার ওষুধ খেলাম।
একপর্যায়ে কেমন যেন সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছিল। হাত-পায়েও ব্যথা বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়তে থাকে কোমরের যন্ত্রণা। শরীরের অবস্থা বেশি খারাপ হলে সহকর্মীরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা শরবত, সেদ্ধ ডিম খাওয়ান আমাকে। শরীর বেশি খারাপ বলে শেষে অফিসের এক কোণে গিয়ে বিশ্রাম নিই। পরে বিকেলের দিকে ব্যথা কমলে বাসায় ফিরি। সেদিন বাসায় বিশ্রাম নিলে বা বাসা থেকে অফিস করতে পারলে হয়তো এমন অসুস্থ হয়ে পড়তাম না। এতে দিন শেষে অফিসের কাজেরই ক্ষতি হলো।’
ছুটি না নেওয়ার কারণ হিসেবে ডেইজি বলেন, ‘আমার কাছে প্রতি মাসে পিরিয়ডের জন্য ছুটি নেওয়া ঝামেলার মনে হয়। এমন অসুস্থতায় পরেরবার আমি অসুস্থতাজনিত ছুটির আবেদন করি, কিন্তু মেডিকেল রিপোর্ট না থাকায় মানবসম্পদ বিভাগ থেকে সেই ছুটি মঞ্জুর করেনি। ঋতুকালে ব্যথার জন্য মেডিকেলের কী কাগজপত্র দেখাব? ওই ছুটি আমার ঐচ্ছিক ছুটি থেকে কেটে রাখা হয়।’
ডেইজির মতো সংকটে পড়েন প্রায় সব কর্মজীবী নারী। ছুটি নিতে গেলে কারণ দর্শাতে গিয়ে দমে যেতে হয়। সংকোচের কারণে পিরিয়ডের কথা বলতে পারেন না। তেমন পরিবেশ দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই। সহকর্মীদের দিক থেকেও নানা সংকট থাকে। পুরুষ সহকর্মীরা অনেক সময়ই বিষয়টি বুঝতে পারেন না। আবার এই যন্ত্রণার মাত্রা যেহেতু সবার ক্ষেত্রে এক নয়, নারী সহকর্মীদের কাছ থেকেও শুনতে হয় নানা কথা। আবার প্রতি মাসে ঐচ্ছিক ছুটি নেওয়া নিয়েও সংকোচে ভোগেন অনেকে। ডেইজিই যেমন বললেন, ‘আমার মতো যাঁদের ঋতুকালীন সময়ে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, তাদের এই সময়ে ছুটি প্রয়োজন। এই ছুটি কেটে নেওয়া উচিত অসুস্থতাজনিত ছুটি থেকে। কারণ প্রতি মাসে ঐচ্ছিক ছুটি থেকে ছুটি নিলে অন্য কোনো সময়ে প্রয়োজনীয় ছুটি নেওয়া যায় না। ছুটির সংখ্যা তো নির্ধারিত।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত মেঘনার (ছদ্মনাম) অভিজ্ঞতা আরও বাজে। জানালেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকরির ন্যূনতম যোগ্যতা অনার্স। তাই সবাই শিক্ষিত বলা যায়। কিন্তু অফিসের নানা নিয়ম ও ব্যবস্থাপনা সেই ইঙ্গিত দেয় না। মেঘনা বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে নেই জরুরি প্রয়োজনে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা। অসুস্থতার কারণে বিশ্রামের জন্য নেই বিশ্রামকক্ষ। এ ছাড়া ন্যাপকিন পরিবর্তন করারও কোনো সুব্যবস্থা নেই।’
এ নিয়ে সবচেয়ে সংকটে ভোগেন কারখানা শ্রমিকেরা। এমনিতেই বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় শ্রম পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে নারী কর্মীদের বিশেষ প্রয়োজনে এসব কারখানা কর্তৃপক্ষের সংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন করাটা অবান্তর। এ নিয়ে কথা হয় গার্মেন্টস শ্রমিক শেফালির (ছদ্মনাম) সঙ্গে। গার্মেন্টসে এমন ক্ষেত্রে আচরণ কেমন জানতে চাইলে শেফালি বলেন, ‘আমার ডিউটি ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা। অনেক বেশি কাজ থাকলে খাইতে যাওয়ারও সময় পাই না। বাথরুমে যামু কখন? ফলে মাসিকের সময় অনেক কষ্ট হয়। একটানা বসে ৬-৭ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় কাজ করা লাগে। পেটে ব্যথা বা শরীর খারাপ লাগলেও কাজ চালু রাখা লাগে। শরীর খারাপ লাগতাছে বললে মাসিকের সময়ও কাজ কমায় না। আর স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের টাকা থাকে না। তাই কাপড় ব্যবহার করি। একটানা অনেকক্ষণ এক কাপড় ব্যবহার করা লাগে। কারণ অফিসের বাথরুমের অবস্থাও ভালো না। আবার মেয়ে মানুষের এই অসুখের কথা সহজে কাউরে বলাও যায় না। পুরুষ সুপারভাইজারদের কাছে মাসিকের কথা বলতে লজ্জা লাগে। তাই কষ্ট সহ্য করে কাজ করি।’
তবে সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন নয়। কেউ কেউ মাথার ওপরে সংবেদনশীল ঊর্ধ্বতনের ছায়া পান। এমনই একজন গণমাধ্যমে কর্মরত ফারহানা (ছদ্মনাম)। তিনি ঋতুকালে অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহযোগিতা পান। এ ছাড়া ফারহানার অফিসে মানবসম্পদ বিভাগে জমা থাকে গরম পানির ব্যাগ, ব্যথার ওষুধ, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র। তিনি বলেন, ‘আমার কর্মস্থলের রিপোর্টিং বস পুরুষ হলেও কখনো জিজ্ঞেস করেন না আমার কী অসুবিধা হচ্ছে। শুধু তাঁকে জানালেই হয় আমার শরীর খারাপ লাগছে। সেদিনের বাকি কাজে তিনিই আমাকে সাহায্য করেন অথবা ছুটি নিতে বলেন।’
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঋতুকালে নারীর বিশ্রামের প্রসঙ্গটিই ঘুরেফিরে সামনে আসে। এ নিয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, ‘ঋতুচক্র নারীদের খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। প্রতি মাসে এটি সম্পন্ন হয়। এই দিনগুলোতে মাসের অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু আরামে থাকতে পারলে সবার ভালো লাগে। অনেকে ঋতুকালে প্রচণ্ড ব্যথায় ভোগেন। এ সময় শরীর চায় একটু বিশ্রাম। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হয় বলে ব্যথার যন্ত্রণায় ভুগতে হয়। তবে, ঋতুকালে বেশি ব্যথা অনুভব করলে উচিত প্রতিষ্ঠানের বিশ্রামের রুম বা বাসা থেকে অফিসের কাজ সমাপ্ত করা।’
এমন প্রয়োজনের বিষয়টি কিন্তু একটু দেরিতে হলেও অনেক দেশ আমলে নিতে শুরু করেছে। স্পেন সরকার যেমন সে দেশের নারীদের জন্য ঋতুকালীন ছুটি মঞ্জুর করেছে। গত ১৭ মে ইউরোনিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে স্পেন ঋতুকালে নারীদের জন্য ছুটির আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তিন দিন বা তার বেশি ছুটির বিধান রেখে একটি খসড়া আইনে সরকার প্রাথমিক অনুমোদনও দিয়েছে। তবে এটি পূর্ণাঙ্গ আইনে রূপান্তরিত হতে দেশটির আইনসভা থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এ জন্য কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
দ্য স্প্যানিশ গাইনোকলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স সোসাইটির সূত্র থেকে জানা যায়, ঋতুকালে এক-তৃতীয়াংশ নারী তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। এ ধরনের ব্যথাকে বলা হয় ডিসমেনোরিয়া। ঋতুকালে পেটব্যথা, পেটে খারাপ, বমি, জ্বর, মাথাব্যথাসহ শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতার বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ রেখে স্পেন সরকার এই ছুটির কথা ভেবেছে। এ ছাড়া দেশটির প্রত্যেক স্কুলে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার ব্যবস্থাও করেছে স্পেন সরকার।
প্রসঙ্গত, নারী কর্মীদের জন্য বর্তমানে অল্প কিছু দেশে ঋতুকালীন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে জাপান, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাম্বিয়ার নাম উল্লেখ করা যায়। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ইতালি ২০১৬ সালে এ ধরনের একটি আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপ পায়নি। তারা নারী কর্মীদের তিন দিনের পূর্ণাঙ্গ সবেতন ছুটি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। বর্তমানে স্পেনও একই পথে হাঁটছে। দেশটি শেষ পর্যন্ত সফল হলে তা নিশ্চিতভাবে ইউরোপকে পথ দেখাবে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে?
বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও কিছু প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই কিছু ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এর সংখ্যা হাতে গোনা।
নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের জন্য ঋতুকালে বাসায় থেকে কাজ করার সুযোগ আছে বলে জানালেন অ্যাকশন-এইড বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক আকলিমা আক্তার মিলি। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘অ্যাকশন-এইডে বাসা থেকে কাজ করার সুবিধা রয়েছে। যে কেউ চাইলে এই সময়ে বাসায় থেকে কাজ করতে পারেন। হোম অফিসের বিষয়টি শুধু ঋতুকালের জন্যই নয়, অফিসের কোনো নারী অসুস্থ বোধ করলে বাসা থেকে কাজ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা এক দিনের বেশিও ছুটি নিতে পারেন। প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মীদের জন্য রয়েছে বিশ্রামকক্ষ। সেখানে গরম পানিরও ব্যবস্থা আছে। যে কেউ চাইলে এই রুম থেকেও অফিসের কাজে যুক্ত থাকতে পারেন।’
একইভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে নারীবান্ধব বলে জানালেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই প্রতিষ্ঠান নারীবান্ধব। এখানে খুব সহজে পিরিয়ডের কথা বলতে পারা যায়। যাঁদের ছুটি দরকার, তাঁরা ছুটি নিতে পারেন। আবার বাসা থেকে অফিস করারও ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া নারীদের জন্য বিশ্রামের রুম এবং অফিসের ওয়াশরুমে স্যানিটারি ন্যাপকিনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এতে নারী সহকর্মীরা ঋতুকালে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন না।’
এমন দু-একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও একে এখনো ব্যতিক্রমই বলতে হবে। বৃহৎ পরিসরে এ নিয়ে তেমন আলোচনাও হয় না। কিন্তু হওয়া প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে এমন সংবেদনশীল পদক্ষেপ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোই পথ দেখাতে পারে।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পড়ুন:
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
১ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৮ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
১২ দিন আগে