মারুফ ইসলাম
২০১৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করেছিল, তারা ২০৪০ সালের পর আর পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রি করবে না। সব পরিবহন হবে বিদ্যুচ্চালিত। এই উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিও চলছে। সারা দেশে এমন একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে, যার মাধ্যমে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি চলবে।
ব্রিটিশ সরকারের এই উদ্যোগে নিঃসন্দেহে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ব্রিটেনে ২০৩৫ সালের মধ্যে আরও ২৫ টেরাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হবে।
বিদ্যুতের চাহিদা শুধু ব্রিটেনেই বাড়ছে, তা নয়। সারা পৃথিবীতেই বাড়ছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৫০০ টেরাওয়াট-ঘণ্টা বেড়েছে। বিদ্যুতের এই চাহিদা ২০২৪ সাল পর্যন্ত গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদ্যুতের চাহিদা ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে। একই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ৫ শতাংশ বাড়বে।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়েছে চীনে। ২০২০ সালে সারা বিশ্বে বিদ্যুতের যত চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তার অর্ধেকই ছিল চীনে। প্রতিবছর এই চাহিদা আরও বাড়ছে। চীনে বর্তমানে প্রতি ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। ২০১৯ সালে চায়না ইলেকট্রিসিটি কাউন্সিল জানিয়েছিল, দেশটিতে প্রতিবছর বিদ্যুতের ব্যবহার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় ভারতে; বছরে প্রায় ১ দশমিক ৫৪ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি চার ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা স্পর্শ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) তাদের ২০২০ সালের ইলেকট্রিসিটি মার্কেট রিপোর্টে বলেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এয়ারকন্ডিশন বা এয়ারকুলারসহ বিদ্যুচ্চালিত অন্যান্য গৃহস্থালি যন্ত্রপাতির চাহিদা গত ২০ বছরে গড়ে ৬ শতাংশ করে বেড়েছে। এই অঞ্চলে বিদ্যুতের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় ব্যবহৃত মোট বিদ্যুতের মধ্যে দেশ চারটির বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার যথাক্রমে ২৬, ২২, ১৯ ও ১৫ শতাংশ।
বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান এই চাহিদা মেটানোর জন্য ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন কয়েক বছর আগে থেকেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে শুরু করেছে। তবে পরিবেশ বিপর্যয় বিবেচনায় নিয়ে ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর আইইএ এক কনফারেন্সে নতুন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফিলিপাইনের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। ফলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আর বাড়াতে পারছে না ফিলিপাইন।
কিন্তু বিকল্প কিছু তো ভাবতে হবে! সেটি কী? এশিয়ার ১০টি দেশের (ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম) সংগঠন ‘আসিয়ান’ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার নাম ‘আসিয়ান পাওয়ার গ্রিড’। এই প্রকল্পের আওতায় আসিয়ান ২০২৫ সালের মধ্যে ২৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে একীভূত করবে। এর জন্য দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুতের আন্তবাণিজ্য বাড়াতে হবে।
এরই মধ্যে আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের এক বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে লাওস, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পাওয়ার ইন্টিগ্রেশন প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে লাওস থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ স্থানান্তর করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরকেও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে।
আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছে আসিয়ান, যার নাম ‘আসিয়ান ইন্টারকানেকশন মাস্টার প্ল্যান স্টাডি’। ধারণা করা হচ্ছে, এই গবেষণা আসিয়ান পাওয়ার গ্রিডের কাজকে আরও সহজ করবে।
ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে। দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৩ শতাংশে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৩১ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে।
সিঙ্গাপুর হাঁটছে সৌর বিদ্যুতের পথে। দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে দেড় গিগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ২ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সিঙ্গাপুর বহুপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্যের সঙ্গেও জড়িত। দুটি ২৩০ কেভি এসি লাইনের মাধ্যমে দেশটি মালয়েশিয়া থেকে বিদ্যুৎ আনা-নেওয়া করে।
গত কয়েক দশক ধরে থাইল্যান্ডের বিদ্যুৎ খাত গ্যাসচালিত উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো গ্যাস থেকে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে শুরু করেছে থাইল্যান্ড। এখন জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়ুচালিত বিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুতের দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
এসব তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই চাহিদা কীভাবে মেটানো হবে—কয়লাভিত্তিক উৎপাদন দিয়ে, নাকি ডিজেলভিত্তিক উৎপাদন দিয়ে, নাকি অন্য কোনো উপায়ে, সেটি একটি বিবেচ্য বিষয় বটে। সেটি নিয়ে সারা বিশ্বে এখন তুমুল আলোচনা চলছে।
সেই আলোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছে সুপার কন্ডাক্টর। বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করবে সুপার কন্ডাক্টর। সেটি কেমন ব্যাপার? আমরা জানি সাধারণ ধাতুর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার সময় ইলেকট্রন একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এভাবে ধাক্কা খেতে খেতে তারা শক্তি হারায়। কিন্তু সুপার কন্ডাক্টরের মধ্যে ইলেকট্রন প্রবাহিত হওয়ার সময় কোনো শক্তি হারায় না।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সুপার কন্ডাক্টর ভবিষ্যতে পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থাকেই আমূল পাল্টে দেবে। জার্মানি ইতিমধ্যে তাদের বৈদ্যুতিক গ্রিডে সুপার কন্ডাক্টিং ইলেকট্রিসিটি ট্রান্সমিশন ক্যাবল ব্যবহার করতে শুরু করেছে। দেশটি ২০২০ সালে মিউনিখে ১২ কিলোমিটার সুপার কন্ডাক্টিং লাইন স্থাপন করেছে।
চীনা বিজ্ঞানীরাও বিশ্বের প্রথম সুপার কন্ডাক্টিং বিদ্যুৎ লাইনের প্রোটোটাইপ তৈরি করেছে। এটি চীনের জিনজিয়াং থেকে পূর্ব প্রদেশ পর্যন্ত ২ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। এ ছাড়া গত নভেম্বরে সাংহাইতে ৩৫ কিলোভোল্ট সম্পন্ন ১ দশমিক ২ কিলোমিটার সুপার কন্ডাক্টিং লাইন স্থাপন করেছে।
জাপানও সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ট্রান্সমিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করেছে। দেশটি মনে করছে, বিদ্যুচ্চালিত ট্রেন চালানোর জন্য এটি কম ব্যয়বহুল একটি উপায় হবে। জাপান রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিয়াজাকি প্রিফেকচার পরীক্ষামূলকভাবে দেড় কিলোমিটার সুপার কন্ডাক্টিং ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন করেছে।
সামনের দিনগুলোতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সুপার কন্ডাক্টিং ট্রান্সমিশন লাইনের দিকে ঝুঁকবে, তাতে সন্দেহ নেই। গ্লোবাল সুপার কন্ডাক্টরস মার্কেট রিপোর্ট ২০২২ বলছে, সুপার কন্ডাক্টরের বৈশ্বিক বাজার গত বছর ছিল ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর তা ২১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ৬ দশমিক ৫৪ বিলয়ন ডলার হয়েছে। ২০২৬ সাল নাগাদ এই বাজার ৯ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ৯ দশমিক ৫৪ বিলয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন যে বিদ্যুতের সংকট, দিনের পর দিন অসহনীয় লোডশেডিং, তার আশু সমাধান সুপার কন্ডাক্টর বিদ্যুৎব্যবস্থায় মিলবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি, আসিয়ানের ওয়েবসাইট, চায়না ডেইলি, রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটস, নিক্কি এশিয়া, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ও এনএস এনার্জি
ভবিষ্যতের পৃথিবী সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
২০১৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করেছিল, তারা ২০৪০ সালের পর আর পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রি করবে না। সব পরিবহন হবে বিদ্যুচ্চালিত। এই উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিও চলছে। সারা দেশে এমন একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে, যার মাধ্যমে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি চলবে।
ব্রিটিশ সরকারের এই উদ্যোগে নিঃসন্দেহে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ব্রিটেনে ২০৩৫ সালের মধ্যে আরও ২৫ টেরাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হবে।
বিদ্যুতের চাহিদা শুধু ব্রিটেনেই বাড়ছে, তা নয়। সারা পৃথিবীতেই বাড়ছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৫০০ টেরাওয়াট-ঘণ্টা বেড়েছে। বিদ্যুতের এই চাহিদা ২০২৪ সাল পর্যন্ত গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদ্যুতের চাহিদা ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে। একই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ৫ শতাংশ বাড়বে।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়েছে চীনে। ২০২০ সালে সারা বিশ্বে বিদ্যুতের যত চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তার অর্ধেকই ছিল চীনে। প্রতিবছর এই চাহিদা আরও বাড়ছে। চীনে বর্তমানে প্রতি ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। ২০১৯ সালে চায়না ইলেকট্রিসিটি কাউন্সিল জানিয়েছিল, দেশটিতে প্রতিবছর বিদ্যুতের ব্যবহার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় ভারতে; বছরে প্রায় ১ দশমিক ৫৪ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি চার ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা স্পর্শ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) তাদের ২০২০ সালের ইলেকট্রিসিটি মার্কেট রিপোর্টে বলেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এয়ারকন্ডিশন বা এয়ারকুলারসহ বিদ্যুচ্চালিত অন্যান্য গৃহস্থালি যন্ত্রপাতির চাহিদা গত ২০ বছরে গড়ে ৬ শতাংশ করে বেড়েছে। এই অঞ্চলে বিদ্যুতের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় ব্যবহৃত মোট বিদ্যুতের মধ্যে দেশ চারটির বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার যথাক্রমে ২৬, ২২, ১৯ ও ১৫ শতাংশ।
বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান এই চাহিদা মেটানোর জন্য ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন কয়েক বছর আগে থেকেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে শুরু করেছে। তবে পরিবেশ বিপর্যয় বিবেচনায় নিয়ে ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর আইইএ এক কনফারেন্সে নতুন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফিলিপাইনের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। ফলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আর বাড়াতে পারছে না ফিলিপাইন।
কিন্তু বিকল্প কিছু তো ভাবতে হবে! সেটি কী? এশিয়ার ১০টি দেশের (ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম) সংগঠন ‘আসিয়ান’ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার নাম ‘আসিয়ান পাওয়ার গ্রিড’। এই প্রকল্পের আওতায় আসিয়ান ২০২৫ সালের মধ্যে ২৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে একীভূত করবে। এর জন্য দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুতের আন্তবাণিজ্য বাড়াতে হবে।
এরই মধ্যে আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের এক বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে লাওস, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পাওয়ার ইন্টিগ্রেশন প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে লাওস থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ স্থানান্তর করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরকেও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে।
আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছে আসিয়ান, যার নাম ‘আসিয়ান ইন্টারকানেকশন মাস্টার প্ল্যান স্টাডি’। ধারণা করা হচ্ছে, এই গবেষণা আসিয়ান পাওয়ার গ্রিডের কাজকে আরও সহজ করবে।
ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে। দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৩ শতাংশে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৩১ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে।
সিঙ্গাপুর হাঁটছে সৌর বিদ্যুতের পথে। দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে দেড় গিগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ২ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সিঙ্গাপুর বহুপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্যের সঙ্গেও জড়িত। দুটি ২৩০ কেভি এসি লাইনের মাধ্যমে দেশটি মালয়েশিয়া থেকে বিদ্যুৎ আনা-নেওয়া করে।
গত কয়েক দশক ধরে থাইল্যান্ডের বিদ্যুৎ খাত গ্যাসচালিত উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো গ্যাস থেকে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে শুরু করেছে থাইল্যান্ড। এখন জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়ুচালিত বিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুতের দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
এসব তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই চাহিদা কীভাবে মেটানো হবে—কয়লাভিত্তিক উৎপাদন দিয়ে, নাকি ডিজেলভিত্তিক উৎপাদন দিয়ে, নাকি অন্য কোনো উপায়ে, সেটি একটি বিবেচ্য বিষয় বটে। সেটি নিয়ে সারা বিশ্বে এখন তুমুল আলোচনা চলছে।
সেই আলোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছে সুপার কন্ডাক্টর। বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করবে সুপার কন্ডাক্টর। সেটি কেমন ব্যাপার? আমরা জানি সাধারণ ধাতুর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার সময় ইলেকট্রন একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এভাবে ধাক্কা খেতে খেতে তারা শক্তি হারায়। কিন্তু সুপার কন্ডাক্টরের মধ্যে ইলেকট্রন প্রবাহিত হওয়ার সময় কোনো শক্তি হারায় না।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সুপার কন্ডাক্টর ভবিষ্যতে পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থাকেই আমূল পাল্টে দেবে। জার্মানি ইতিমধ্যে তাদের বৈদ্যুতিক গ্রিডে সুপার কন্ডাক্টিং ইলেকট্রিসিটি ট্রান্সমিশন ক্যাবল ব্যবহার করতে শুরু করেছে। দেশটি ২০২০ সালে মিউনিখে ১২ কিলোমিটার সুপার কন্ডাক্টিং লাইন স্থাপন করেছে।
চীনা বিজ্ঞানীরাও বিশ্বের প্রথম সুপার কন্ডাক্টিং বিদ্যুৎ লাইনের প্রোটোটাইপ তৈরি করেছে। এটি চীনের জিনজিয়াং থেকে পূর্ব প্রদেশ পর্যন্ত ২ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। এ ছাড়া গত নভেম্বরে সাংহাইতে ৩৫ কিলোভোল্ট সম্পন্ন ১ দশমিক ২ কিলোমিটার সুপার কন্ডাক্টিং লাইন স্থাপন করেছে।
জাপানও সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ট্রান্সমিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করেছে। দেশটি মনে করছে, বিদ্যুচ্চালিত ট্রেন চালানোর জন্য এটি কম ব্যয়বহুল একটি উপায় হবে। জাপান রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিয়াজাকি প্রিফেকচার পরীক্ষামূলকভাবে দেড় কিলোমিটার সুপার কন্ডাক্টিং ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন করেছে।
সামনের দিনগুলোতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সুপার কন্ডাক্টিং ট্রান্সমিশন লাইনের দিকে ঝুঁকবে, তাতে সন্দেহ নেই। গ্লোবাল সুপার কন্ডাক্টরস মার্কেট রিপোর্ট ২০২২ বলছে, সুপার কন্ডাক্টরের বৈশ্বিক বাজার গত বছর ছিল ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর তা ২১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ৬ দশমিক ৫৪ বিলয়ন ডলার হয়েছে। ২০২৬ সাল নাগাদ এই বাজার ৯ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ৯ দশমিক ৫৪ বিলয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন যে বিদ্যুতের সংকট, দিনের পর দিন অসহনীয় লোডশেডিং, তার আশু সমাধান সুপার কন্ডাক্টর বিদ্যুৎব্যবস্থায় মিলবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি, আসিয়ানের ওয়েবসাইট, চায়না ডেইলি, রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটস, নিক্কি এশিয়া, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ও এনএস এনার্জি
ভবিষ্যতের পৃথিবী সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৬ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১৪ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে