অনলাইন ডেস্ক
চীনের শাসকেরা ভারতকে একটু ছোট নজরে দেখতে পছন্দ করেন। ভারতের অশান্ত রাজনীতি, সেকেলে অবকাঠামো আর দারিদ্র্যকে তাঁরা ঘৃণার চোখে দেখেন। অন্যদিকে ভারত ভয় আর ঈর্ষার সংমিশ্রণে সব সময় চীনাদের সমকক্ষ হওয়ার নিরর্থক আশা করে। তবে সীমান্তে রেখা টেনে বহু বছর ধরেই দেশ দুটি তেল আর জলের মতো শত্রুভাবাপন্ন হয়ে আছে। সীমান্তে সাম্প্রতিক রক্তপাত এই বৈরিতা বৃদ্ধিরই ইঙ্গিত দেয়। তা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি ভিন্ন গল্প বলে—যা আমেরিকা এবং তার মিত্রদের সমস্যায় ফেলতে পারে।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। এমনকি তিনি একবার চীনেও গিয়েছিলেন, সেই ১৯২৪ সালে। ইউরোপের বাইরে সাহিত্যে প্রথম নোবেল বিজয়ী হিসেবে সে সময় দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি ছিল ঠাকুরের। আশা করেছিলেন, এশিয়ার প্রাচীনতম দুটি সভ্যতার মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বন্ধন রচিত হবে। তবে চীনে গিয়ে ততটা সমাদর পাননি তিনি।
নেতৃস্থানীয় চীনা বুদ্ধিজীবীরা প্রাচ্যের মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিক পুনরুজ্জীবনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানকে ততটা গুরুত্ব দেননি। তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষাকে তাচ্ছিল্য করে সে সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা চেন দুক্সিউ মত দিয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক শক্তির গোড়ালির নিচে পড়ে থাকতে না চাইলে চীনের তরুণদের ‘ভারতীয়করণ’ হওয়া উচিত নয়।
প্রায় এক শতাব্দী পরও ভারত সম্পর্কে চীনা কর্মকর্তা এবং পণ্ডিতদের ঘৃণার অনুভূতি রয়ে গেছে। চীনের জেনারেলদের মাঝেও ভারতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা আছে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে বিজয়কে তাঁরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। চীনের একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্সের সিনিয়র কর্নেল ঝাও জিয়াওঝুও বলেন, আগামী ২০-৩০ বছরেও চীনের সঙ্গে ভারতের হাত ধরার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবুও চীন-ভারত সম্পর্কের মৌলিক বিষয়গুলো—বিশেষ করে, সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বর্তমানে এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যে—দেশ দুটি একে অপরের সঙ্গে এবং বাকি বিশ্বের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবে তা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা ও তার মিত্রদের মধ্যে আশার বিষয় হলো, চীনের সঙ্গে ভারতের অব্যাহত সীমান্ত সংঘাতের বিষয়টি। এই সংঘাত ভারতকে বরাবরের মতোই একটি গণতান্ত্রিক জোটে ঠেলে দিচ্ছে, যে জোট চীনা শক্তিকে খর্ব করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, যদি ভারত ও চীন সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার কোনো উপায় খুঁজে পায়, তাহলে?
এ বিষয়ে প্রথমে সামরিক সমীকরণটি বিবেচনা করলে দেখা যায়—২০০৮ সালে একটি বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি করার পর থেকে ভারত আমেরিকার কাছাকাছি আসতে শুরু করে। চীনের সঙ্গে সীমান্তে একাধিক সংঘর্ষ ভারত-আমেরিকার মেলবন্ধনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। ২০২০ সালে এ ধরনের একটি সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং কমপক্ষে চারজন চীনা সেনা নিহত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের পর এটিই ছিল দেশ দুটির মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এর ফলে দুই দেশের সীমান্তে তিন দশক ধরে যে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছিল, তার অবসান ঘটে।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনী তখন থেকেই শুধু পাকিস্তানের দিকে মনোযোগ না দিয়ে চীনকে মোকাবিলার বিষয়টিও আমলে নেয়। তারা চীন সীমান্তে প্রায় ৭০ হাজার সেনার পাশাপাশি ফাইটার জেট এবং ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল স্থানান্তর করেছে। তারা আমেরিকা ও তার মিত্র বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে প্রায়ই যৌথ সামরিক মহড়া করছে।
এদিকে ভারতীয় কমান্ডাররা রাশিয়ার অস্ত্রের ওপর তাদের নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারত আমেরিকার উন্নত অস্ত্র কিনতে চায় এবং নিজেরাও তৈরি করতে চায়। এ লক্ষ্যে গত জুনে আমেরিকা সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সশস্ত্র ড্রোন কেনা এবং ভারতে যৌথভাবে ফাইটার জেট ইঞ্জিন তৈরির চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি করেছেন।
তবে এসব ক্ষেত্রেও চীনের মনোভাবটি হলো, ভারতের সঙ্গে তারা খেলতে আগ্রহী নয়, বরং অন্য কোনো লীগে তারা সরাসরি আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দান কমান্ডের সাবেক প্রধান দীপেন্দ্র সিং হুডার মতে, চীন ভারতকে একটি ‘পার্শ্বচরিত্র’ হিসেবে দেখে।
আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা চীনের শক্তিকে সীমাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা যত বাড়াচ্ছে, চীনের নেতা সি চিনপিং ভারত সীমান্ত স্থিতিশীল করার জন্য তত মনোযোগী হচ্ছেন। সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে ঝামেলা এড়াতে চান মোদিও। এ অবস্থায় সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চীনের আপস সম্ভব বলে মনে হচ্ছে। সামরিক কমান্ডারদের ১৮ দফা আলোচনার পর দুই দেশের সেনারা পাঁচটি সীমান্ত প্রান্ত থেকে ফিরে গেছে এবং ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠা করেছে—যেখানে উভয় পক্ষের কোনো টহল নেই। তবে দুটি প্রধান সীমান্ত প্রান্তে দুই দেশই সেনা মোতায়েন করে রেখেছে।
এ অবস্থায় চীন আরেক দফা আলোচনার জন্য ভারতকে চাপ দিচ্ছে এবং অনুরোধ করছে যেন সীমান্ত সমস্যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব না ফেলে। গত ১৪ জুলাই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় সমপর্যায়ের চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সীমান্ত নিয়ে আলোচনা করেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন, একটি শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সীমান্ত ছাড়া দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করা যাবে না।
আধুনিক ইতিহাসের আলোকে চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যকে নগণ্যই বলা চলে। কিন্তু ২০২০ সাল নাগাদ দুই দেশের পণ্য বাণিজ্য ৮৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সে বছরের বাণিজ্যে চীন ৪৬ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত উপভোগ করেছে এবং ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে স্থান পেয়েছে। বিনিয়োগের জন্য একটি বড় উৎস এখন চীন। বিশেষ করে প্রযুক্তি, সম্পত্তি এবং অবকাঠামোতে। চীনা ব্র্যান্ডগুলোও ভারতে বেশ জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছে। ভারতের বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া মোবাইল ফোনের মধ্যে চীনা ব্র্যান্ডের অপ্পো এবং শাওমি অন্যতম।
তবে ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষ এই বাণিজ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। সংঘর্ষের জের ধরে ভারত প্রায় ৩২০টি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে, বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানির ওপর কর অভিযান শুরু করেছে এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য ভারত সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন বলে নতুন নিয়ম চালু করেছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা ১৫৭টি আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপরও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২১ সালে ৪৩ শতাংশ এবং গত বছর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা বিনিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের মাধ্যমেও ভারতীয় বাজারে আসার পথ খুঁজে নিচ্ছে। ২০২০ সালে ভারত সরকার ‘শিন’ নামে একটি চীনা অনলাইন ফ্যাশন সংস্থার অ্যাপ নিষিদ্ধ করলেও প্রতিষ্ঠানটি ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে আবারও চালু হতে যাচ্ছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা চীনা পণ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে চান। যদিও ভারতের অনেক ব্যবসায়ী নেতা মনে করেন, সরকার অবকাঠামো এবং উৎপাদনের উন্নয়নে তার লক্ষ্যগুলো অর্জন করলেও আরও কয়েক বছর চীনা পণ্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ওষুধশিল্প তার ৭০ শতাংশ সক্রিয় উপাদানের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করে।
চীনা কোম্পানিগুলো জনসংখ্যায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া ভারতকে আয় বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে দেখে। গোল্ডম্যান স্যাশ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ২০৭৫ সালে চীনের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে ভারতীয় জিডিপি।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও দুই দেশের কিছু অর্থনৈতিক সমন্বয় রয়েছে। ভারত বেইজিং-ভিত্তিক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা। ২০১৫ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এক হয়ে সাংহাই-ভিত্তিক নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ‘ব্রিকস’ প্রতিষ্ঠা করে।
তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক যে সীমান্তে রক্তপাত বন্ধ করে দেবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এ নিয়ে যুদ্ধও বেধে যেতে পারে। উভয় দেশই এমন নেতারা পরিচালনা করছেন যাঁরা তীব্র জাতীয়তাবাদকে ধারণ করেন। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব, ভারতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নদীগুলোর উজানে চীনের বাঁধ দেওয়া এবং ভারতে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কিছু বিষয় দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
তারপরও ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক সম্পর্কের ফলে উভয় পক্ষ সহযোগিতার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে দিতে পারে। ১৯৮৮ সালে যেমনটি করেছিলেন রাজীব গান্ধী। সে বছর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি চীন সফর করার পরই টানা তিন দশক সীমান্ত সমস্যা স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল।
আরেকটি বিষয় হলো—উভয় দেশই বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় একটি বড় ভূমিকা চায়। মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পশ্চিমা সমালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করতে এবং ইসলামি চরমপন্থা নিয়ে উদ্বেগ তারা ভাগ করে নিতে চায়। সম্প্রতি উভয়ই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করতে অস্বীকার করেছে।
এ ছাড়া লক্ষণীয় যে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার আগে মোদি ও সি চিনপিংকে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হয়েছিল। ২০১৪ সালে সি চিনপিংকে মোদি তাঁর নিজ রাজ্য গুজরাটে আতিথেয়তা করার অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরের বছর চীন সফরে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, ‘ভারত এবং চীন একই রকম আকাঙ্ক্ষা, চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ ভাগ করে নিয়েছে।’
মোদি আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ের বৈশ্বিক অনিশ্চয়তায়, আমরা একে অপরের অগ্রগতিকে শক্তিশালী করতে পারি।’
এ ধরনের বাতচিত ও সম্ভাবনায় আমেরিকা এবং তার মিত্ররা যে খুশি হবে না, তা সহজেই বলে দেওয়া যায়। তবে এসব বিষয় এশিয়ার পরাশক্তিদের মধ্যে একটি টেকসই, পারস্পরিক উপকারী সম্পর্কের দিকে আরও বাস্তবসম্মত পথ হতে পারে।
দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে পরাগ মাঝি
চীনের শাসকেরা ভারতকে একটু ছোট নজরে দেখতে পছন্দ করেন। ভারতের অশান্ত রাজনীতি, সেকেলে অবকাঠামো আর দারিদ্র্যকে তাঁরা ঘৃণার চোখে দেখেন। অন্যদিকে ভারত ভয় আর ঈর্ষার সংমিশ্রণে সব সময় চীনাদের সমকক্ষ হওয়ার নিরর্থক আশা করে। তবে সীমান্তে রেখা টেনে বহু বছর ধরেই দেশ দুটি তেল আর জলের মতো শত্রুভাবাপন্ন হয়ে আছে। সীমান্তে সাম্প্রতিক রক্তপাত এই বৈরিতা বৃদ্ধিরই ইঙ্গিত দেয়। তা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি ভিন্ন গল্প বলে—যা আমেরিকা এবং তার মিত্রদের সমস্যায় ফেলতে পারে।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। এমনকি তিনি একবার চীনেও গিয়েছিলেন, সেই ১৯২৪ সালে। ইউরোপের বাইরে সাহিত্যে প্রথম নোবেল বিজয়ী হিসেবে সে সময় দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি ছিল ঠাকুরের। আশা করেছিলেন, এশিয়ার প্রাচীনতম দুটি সভ্যতার মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বন্ধন রচিত হবে। তবে চীনে গিয়ে ততটা সমাদর পাননি তিনি।
নেতৃস্থানীয় চীনা বুদ্ধিজীবীরা প্রাচ্যের মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিক পুনরুজ্জীবনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানকে ততটা গুরুত্ব দেননি। তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষাকে তাচ্ছিল্য করে সে সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা চেন দুক্সিউ মত দিয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক শক্তির গোড়ালির নিচে পড়ে থাকতে না চাইলে চীনের তরুণদের ‘ভারতীয়করণ’ হওয়া উচিত নয়।
প্রায় এক শতাব্দী পরও ভারত সম্পর্কে চীনা কর্মকর্তা এবং পণ্ডিতদের ঘৃণার অনুভূতি রয়ে গেছে। চীনের জেনারেলদের মাঝেও ভারতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা আছে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে বিজয়কে তাঁরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। চীনের একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্সের সিনিয়র কর্নেল ঝাও জিয়াওঝুও বলেন, আগামী ২০-৩০ বছরেও চীনের সঙ্গে ভারতের হাত ধরার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবুও চীন-ভারত সম্পর্কের মৌলিক বিষয়গুলো—বিশেষ করে, সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বর্তমানে এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যে—দেশ দুটি একে অপরের সঙ্গে এবং বাকি বিশ্বের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবে তা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা ও তার মিত্রদের মধ্যে আশার বিষয় হলো, চীনের সঙ্গে ভারতের অব্যাহত সীমান্ত সংঘাতের বিষয়টি। এই সংঘাত ভারতকে বরাবরের মতোই একটি গণতান্ত্রিক জোটে ঠেলে দিচ্ছে, যে জোট চীনা শক্তিকে খর্ব করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, যদি ভারত ও চীন সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার কোনো উপায় খুঁজে পায়, তাহলে?
এ বিষয়ে প্রথমে সামরিক সমীকরণটি বিবেচনা করলে দেখা যায়—২০০৮ সালে একটি বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি করার পর থেকে ভারত আমেরিকার কাছাকাছি আসতে শুরু করে। চীনের সঙ্গে সীমান্তে একাধিক সংঘর্ষ ভারত-আমেরিকার মেলবন্ধনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। ২০২০ সালে এ ধরনের একটি সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং কমপক্ষে চারজন চীনা সেনা নিহত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের পর এটিই ছিল দেশ দুটির মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এর ফলে দুই দেশের সীমান্তে তিন দশক ধরে যে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছিল, তার অবসান ঘটে।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনী তখন থেকেই শুধু পাকিস্তানের দিকে মনোযোগ না দিয়ে চীনকে মোকাবিলার বিষয়টিও আমলে নেয়। তারা চীন সীমান্তে প্রায় ৭০ হাজার সেনার পাশাপাশি ফাইটার জেট এবং ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল স্থানান্তর করেছে। তারা আমেরিকা ও তার মিত্র বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে প্রায়ই যৌথ সামরিক মহড়া করছে।
এদিকে ভারতীয় কমান্ডাররা রাশিয়ার অস্ত্রের ওপর তাদের নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারত আমেরিকার উন্নত অস্ত্র কিনতে চায় এবং নিজেরাও তৈরি করতে চায়। এ লক্ষ্যে গত জুনে আমেরিকা সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সশস্ত্র ড্রোন কেনা এবং ভারতে যৌথভাবে ফাইটার জেট ইঞ্জিন তৈরির চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি করেছেন।
তবে এসব ক্ষেত্রেও চীনের মনোভাবটি হলো, ভারতের সঙ্গে তারা খেলতে আগ্রহী নয়, বরং অন্য কোনো লীগে তারা সরাসরি আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দান কমান্ডের সাবেক প্রধান দীপেন্দ্র সিং হুডার মতে, চীন ভারতকে একটি ‘পার্শ্বচরিত্র’ হিসেবে দেখে।
আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা চীনের শক্তিকে সীমাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা যত বাড়াচ্ছে, চীনের নেতা সি চিনপিং ভারত সীমান্ত স্থিতিশীল করার জন্য তত মনোযোগী হচ্ছেন। সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে ঝামেলা এড়াতে চান মোদিও। এ অবস্থায় সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চীনের আপস সম্ভব বলে মনে হচ্ছে। সামরিক কমান্ডারদের ১৮ দফা আলোচনার পর দুই দেশের সেনারা পাঁচটি সীমান্ত প্রান্ত থেকে ফিরে গেছে এবং ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠা করেছে—যেখানে উভয় পক্ষের কোনো টহল নেই। তবে দুটি প্রধান সীমান্ত প্রান্তে দুই দেশই সেনা মোতায়েন করে রেখেছে।
এ অবস্থায় চীন আরেক দফা আলোচনার জন্য ভারতকে চাপ দিচ্ছে এবং অনুরোধ করছে যেন সীমান্ত সমস্যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব না ফেলে। গত ১৪ জুলাই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় সমপর্যায়ের চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সীমান্ত নিয়ে আলোচনা করেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন, একটি শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সীমান্ত ছাড়া দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করা যাবে না।
আধুনিক ইতিহাসের আলোকে চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যকে নগণ্যই বলা চলে। কিন্তু ২০২০ সাল নাগাদ দুই দেশের পণ্য বাণিজ্য ৮৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সে বছরের বাণিজ্যে চীন ৪৬ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত উপভোগ করেছে এবং ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে স্থান পেয়েছে। বিনিয়োগের জন্য একটি বড় উৎস এখন চীন। বিশেষ করে প্রযুক্তি, সম্পত্তি এবং অবকাঠামোতে। চীনা ব্র্যান্ডগুলোও ভারতে বেশ জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছে। ভারতের বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া মোবাইল ফোনের মধ্যে চীনা ব্র্যান্ডের অপ্পো এবং শাওমি অন্যতম।
তবে ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষ এই বাণিজ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। সংঘর্ষের জের ধরে ভারত প্রায় ৩২০টি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে, বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানির ওপর কর অভিযান শুরু করেছে এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য ভারত সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন বলে নতুন নিয়ম চালু করেছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা ১৫৭টি আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপরও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২১ সালে ৪৩ শতাংশ এবং গত বছর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা বিনিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের মাধ্যমেও ভারতীয় বাজারে আসার পথ খুঁজে নিচ্ছে। ২০২০ সালে ভারত সরকার ‘শিন’ নামে একটি চীনা অনলাইন ফ্যাশন সংস্থার অ্যাপ নিষিদ্ধ করলেও প্রতিষ্ঠানটি ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে আবারও চালু হতে যাচ্ছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা চীনা পণ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে চান। যদিও ভারতের অনেক ব্যবসায়ী নেতা মনে করেন, সরকার অবকাঠামো এবং উৎপাদনের উন্নয়নে তার লক্ষ্যগুলো অর্জন করলেও আরও কয়েক বছর চীনা পণ্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ওষুধশিল্প তার ৭০ শতাংশ সক্রিয় উপাদানের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করে।
চীনা কোম্পানিগুলো জনসংখ্যায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া ভারতকে আয় বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে দেখে। গোল্ডম্যান স্যাশ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ২০৭৫ সালে চীনের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে ভারতীয় জিডিপি।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও দুই দেশের কিছু অর্থনৈতিক সমন্বয় রয়েছে। ভারত বেইজিং-ভিত্তিক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা। ২০১৫ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এক হয়ে সাংহাই-ভিত্তিক নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ‘ব্রিকস’ প্রতিষ্ঠা করে।
তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক যে সীমান্তে রক্তপাত বন্ধ করে দেবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এ নিয়ে যুদ্ধও বেধে যেতে পারে। উভয় দেশই এমন নেতারা পরিচালনা করছেন যাঁরা তীব্র জাতীয়তাবাদকে ধারণ করেন। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব, ভারতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নদীগুলোর উজানে চীনের বাঁধ দেওয়া এবং ভারতে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কিছু বিষয় দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
তারপরও ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক সম্পর্কের ফলে উভয় পক্ষ সহযোগিতার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে দিতে পারে। ১৯৮৮ সালে যেমনটি করেছিলেন রাজীব গান্ধী। সে বছর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি চীন সফর করার পরই টানা তিন দশক সীমান্ত সমস্যা স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল।
আরেকটি বিষয় হলো—উভয় দেশই বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় একটি বড় ভূমিকা চায়। মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পশ্চিমা সমালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করতে এবং ইসলামি চরমপন্থা নিয়ে উদ্বেগ তারা ভাগ করে নিতে চায়। সম্প্রতি উভয়ই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করতে অস্বীকার করেছে।
এ ছাড়া লক্ষণীয় যে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার আগে মোদি ও সি চিনপিংকে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হয়েছিল। ২০১৪ সালে সি চিনপিংকে মোদি তাঁর নিজ রাজ্য গুজরাটে আতিথেয়তা করার অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরের বছর চীন সফরে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, ‘ভারত এবং চীন একই রকম আকাঙ্ক্ষা, চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ ভাগ করে নিয়েছে।’
মোদি আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ের বৈশ্বিক অনিশ্চয়তায়, আমরা একে অপরের অগ্রগতিকে শক্তিশালী করতে পারি।’
এ ধরনের বাতচিত ও সম্ভাবনায় আমেরিকা এবং তার মিত্ররা যে খুশি হবে না, তা সহজেই বলে দেওয়া যায়। তবে এসব বিষয় এশিয়ার পরাশক্তিদের মধ্যে একটি টেকসই, পারস্পরিক উপকারী সম্পর্কের দিকে আরও বাস্তবসম্মত পথ হতে পারে।
দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে পরাগ মাঝি
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১ দিন আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১ দিন আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৩ দিন আগে