ফজলুল কবির
আফগানিস্তানে তালেবান আবার ক্ষমতায় এসেছে। এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। সারা বিশ্ব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে এখন আফগানিস্তানের দিকে। তরুণ প্রজন্ম যদি তালেবানের উৎস ও বিস্তার নিয়ে উৎসুক, তবে একটু বয়সীরা আগ্রহী তাদের এই মেয়াদের শাসন দেখার জন্য।
তালেবানের উৎস মূলত মুজাহিদীনদের কোলে। প্রযোজনা যদি কেউ করে থাকে, তবে তার নাম যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর আফগানিস্তানে তার প্রতিরোধে গড়ে ওঠে মুজাহিদীন বাহিনী। স্নায়ুযুদ্ধের সে সময়ে মুজাহিদীনরা স্বাভাবিকভাবেই পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য। অকৃত্রিম মিত্র পাকিস্তানের মাধ্যমে মুজাহিদীনদের কাছে নানা ধরনের সহযোগিতা তারা পৌঁছে দিয়েছে। হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে মুজাহিদীন। আশ্রয় হিসেবে পাশে পেয়েছে পাকিস্তানকে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে পটপরিবর্তনের ঠিক আগে আগে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ছাড়ে রুশ বাহিনী। দীর্ঘদিন পর আফগানরা নিজেদের ক্ষমতা নিজেদের হাতে পায়। ক্ষমতায় বসে মুজাহিদীনেরা। আর এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেই একটু একটু করে জন্ম নেয় তালেবান গোষ্ঠী। পশতুন ভাষায় যার আক্ষরিক অর্থ ‘ছাত্র’।
কীসের ছাত্র? পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে পাস করা তরুণেরাই এই গোষ্ঠীতে এসে যোগ দেয়। গোষ্ঠীটির আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে একজনের নাম করলে বলতে হয় মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নাম। কান্দাহারের এই ইমামের নেতৃত্বেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের একটি ছোট দল সংগঠিত হয় তালেবান নামে। এই সংগঠিত তরুণেরা মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি ও মুজাহিদীন নেতৃত্বের কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ ছিল।
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে সংগঠিত তালেবানকে তখন আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে সৌদি আরব। সৌদি অর্থায়নে আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমে কট্টর সুন্নি মতবাদ ছড়ানো হয় সেখানকার স্থানীয় বিভিন্ন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে। পশতুন এলাকায় ইসলামি শাসনের মাধ্যমে তারা শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নতুন দেশের চিত্র আঁকে।
ক্রমে তাদের সংগঠন বিস্তৃত হতে থাকে। আফগানিস্তানের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে তাদের সাংগঠনিক প্রসার ঘটে। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তারা ইরানের সীমান্তলগ্ন হেরাত প্রদেশ দখলে নেয়। এর ঠিক এক বছরের মাথায় তারা প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রব্বানির প্রশাসনকে উৎখাত করে রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। বোরহানউদ্দিন রব্বানি ছিলেন সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদীন প্রতিরোধের অন্যতম নেতা। ১৯৯৮ সাল নাগাদ তারা আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়।
এই তালেবানের গড়ে ওঠার পেছনে ছিল মার্কিন ব্লকের স্বার্থ। মধ্যপ্রাচ্যে মুখ্য মার্কিন মিত্র ও ইসরায়েলের দুধ–ভাই সৌদি আরব এতে সরাসরি অংশ নেয়। তার অবশ্য মার্কিন স্বার্থ রক্ষা ছাড়াও নিজস্ব কিছু লক্ষ্য ছিল। প্রধান লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই ইরানকে চাপে রাখা। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি–ইরান দ্বৈরথ নতুন নয়। ফলে তারা ইরানের নাকের ডগায় কট্টর সুন্নি একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন চেয়েছিল। মার্কিন স্বার্থটি আগেই বলা হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ থেকে উদ্ভূত। পাকিস্তান এতে মার্কিন ঘুঁটি হিসেবেই কাজ করেছে। সোভিয়েত ব্লকে থাকা ভারতের বিপরীত অবস্থানে তার সুদৃঢ় অবস্থান অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ, তত দিনে জন্ম থেকে শত্রুতায় জড়িয়ে পড়া ভারতের সঙ্গে দেশটি বড় দুটি যুদ্ধ করে ফেলেছে। আর ১৯৭১ সালের যুদ্ধ তো তার কাছে এক বিরাট ক্ষত হয়েই ছিল।
এদিকে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ মুজাহিদীনদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতায় জেরবার হয়ে পড়েছিল। তারা চাইছিল যেকোনোভাবে এ থেকে মুক্তি পেতে। ফলে এই দৃশ্যে তালেবান হাজির হলে, তাদের স্বাগত জানায় মানুষ। দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা পরে নিজেদের জনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু ক্রমে এই জনপ্রিয়তায় ছেদ পড়ল, তাদের অনুসৃত কঠোর আইনের কারণে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরসহ চুরি করলে হাত কেটে দেওয়ার মতো শাস্তি স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কার পরিবেশ তৈরি করে।
তালেবান শাসন সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়, নারী অধিকার সংকোচনের কারণে। ১০ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় তারা। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীদের পথে বের হওয়া থেকে শুরু করে তাদের চাকরি বা যেকোনো কাজে যোগ দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়ে। সঙ্গে সংগীত, সিনেমা তো বটেই টেলিভিশনও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে নাগরিক পরিসরে তথ্যের প্রবাহ ও নাগরিক অধিকারের পর্যায়টি সহজেই অনুমেয়।
সামনে কী?
তালেবানকে সাধারণত দেওবন্দ ঘরানার ইসলামের অনুসারী হিসেবে বর্ণনা করা হলেও তা একটি পর্যায় পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তারা ক্রমে ইসলামি আইনের নামে পশতুন গোষ্ঠীর কিছু নিয়ম এর সঙ্গে একীভূত করে নেয়। আর এই পশতুনদের নিজস্ব নিয়ম সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই নারীদের জীবন একেবারে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। সঙ্গে ইসলামি ব্লাসফেমি আইন।
কথা হলো তালেবান কি তাদের এই আগের অবস্থান জারি রাখবে এবার? কেউ কেউ বেশ আশা দেখছেন, আগের চেয়ে পরিণত ও বিবেচনাসম্পন্ন তালেবান শাসন দেখার। আবার অনেকেই এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। এর পক্ষে তারা যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছেন—নারী অধিকারের প্রতি সম্মানের কথা বললেও তারা এরই মধ্যে এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আশাবাদী হতে বাধা দেয়। আবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র বলছে, প্রভাবশালী নারী, রাজনীতিক, তালেবান বিরোধীদের বাড়ির সামনে এরই মধ্যে রক্ষী বসিয়েছে তারা। ফলে নিজস্ব বিচার পদ্ধতি মেনে হোক বা না হোক মৃত্যুদণ্ডের নামে হত্যার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রথম মেয়াদে তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল, সেই সময়ে ২০০০ সালে আহমেদ রশিদের লেখা বই ‘তালেবান’–এ তিনি গোষ্ঠীটির মূল সংকট হিসেবে লিখেছিলেন—‘তাদের শাসন পদ্ধতি ও প্রশাসনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তারা পশতুন সমাজ ও সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করতে চাইলেও পারছে না। আবার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে চাইলেও পারছে না।’
এ দুইয়ের মধ্যে আটকে পড়া তালেবান কখনো সেভাবে রাজনীতি নিয়ে ভাবেনি, যতটা ভেবেছে সামরিক বিষয়াদি নিয়ে। ফলে বিস্তৃত পরিসরে একটি জাতিকে পরিচালনা বা শাসনের কৌশল কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে তারা বরাবরই সংশয়ে ছিল। আর এই সংশয় থেকেই তারা যেকোনো সংকটে সামরিক সমাধানটিকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
কথা হলো মার্কিন আগ্রাসনের এই সময়ে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার সময় তারা কি নিজেদের বদলেছে? ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার পর প্রতিষ্ঠিত কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টার’সের বার্ষিকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালের পর থেকে তালেবান বিভিন্ন ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। পশতুন এলাকার বাইরে নিজেদের সংগঠন বিস্তার করেছে। আর এই সময়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে—তারা প্রতিনিয়ত শিখছে। তারা বুঝতে শিখেছে যে, তাদের নিপীড়নমূলক আচরণ গোটা বিশ্ব থেকে তাদের একঘরে করে দিয়েছিল। এই একই অবস্থান বহু আফগানকেও তাদের বিপক্ষে নিয়ে গেছে, যারা সেই ১৯৯০–এর দশকে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সময়ে আশ্রয় দিয়েছিল, ক্ষমতার শুরুতে তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। এ বিষয়ে তাদের সচেতনতা বেড়েছে। বিশেষত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাদের কিছু উদার মনোভাব এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গে চীনের সঙ্গে তাদের সংযোগ আশা দেখাচ্ছে। চীন তার নাকের ডগায় কোনো অস্থিতিশীলতা চাইবে না—আগেই বলা হয়েছে।
কিন্তু তারপরও সামরিক সমাধান খোঁজা একটি গোষ্ঠী ২০ বছরের ব্যবধানে ক্ষমতায় এসে কতটা ভিন্ন শাসন দেবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তালেবান অন্য ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো থেকে একটু আলাদা এখানে যে, তাদের কোনো রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন নেই। তবে এখন তাদের এমন একটি অঙ্গের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। দোহায় আলোচনার জন্য তাদের প্রতিনিধিকে রাজনীতিক বলা ছাড়া তো উপায় নেই। কিন্তু মুশকিল হলো শাসন তো সংকট সমাধানের মতো তাৎক্ষণিক কোনো বিষয় নয়। উপরন্তু প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রবেশের পর তাদের সদস্যরা যেভাবে আফগানিস্তানের পতাকা অপসারণ করেছে, তা অন্য ইঙ্গিত দেয়। প্রতিটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তারা বিভিন্ন সরকারি ভবনে নিজেদের আলাদা পতাকা তুলেছে। আফগানিস্তান বলার বদলে তারা ইসলামি আমিরাত অব আফগানিস্তানই বলছে। ফলে এবারের শাসন আলাদা হবে বলে, যারা বড় স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা আবার হতাশ হতে পারেন।
এতে মুশকিল যতটা যা হওয়ার, তা আঞ্চলিক। বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় তালেবান ক্ষমতার বড় প্রভাব পড়বে। বিশেষত কট্টর সুন্নি গোষ্ঠীগুলো শক্তির উৎস হিসেবে দেখবে তালেবানকে, যা বাংলাদেশকেও ভাবাচ্ছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে ইরান ও ভারত। ইরান শিয়াদের নিয়ে তালেবানদের অবস্থানের কারণে। আর ভারত কাশ্মীর–লাদাখ সীমান্তে ত্রয়ীর বিরুদ্ধে লড়ার সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন। সঙ্গে দেশটির ক্ষমতায় বিজেপির ক্ষমতায় থাকাও এখন বিষয়টিকে কিছুটা জটিল করে তুলবে। এই অঞ্চলে এমন চতুর্মুখী কোনো দ্বৈরথ হলে তা তিনটি পরমাণু শক্তিধর দেশকে জড়াবে, যা গোটা অঞ্চলের জন্যই বড় উদ্বেগের।
আফগানিস্তানে তালেবান আবার ক্ষমতায় এসেছে। এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। সারা বিশ্ব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে এখন আফগানিস্তানের দিকে। তরুণ প্রজন্ম যদি তালেবানের উৎস ও বিস্তার নিয়ে উৎসুক, তবে একটু বয়সীরা আগ্রহী তাদের এই মেয়াদের শাসন দেখার জন্য।
তালেবানের উৎস মূলত মুজাহিদীনদের কোলে। প্রযোজনা যদি কেউ করে থাকে, তবে তার নাম যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর আফগানিস্তানে তার প্রতিরোধে গড়ে ওঠে মুজাহিদীন বাহিনী। স্নায়ুযুদ্ধের সে সময়ে মুজাহিদীনরা স্বাভাবিকভাবেই পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য। অকৃত্রিম মিত্র পাকিস্তানের মাধ্যমে মুজাহিদীনদের কাছে নানা ধরনের সহযোগিতা তারা পৌঁছে দিয়েছে। হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে মুজাহিদীন। আশ্রয় হিসেবে পাশে পেয়েছে পাকিস্তানকে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে পটপরিবর্তনের ঠিক আগে আগে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ছাড়ে রুশ বাহিনী। দীর্ঘদিন পর আফগানরা নিজেদের ক্ষমতা নিজেদের হাতে পায়। ক্ষমতায় বসে মুজাহিদীনেরা। আর এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেই একটু একটু করে জন্ম নেয় তালেবান গোষ্ঠী। পশতুন ভাষায় যার আক্ষরিক অর্থ ‘ছাত্র’।
কীসের ছাত্র? পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে পাস করা তরুণেরাই এই গোষ্ঠীতে এসে যোগ দেয়। গোষ্ঠীটির আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে একজনের নাম করলে বলতে হয় মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নাম। কান্দাহারের এই ইমামের নেতৃত্বেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের একটি ছোট দল সংগঠিত হয় তালেবান নামে। এই সংগঠিত তরুণেরা মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি ও মুজাহিদীন নেতৃত্বের কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ ছিল।
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে সংগঠিত তালেবানকে তখন আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে সৌদি আরব। সৌদি অর্থায়নে আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমে কট্টর সুন্নি মতবাদ ছড়ানো হয় সেখানকার স্থানীয় বিভিন্ন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে। পশতুন এলাকায় ইসলামি শাসনের মাধ্যমে তারা শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নতুন দেশের চিত্র আঁকে।
ক্রমে তাদের সংগঠন বিস্তৃত হতে থাকে। আফগানিস্তানের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে তাদের সাংগঠনিক প্রসার ঘটে। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তারা ইরানের সীমান্তলগ্ন হেরাত প্রদেশ দখলে নেয়। এর ঠিক এক বছরের মাথায় তারা প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রব্বানির প্রশাসনকে উৎখাত করে রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। বোরহানউদ্দিন রব্বানি ছিলেন সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদীন প্রতিরোধের অন্যতম নেতা। ১৯৯৮ সাল নাগাদ তারা আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়।
এই তালেবানের গড়ে ওঠার পেছনে ছিল মার্কিন ব্লকের স্বার্থ। মধ্যপ্রাচ্যে মুখ্য মার্কিন মিত্র ও ইসরায়েলের দুধ–ভাই সৌদি আরব এতে সরাসরি অংশ নেয়। তার অবশ্য মার্কিন স্বার্থ রক্ষা ছাড়াও নিজস্ব কিছু লক্ষ্য ছিল। প্রধান লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই ইরানকে চাপে রাখা। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি–ইরান দ্বৈরথ নতুন নয়। ফলে তারা ইরানের নাকের ডগায় কট্টর সুন্নি একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন চেয়েছিল। মার্কিন স্বার্থটি আগেই বলা হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ থেকে উদ্ভূত। পাকিস্তান এতে মার্কিন ঘুঁটি হিসেবেই কাজ করেছে। সোভিয়েত ব্লকে থাকা ভারতের বিপরীত অবস্থানে তার সুদৃঢ় অবস্থান অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ, তত দিনে জন্ম থেকে শত্রুতায় জড়িয়ে পড়া ভারতের সঙ্গে দেশটি বড় দুটি যুদ্ধ করে ফেলেছে। আর ১৯৭১ সালের যুদ্ধ তো তার কাছে এক বিরাট ক্ষত হয়েই ছিল।
এদিকে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ মুজাহিদীনদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতায় জেরবার হয়ে পড়েছিল। তারা চাইছিল যেকোনোভাবে এ থেকে মুক্তি পেতে। ফলে এই দৃশ্যে তালেবান হাজির হলে, তাদের স্বাগত জানায় মানুষ। দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা পরে নিজেদের জনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু ক্রমে এই জনপ্রিয়তায় ছেদ পড়ল, তাদের অনুসৃত কঠোর আইনের কারণে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরসহ চুরি করলে হাত কেটে দেওয়ার মতো শাস্তি স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কার পরিবেশ তৈরি করে।
তালেবান শাসন সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়, নারী অধিকার সংকোচনের কারণে। ১০ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় তারা। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীদের পথে বের হওয়া থেকে শুরু করে তাদের চাকরি বা যেকোনো কাজে যোগ দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়ে। সঙ্গে সংগীত, সিনেমা তো বটেই টেলিভিশনও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে নাগরিক পরিসরে তথ্যের প্রবাহ ও নাগরিক অধিকারের পর্যায়টি সহজেই অনুমেয়।
সামনে কী?
তালেবানকে সাধারণত দেওবন্দ ঘরানার ইসলামের অনুসারী হিসেবে বর্ণনা করা হলেও তা একটি পর্যায় পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তারা ক্রমে ইসলামি আইনের নামে পশতুন গোষ্ঠীর কিছু নিয়ম এর সঙ্গে একীভূত করে নেয়। আর এই পশতুনদের নিজস্ব নিয়ম সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই নারীদের জীবন একেবারে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। সঙ্গে ইসলামি ব্লাসফেমি আইন।
কথা হলো তালেবান কি তাদের এই আগের অবস্থান জারি রাখবে এবার? কেউ কেউ বেশ আশা দেখছেন, আগের চেয়ে পরিণত ও বিবেচনাসম্পন্ন তালেবান শাসন দেখার। আবার অনেকেই এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। এর পক্ষে তারা যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছেন—নারী অধিকারের প্রতি সম্মানের কথা বললেও তারা এরই মধ্যে এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আশাবাদী হতে বাধা দেয়। আবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র বলছে, প্রভাবশালী নারী, রাজনীতিক, তালেবান বিরোধীদের বাড়ির সামনে এরই মধ্যে রক্ষী বসিয়েছে তারা। ফলে নিজস্ব বিচার পদ্ধতি মেনে হোক বা না হোক মৃত্যুদণ্ডের নামে হত্যার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রথম মেয়াদে তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল, সেই সময়ে ২০০০ সালে আহমেদ রশিদের লেখা বই ‘তালেবান’–এ তিনি গোষ্ঠীটির মূল সংকট হিসেবে লিখেছিলেন—‘তাদের শাসন পদ্ধতি ও প্রশাসনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তারা পশতুন সমাজ ও সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করতে চাইলেও পারছে না। আবার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে চাইলেও পারছে না।’
এ দুইয়ের মধ্যে আটকে পড়া তালেবান কখনো সেভাবে রাজনীতি নিয়ে ভাবেনি, যতটা ভেবেছে সামরিক বিষয়াদি নিয়ে। ফলে বিস্তৃত পরিসরে একটি জাতিকে পরিচালনা বা শাসনের কৌশল কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে তারা বরাবরই সংশয়ে ছিল। আর এই সংশয় থেকেই তারা যেকোনো সংকটে সামরিক সমাধানটিকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
কথা হলো মার্কিন আগ্রাসনের এই সময়ে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার সময় তারা কি নিজেদের বদলেছে? ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার পর প্রতিষ্ঠিত কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টার’সের বার্ষিকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালের পর থেকে তালেবান বিভিন্ন ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। পশতুন এলাকার বাইরে নিজেদের সংগঠন বিস্তার করেছে। আর এই সময়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে—তারা প্রতিনিয়ত শিখছে। তারা বুঝতে শিখেছে যে, তাদের নিপীড়নমূলক আচরণ গোটা বিশ্ব থেকে তাদের একঘরে করে দিয়েছিল। এই একই অবস্থান বহু আফগানকেও তাদের বিপক্ষে নিয়ে গেছে, যারা সেই ১৯৯০–এর দশকে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সময়ে আশ্রয় দিয়েছিল, ক্ষমতার শুরুতে তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। এ বিষয়ে তাদের সচেতনতা বেড়েছে। বিশেষত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাদের কিছু উদার মনোভাব এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গে চীনের সঙ্গে তাদের সংযোগ আশা দেখাচ্ছে। চীন তার নাকের ডগায় কোনো অস্থিতিশীলতা চাইবে না—আগেই বলা হয়েছে।
কিন্তু তারপরও সামরিক সমাধান খোঁজা একটি গোষ্ঠী ২০ বছরের ব্যবধানে ক্ষমতায় এসে কতটা ভিন্ন শাসন দেবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তালেবান অন্য ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো থেকে একটু আলাদা এখানে যে, তাদের কোনো রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন নেই। তবে এখন তাদের এমন একটি অঙ্গের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। দোহায় আলোচনার জন্য তাদের প্রতিনিধিকে রাজনীতিক বলা ছাড়া তো উপায় নেই। কিন্তু মুশকিল হলো শাসন তো সংকট সমাধানের মতো তাৎক্ষণিক কোনো বিষয় নয়। উপরন্তু প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রবেশের পর তাদের সদস্যরা যেভাবে আফগানিস্তানের পতাকা অপসারণ করেছে, তা অন্য ইঙ্গিত দেয়। প্রতিটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তারা বিভিন্ন সরকারি ভবনে নিজেদের আলাদা পতাকা তুলেছে। আফগানিস্তান বলার বদলে তারা ইসলামি আমিরাত অব আফগানিস্তানই বলছে। ফলে এবারের শাসন আলাদা হবে বলে, যারা বড় স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা আবার হতাশ হতে পারেন।
এতে মুশকিল যতটা যা হওয়ার, তা আঞ্চলিক। বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় তালেবান ক্ষমতার বড় প্রভাব পড়বে। বিশেষত কট্টর সুন্নি গোষ্ঠীগুলো শক্তির উৎস হিসেবে দেখবে তালেবানকে, যা বাংলাদেশকেও ভাবাচ্ছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে ইরান ও ভারত। ইরান শিয়াদের নিয়ে তালেবানদের অবস্থানের কারণে। আর ভারত কাশ্মীর–লাদাখ সীমান্তে ত্রয়ীর বিরুদ্ধে লড়ার সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন। সঙ্গে দেশটির ক্ষমতায় বিজেপির ক্ষমতায় থাকাও এখন বিষয়টিকে কিছুটা জটিল করে তুলবে। এই অঞ্চলে এমন চতুর্মুখী কোনো দ্বৈরথ হলে তা তিনটি পরমাণু শক্তিধর দেশকে জড়াবে, যা গোটা অঞ্চলের জন্যই বড় উদ্বেগের।
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১৮ ঘণ্টা আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ দিন আগে