কর্মীদের কোম্পানির মুনাফার অংশ দিলে সবারই লাভ: বলছেন গবেষকেরা

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১: ২২
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯: ৫০

কেমন হতো, যদি সরকার কোম্পানিগুলোকে লাভের একাংশ শ্রমিকদের দিতে বাধ্য করত? ব্রিটেন ও আমেরিকায় এই প্রশ্নের কোনো স্থান নেই, সেখানে অনেকে আপনাকে পাগলও বলতে পারে। তবে ধারণাটি আসলে পাগলামি নয়। মুনাফা ভাগাভাগিকে উৎসাহিত করতে অনেক সরকারই কর ছাড় দিয়ে থাকে। আবার পেরু, মেক্সিকো, ফ্রান্সসহ কিছু দেশ ব্যবসায়ীদের লভ্যাংশ কর্মীদের সঙ্গে ভাগ করতে বাধ্য করে। 

মুনাফা ভাগাভাগির দুটি প্রধান লক্ষ্য রয়েছে: প্রথমত, বামপন্থীদের মতে, এটি কর্মীদের অনুপ্রাণিত করবে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াবে। শুনতে সুন্দর লাগলেও ব্যাপারটি কিছুটা অস্পষ্ট যে, কেন সরকারকে এটি বাস্তবায়নে কোম্পানিগুলোকে চাপ দিতে হবে? অন্য লক্ষ্যটি অনেকটাই সেকেলে। এটি হলো, পুঁজিকে শ্রমিকদের মাঝে পুনর্বণ্টন করা। 

মুনাফা ভাগাভাগির প্রমাণ পাওয়া কঠিন। অনেক অধ্যাপক ও গবেষক মুনাফা ভাগাভাগি ও উৎপাদনশীলতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু ঠিক কী কারণে এটি ঘটছে তার খুব বেশি প্রমাণ পাননি। ২০০১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইনস কোম্পানি লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি বোনাস অফার ঘোষণা করার পরে কর্মীদের কর্মক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু গবেষকেরা যুক্তি দিয়েছেন, এ সময় কর্মীরা একে অপরকে পর্যবেক্ষণ করার কারণে এটি হয়েছিল। 

বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, লভ্যাংশ ভাগাভাগি করার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে অথবা এর ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। ফ্রান্সে বিদ্যমান যেকোনো কর সুবিধা রাজস্ব বিভাগকে বিপাকে ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ সরকার নব্বইয়ের দশকে একটি স্বেচ্ছাসেবী ‘লভ্যাংশভিত্তিক বেতন স্কিম’ বাদ দিয়েছিল। কারণ তখন অনেক প্রতিষ্ঠানই কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই স্কিম নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চালু রাখত। 

এদিকে প্রচলিত ব্যবস্থায় কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেকোনো সময় কর্মীর মজুরি কমাতে পারে, কর্মীদের কোনোমতে জীবনধারণের জন্য স্বল্প বেতন দিয়ে বছরের পর বছর রাখতে পারে। আবার লভ্যাংশ ভাগাভাগির পর মালিকেরা কম ভাগ পেলে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। অথবা যেকোনো আইনের মতো কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ ভাগাভাগির বিরোধিতা করতে পারে। 

মেক্সিকোতে মুনাফা ভাগাভাগির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, দেশটিতে এ নিয়ে বিবাদ সাধারণ হয়ে উঠেছে। মেক্সিকোর শ্রম আইনজীবী রাফায়েল আভান্তে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে কোম্পানিগুলো অনানুষ্ঠানিক শ্রম ব্যবহারের পাশাপাশি সহায়ক সংস্থার মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে আইন এড়িয়ে গেছে। এভাবে মূল কোম্পানির লাভ একাই পকেটে পুড়েছে। সরকার সম্প্রতি জাল অংশীদারি চুক্তি নিষিদ্ধের চেষ্টা করছে, এখন নিয়োগকর্তারা মুনাফা ভাগাভাগির জন্য কোনো একটি ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা দাবি করছেন। 

ফ্রান্সেও একই ঘটনা ঘটেছে। দেশটিতে বড় কোম্পানিগুলোকে কর্মীদের সঙ্গে ‘অতিরিক্ত’ লাভের একটি অংশ ভাগ করতে হবে, যা ইকুইটি ভ্যালুর ৫ শতাংশের ওপরে হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ কর্মী এই নিয়মে বেতন পেয়েছেন। কিন্তু একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, আশির দশকের শেষের দিকে মাত্র ১০০ জনের কিছু বেশি কর্মী বিশিষ্ট কোম্পানিগুলো এই আইন মেনেছিল, সেই সময়ে অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দিকে সন্দেহের তীর ছিল। 

সেই গবেষণাটি ১৯৯১ সালে একটি ফরাসি সংস্কারের প্রভাবগুলোও মূল্যায়ন করে, যা ৫০–৯৯ কর্মী বিশিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আইনটির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করেছিল। সমীক্ষায় নতুন কোম্পানিগুলোর ওপর এই আইনের প্রভাবের সঙ্গে মাঝারি বয়সী কোম্পানিগুলোর তুলনা করা হয়। পাশাপাশি জোরপূর্বক লভ্যাংশ ভাগাভাগির প্রভাবকে আলাদা করে বিবেচনা করা হয়। 

এই গবেষণাপত্রের লেখকদের একজন ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অধ্যাপক ডেভিড স্রেয়ার। তিনি এই আইনের প্রভাবে কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ কমেনি দেখে অবাক হয়েছিলেন। তবে হতাশাজনকভাবে উৎপাদনশীলতাও বাড়েনি। আনন্দের বিষয় হলো, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা উচ্চ আয় থেকে লাভবান হয়েছেন বলে মনে হয়েছে। তাঁদের বেতনের চার-পঞ্চমাংশ শেয়ারহোল্ডাররা পরিশোধ করেছিলেন, বাকিটা দিয়েছিলেন করদাতারা। 

গবেষকেরা বলছেন, অ্যাংলো-আমেরিকান নীতি প্রভাবিত অঞ্চলে (অ্যাংলোস্ফিয়ার) নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আগে ধনকুবেরদের (ফাইন্যান্স ব্রো) সম্ভবত কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। বড় কোম্পানির জন্য এর ফল কাজে না-ও আসতে পারে বা সময়ের সঙ্গে তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। তাঁদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উচ্চ বেতনভোগী কর্মীদের মধ্যে এই মুনাফা ভাগাভাগির ফল পরিসংখ্যানগতভাবে প্রায় শূন্য। নিম্ন ও মধ্য আয়ের কর্মীরাই এই সুবিধা বেশি পান। স্রেয়ার ও তাঁর সহলেখকেরা মনে করেন, এমনটি হওয়ার কারণ হলো, কঠোর ন্যূনতম মজুরি নীতির কারণে ব্যবস্থাপকেরা বেতন কমাতে পারেন না। 

স্রেয়ারের মতে, স্কিমটির আরেকটি সুবিধা রয়েছে, এটি কর্মচারীদের করপোরেট কর নিরীক্ষা কর্মকর্তার ভূমিকায় নিয়ে যায়। ফ্রান্সে কর্মীরাই পরামর্শক নিয়োগ করেন, যাতে চালাক করপোরেট কর্মকর্তারা তাঁদের শোষণ করার কোনো সুযোগ না পান। ফলে কোম্পানিগুলো নিজেদের হিসাব বইয়ে নয়ছয় করার সাহস পায় না। 

স্বেচ্ছায় মুনাফা ভাগাভাগি স্কিম ও বাধ্যতামূলক ভাগাভাগি এই পদ্ধতির তুলনা করার একটি সুযোগ করে দিয়েছে ফ্রান্সের অভিজ্ঞতা। ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যানালাইসিসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় লভ্যাংশ ভাগাভাগির ব্যবস্থাটি শ্রমিকদের মজুরির ‘উল্লেখযোগ্য’ বিকল্পে পরিণত হয়েছে। 

প্রতিবেদনের লেখক ক্যামিল ল্যান্ডাইস মনে করেন, কোম্পানিগুলোকে বেতন নিয়ে আলোচনার সময় যে কর্মঘণ্টা নিয়ে নমনীয়তার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এই সুযোগে তারা এমনভাবে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করে, যাতে সামগ্রিকভাবে আর বেতন বাড়ে না। তাই এখানে রাষ্ট্রের ভর্তুকি দেওয়ার কোনো অর্থ থাকে না। 

ব্যবসাবান্ধব হতে আগ্রহী যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য লভ্যাংশ ভাগাভাগি ব্যবস্থার পক্ষে সুপারিশ করা একটি ভালো উপায় হতে পারে। তবে সত্যিকার অর্থে এটি কার্যকর করতে চাইলে কঠোর হাতে বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত